ভ্যান গঘের জনপ্রিয়তার পেছনে আছেন যে নারী
রাতের আকাশে বাঁকা চাঁদ আর মিটিমিটি তারা শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চোখে ধরা পড়েছিল। নীল আর হলুদ রঙের মিশেলে তিনি রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন রাতের রহস্যময় সৌন্দর্য। ক্যানভাসে প্রতিটি ব্রাশের টান তৈরি করেছে জাদুকরি শিল্প। কিন্তু জীবদ্দশায় নিজের কাজের কোনো স্বীকৃতি পাননি এই শিল্পী। তাঁর শিল্পের কদর বুঝতে মানুষের অনেকটা সময় লেগেছে। ভ্যান গঘের আঁকা খুব পরিচিত শিল্পকর্ম দ্য স্টারি নাইটসহ অনেক চিত্রকর্ম সবার সামনে এসেছে এক নারীর হাত ধরে। তাঁর নাম জোহানা ভ্যান গঘ-বনগার। কে ছিলেন তিনি? কেমন করে তাঁর কাছে ভ্যান গঘের শিল্পকর্ম এসেছিল?
মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তাঁর শিল্পকর্মের সংগ্রহ যায় থিওর কাছে। থিও ছিলেন ভিনসেন্টের সহোদর। ভ্যান গঘকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন থিও। নিজে ছিলেন একজন আর্ট ডিলার। ভ্যান গঘের সব চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে গঘের মৃত্যুর ছয় মাসের মধ্যে মারা যান ভাই থিও। এরপর ভিনসেন্টের চিত্রকর্মের ভার পড়ে থিওর বিধবা স্ত্রীর হাতে। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কাজকে বিশ্ববিখ্যাত করার পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন থিওর স্ত্রী জোহানা ভ্যান গঘ-বনগার। ভিনসেন্টের কিছু পেইন্টিং প্রদর্শনীর জন্য একটি জাদুঘরে ধার দিয়েছিলেন জোহানা। দ্য স্টারি নাইটসহ আরও কিছু পেইন্টিং বিক্রিও করেছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ জোহানা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের শিল্প প্রচারের প্রতি এত নিবেদিত হয়ে উঠলেন কেন?
১৮৯১ সালে মারা যান থিও। এর আগে জোহানা আর থিওর পরিচয় ছিল মাত্র দুই বছরের। স্বামীর মৃত্যুর পরে নিজের ছেলেকে একলা মানুষ করার সংগ্রাম শুরু করেন জোহানা। ভিনসেন্টের রেখে যাওয়া শত শত চিত্রকর্ম প্রদর্শন কিংবা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জোহানা। থিও সব সময় চাইতেন তাঁর ভাইয়ের কাজকে সবার সামনে তুলে ধরতে। স্বামীর এই ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন জোহানা। ছেলেকে নিয়ে প্যারিস থেকে ডাচ শহর বুসুমে চলে আসেন তিনি। সেখানে জীবিকার তাগিদে প্রতিষ্ঠা করেন একটি গেস্টহাউস।
ভিনসেন্টের কাজের পরিচিতি বাড়াতে একটি বিশেষ আয়োজন করেছিলেন জোহানা। অনেকটা মেলার মতো এই আয়োজনে একই সঙ্গে ভিনসেন্টের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী এবং বিক্রয় করা শুরু করেন। এখানে যেকোনো শিল্পকর্ম বিক্রির সময় অত্যন্ত কৌশলী ছিলেন জোহানা। তাঁর এই প্রয়াস ছিল বিশ্বজুড়ে ভিনসেন্টের কাজের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য। ভ্যান গঘের কাজের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী হয় ১৯০৫ সালে। আমস্টারডামের স্টেডেলিজক মিউজিয়ামে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীতে ভ্যান গঘের ৪৮০টির বেশি পেইন্টিং ছিল। এই প্রদর্শনীর পর ভিনসেন্টের কাজের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। এই প্রদর্শনীর জন্য ভিনসেন্টের পেইন্টিং বাছাই থেকে শুরু করে প্রদর্শনীতে কাজ করা পরিচারকদের অর্থ প্রদান পর্যন্ত সবকিছুতে জড়িত ছিলেন জোহানা।
১৯০৫ সালের এই প্রদর্শনীতে আসা কেউ কেউ ভিনসেন্টের কাজকে অতি আধুনিক বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় অনেক প্রশংসাও কুড়িয়েছেন ভ্যান গঘ। ১৮৯১ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে ভিনসেন্টের প্রায় ২০০টি শিল্পকর্ম বিক্রি করেন জোহানা। কিন্তু ভ্যান গঘের সূর্যমুখী ফুল নিয়ে করা পাঁচটি পেইন্টিংয়ের মধ্যে দুইটি বিক্রি করতে চাচ্ছিলেন না তিনি আর তাঁর ছেলে। ওই দুইটি পেইন্টিং খুব পছন্দ করতেন তাঁরা। অবশেষে ১৯২৪ সালে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে সূর্যমুখী ফুলের একটি পেইন্টিং বিক্রি করেন জোহানা। তখন তিনি সেই জাদুঘরের পরিচালককে লিখে জানিয়ে ছিলেন, ‘এটি ভিনসেন্টের গৌরবের খাতিরে একটি আত্মত্যাগ’।
শুধু ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চিত্রকর্ম নিয়ে কাজ করেই দমে যাননি জোহানা। ভিনসেন্ট ও থিওর মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সেই চিঠিগুলো সম্পাদনার মাধ্যমে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের একপ্রকার জীবনী তৈরি করে ফেলেন জোহানা। ১৯১৪ সালে চিঠিগুলো প্রকাশের পরে শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে ভ্যান গঘের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় সবার। চিঠিগুলোর সুবাদে ভ্যান গঘের ভক্তরা তাঁদের পছন্দের শিল্পীর স্বপ্ন, ইচ্ছা, সংগ্রাম ও শিল্প নিয়ে মতামত সম্পর্কে জানতে পারেন।
জোহানা ভ্যান গঘ-বনগার মারা যান ১৯২৫ সালে। তখন ভিনসেন্টের কাজ সারা বিশ্বের জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছিল। জোহানা জানতেন, ভ্যান গঘের কোনো পেইন্টিংগুলো তিনি বিক্রি করতে চান না। দ্য হারভেস্টসহ ভিনসেন্টের বেশ কিছু কাজ ভ্যান গঘ পরিবারের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। তাই তিনি ভিনসেন্টের কিছু শিল্পকর্ম দিয়ে একটি সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন। জোহানা আর থিওর একমাত্র ছেলের নামও ছিল ভিনসেন্ট। মায়ের মৃত্যুর পরে ভিনসেন্ট সে সংগ্রহটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে ভ্যান গঘ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে।
এখন ভ্যান গঘের চিত্রকর্ম মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার। নিলামে লাখ লাখ ডলারে বিকোয় তাঁর আঁকা ছবি। বলা বাহুল্য, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের এই জগৎজোড়া খ্যাতির পেছনে একজন সাধারণ নারীর অসামান্য অবদান রয়েছে।