পাঠ্যবইয়ের গণিত বাস্তব জীবনে কী কাজে লাগে

এস্থার দুফলো আর অভিজিৎ ব্যানার্জিএএফপি

স্কুলের গণিত কি বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে? অনেকেই মনে করে, স্কুলের গণিত বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগে। সম্প্রতি বিখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল নেচার-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে কিছু ভিন্ন কথা। গবেষণাটি করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং এমআইটির অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলোসহ একদল গবেষক। তাঁরা দেখিয়েছেন, ভারতীয় বাজারে কাজ করা শিশুদের গাণিতিক দক্ষতা এবং স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতার মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। বাজারে কাজ করা শিশুরা বাস্তব জীবনে দ্রুত ও সঠিকভাবে হিসাব কষতে পারলেও স্কুলের গণিত পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না। একইভাবে, যারা স্কুলের গণিত পরীক্ষায় ভালো করে, তারা বাজারে বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ।

গবেষকেরা ভারতের কলকাতা ও দিল্লির ১ হাজার ৪ শতাধিক শিশু নিয়ে এই গবেষণা চালান। এসব শিশুর মধ্যে অনেকেই বাজারে কাজ করে। তারা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে। ফলে প্রতিনিয়ত তাদের যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করতে হয়। এই গণনা তারা কোনো কাগজ–কলম ছাড়া মুখে মুখেই করতে পারে। কিন্তু যখন তাদের স্কুলের পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়, তখন সেগুলোর উত্তর ঠিকভাবে দিতে পারে না।

অন্যদিকে, গবেষকেরা ৪৭১ জন স্কুলশিক্ষার্থীর ওপরও একই পরীক্ষা চালিয়েছেন। এরা সাধারণত স্কুলের পরীক্ষায় ভালো করে, কিন্তু বাজারের সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। গবেষকেরা দেখেন, মাত্র ১ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী বাজারের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। অথচ বাজারে কাজ করা শিশুদের মধ্যে তিনজনের একজনই সঠিক উত্তর দিতে পারে। মানে শতকরা প্রায় ৩৩ শতাংশ শিশু সঠিক উত্তর দেয়। সেখানে স্কুলশিক্ষার্থীরা সঠিক উত্তর দিতে পারে মাত্র ১ শতাংশ।

আরও পড়ুন

এই গবেষণায় শিশুদের গাণিতিক দক্ষতার উৎস বোঝার চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা। বাজারে কাজ করা শিশুরা মূলত বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে। তারা জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করে। গবেষকেরা বাজারে কাজ করা বাচ্চাদের একটা অঙ্ক করতে দেন। অঙ্কটা অনেকটা এ রকম—কোনো ক্রেতা ৮০০ গ্রাম আলু ২০ টাকায় এবং ১ দশমিক ৪ কেজি পেঁয়াজ ১৫ টাকা কেজি দরে কিনেছে। যদি ক্রেতা ২০০ টাকার নোট দেন, তাহলে কত টাকা ফেরত দিতে হবে? ৯০ শতাংশ শিশু এই প্রশ্নের সঠিক ও দ্রুত উত্তর দিয়েছে। আর দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ শিশু সঠিক উত্তর দিয়েছে।

কিন্তু এরপর ওই শিশুদেরই কয়েকটা তিন অঙ্কের সংখ্যাকে এক অঙ্কের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে বলা হয়েছিল। যেমন ৫১২–কে ৩ দিয়ে ভাগ করো। কিন্তু শতকরা ৩৩ ভাগের কম শিশু এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে। এমনকি যখন দুই অঙ্কের সংখ্যা থেকে দুই অঙ্কের সংখ্যা বিয়োগ করতে বলা হয়েছে (যেমন ৫৫ - ৩০ = কত? ), তখনো প্রায় অর্ধেক শিশু এর সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। এই হিসাব কিন্তু ওপরের আলু-পেঁয়াজের হিসাবের চেয়ে অনেক সহজ, কিন্তু বাজারের কর্মী শিশুরা এর সমাধান করতে পারেনি।

কোলকাতার বাজারে কাজ করছে একটি শিশু
ছবি: জেডএমই সায়েন্স

এরপর গবেষকেরা স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীদের ওই একই ভাগ ও বিয়োগ করতে দেন। তাদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে। কিন্তু যখন বাজারের সমস্যা দিয়ে খাতা–কলম ছাড়া সমাধান করতে বলা হয়, তখন প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। কাগজ–কলম ছাড়া শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধান করতে হিমশিম খাচ্ছিল।

আরও পড়ুন

কেন এমন হচ্ছে? খাতা–কলমে সমাধান করতে পারলে এমনিতে কেন পারছে না? কারণ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানস অঙ্ক বা সহজে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করার কৌশল স্কুলে শেখে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, এক কেজি চালের দাম ৪৩ টাকা। তাহলে ১১ কেজি চালের দাম কত? এই হিসাব স্কুলের শিক্ষার