পৌষ মাসে নাকি মোষ কাঁপে। প্রবাদের কথা সত্যি কি না, সেটা একটু যাচাই করে দেখা যেতে পারে। তবে পৌষ মাসে মানুষ কাঁপে-ছেলেরা কাঁপে, বুড়োরা কাঁপে, জওয়ানদেরও ছাড় নেই। লেপ-তোশকের অস্ত্র নিয়ে রীতিমতো রণসাজে সজ্জিত হয় আবালবৃদ্ধবনিতা। যাঁদের টাকাপয়সার ভান্ডারের পেটটা বেশ মোটাসোটা, তাঁরা হয়তো আরামসে সেই যুদ্ধে জিতে যান। হতদরিদ্র মানুষের সেই সুযোগ নেই। যাহোক, গরিব-বড়লোক সবাইকে কমবেশি পৌষ মাসে কাঁপতেই হয়। গরু-বাছুর, কুকুর-বিড়াল এমনকি বনের যিনি রাজাধিরাজ সেই বেঙ্গল টাইগারকেও কাঁপতে হয় শীত বাবাজির কাছে হার মেনে। কিন্তু যার নামে প্রবাদ, সেই মোষদের কাঁপানোই মুশকিল। যত ঠান্ডাই পড়ুক, চলতি পথে পুকুর কিংবা ডোবার দেখা পেলেই হলো, হুড়মুড় করে নেমে পড়বে সেই জলায়। নিজেকে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকবে মনের সুখে। গেরস্ত তখন ‘পায়ে পড়ি মোষ মামা’ বলে গান ধরলেও মোষ বাবাজিদের মন গলাতে পারবে না। ওদিকে মোষের গোঁয়ার্তুমির কারণে মাঠে-বাড়িতে রাজ্যের কাজ জমে স্তূপ হবে, গেরস্ত হায় হায় করবে, পাচন দিয়ে মোষকে দু-চার ঘা দিয়েও ওঠাতে পারবে না বরফশীতল পানি থেকে।
হিমালয়ের গা ধুয়ে আসা উত্তরের হিমেল বাতাস মানুষকে, পশুকে কাঁপিয়ে দেয়। কাঁপায় মাঠের ফসলও। তবে ফসলের কাঁপুনিটা হাড়কাঁপানো নয়, সবুজের উচ্ছ্বাসে লহর তুলে কাঁপা। উত্তুরে হিমেল হাওয়া বয়ে যায় কচি কচি ধানখেতে, হলুদের চাদর বিছিয়ে রাখা সরষে ফুলে হিল্লোল তুলে। ফুলে ফুলে দুলে দুলে গুঞ্জন তোলে মৌমাছির দল। বাতাসের মৃদু শাসানির সঙ্গে সেই গুঞ্জন স্বর্গীয় পরিবেশ গড়ে দেয় বাংলার পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে। কুয়াশার আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা সোনারোদ হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে গাঁয়ের কিনারে, মাঠের সবুজে, ঝরাপাতার ফাঁকে, গাছগাছালির শাখায় শাখায়।
শীতের ভয়ে গাছগাছালি ন্যাড়া হয়। বটপাকুড়ের মতো মহাবৃক্ষেরও রেহাই নেই, রাস্তার পাশে পথিকের ক্লান্তি জুড়ানো কড়ইগাছটাও বিবর্ণ হয়ে ওঠে। আম-কাঁঠালের সে ভয় নেই। ভয় নেই খেজুরগাছেরও। শীতের সঙ্গে খেজুরগাছের শত জনমের সখ্য। সেই সম্পর্কটাই বাংলার গ্রামীণ লোকজীবনকে মিষ্ট করে তুলেছে টইটমু্বর রস আর গরম গুড়ের মিষ্টি গন্ধের মৌমাতে।
ভোজনপ্রিয় বাঙালির কাছে, মিষ্টিপ্রিয় ছেলে-বুড়োর কাছে শীত তাই আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। খাঁটি নলেন গুড়ের স্বাদ একবার যে পেয়েছে, পরের জীবনে হিল্লি-দিল্লি, ইউরোপ-আমেরিকা যেখানেই বাস করুক, শীতের স্পর্শ পেলেই সেই স্বাদ মগজে হানা দেবে, জিবে জল খসাবে। শীতজুড়েই ব্যস্ত থাকে গুড়পল্লিগুলো। দুপুর পেরোতেই দা-দড়ি আর ভাঁড় নিয়ে গাছি ছোটে খেজুরবাগানে। বিকেলভর গাছ কাটে। সন্ধ্যা থেকে সারা রাত নলি বেয়ে ঝরা রস জমা হয় মাটির ভাঁড়ে। কাকভোরে লেপ-কম্বলের আদর ছেড়ে গাছিকে ছুটতে হয় রস আনতে হিমবুড়ির চোখরাঙানি উপেক্ষা করে। ছেলে-বুড়ো তাদের পথ চেয়ে থাকে। রস এলে হইহই করে গ্লাস হাতে ছুটে যায়। পাটকাঠির নলের ফাঁকে চুমুক দিয়ে রস খাওয়ার যে কী মজা, সে শুধু গাঁয়ের ছেলেমেয়েরাই বলতে পারে। পেটভরে রসপানের পর হঠাৎ শীতটা যায় বেড়ে। চাদর-সোয়েটার মানে না, ঠক ঠক করে দাঁতে দাঁতে ঘষা খায়, গা বেয়ে শীতের শিরশিরানি ছলকে ছলকে ওঠে উপচে পড়া নদীর পানির মতো। ছেলে-বুড়োরা তখন উঠানের সোনারোদে চলে যায় মিষ্টি রোদে শীত তাড়াতে।
গাঁয়ের রসের ভাগ কিন্তু অন্যকেও দিতে হয়। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ কেউ বাদ যায় না। সরিষার খেতে সব সময় মৌমাছিদের চাহিদা মেটে না। আসলে মৌমাছিদের পেট ভরলেও চোখ ভরে না কখনো। রাজ্যের মধু এনে জমা করে মৌচাকে, পরে তা যায় মানুষের পেটপুজোয়। রসের গন্ধে মাতাল হয়ে মৌমাছিরা খেজুরগাছে হানা দেয়। তবে নিশ্চয়ই দেখে নেয় আশপাশে বি-ইটার নামের মৌমাছিখেকো পাখিগুলো আছে কি না।
রাতে বাদুড়ের দল হামলা করে খেজুরগাছে। গাছের চাঁছা অংশে মুখ লাগিয়ে চেটেপুটে রস খায়। আর রেখে যায় নিপাহ ভাইরাস। তাই আজকাল সকালে কাঁচা রস খাওয়া বড্ড ঝুঁকি। তবে গরম রস কিংবা গুড় খেলে ভয় নেই। তবু কি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে! পাখি-বাদুড়ের ভয়ে গাছি নলিসহ ভাঁড়ের মুখটা ঢেকে রাখে।
রসের ভাঁড় সকালে খুলে আনার পরও রস ঝরে। দিনের রস টক হয়, তেমনি বিস্বাদ। গুড় ভালো হয় না তাতে। তাই গাছিরা সেই রস নেয় না। এমনিতেই ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরে যায় দিনভর। তখনই পোয়াবারো দুষ্টু কাঠবিড়ালিদের। ভীরু পায়ে গাছে উঠে কাঠবিড়ালিরা নলিতে, গাছের চোখে জিব লাগিয়ে চেটেপুটে রস খায়। সন্ধ্যার দিকে যদি গাঁয়ের মাঠে ঘুরতে যাও, কাঠবিড়ালিদের রস খাওয়ার সেই দারুণ দৃশ্য দেখবে তখন।
রস খায় পাখিরাও। ভোরে গাছি মাঠে যাওয়ার আগেও খায়, পরেও খায়। ভাতশালিককে দেখা যায় ভাঁড়ে বসে নলিতে চুমুক দিতে। শ্বেতাক্ষীর মতো খুদে পাখিদের নলিতে বসেই রস খেতে হয়। পাকড়া শালিকেরা আবার এক ধাপ এগিয়ে। নলিতে, গাছের চোখে চঞ্চু বিঁধিয়ে রস টেনে নেয় উদরে।
গিরগিটি, টিকটিকির দলও মাঝে মাঝে হানা দেয় রসের নলিতে। তবে এদের রস খাওয়ার দৃশ্য কালেভদ্রে চোখে পড়ে। ভাগ্যবান হলে তোমার ক্যামেরায়ও উঠতে পারে এমন দৃশ্য।
গাঁয়ের বনে শিয়াল রাজা। তারাও কি বঞ্চিত হয় রসের স্বাদ থেকে? তাই কি হয়! মাঠের হেন জিনিস নেই তারা চেখে দেখে না। খেজুরগাছে রস হয় একেবারে চারাবেলা থেকে। চারাগাছে একেবারে মাটির ওপরেই বসানো থাকে রসের ভাঁড়। এমনিতে ভাঁড়ের গলাটা বেশ সরু। তার ওপর নলি থাকে এর মুখেই। তা ছাড়া আর যা-ই পারুন না কেন, পণ্ডিতমশাইরা রসের ভাঁড় ভাঙতে শেখেননি। তাই চোখের সামনে এমন জিবে জল আনা রস চলে যাবে মানুষের ঘরে, তা তো হয় না। তেনারা খেজুরগাছে হানা দেন ভোররাতে। ততক্ষণে হয়তো রসের ভাঁড় উপচে পড়ার জোগাড়। ওপর থেকে ভাঁড়ের ভেতরে জিব নামিয়ে চুক চুক করে রসাস্বাদন করে পণ্ডিতের দল।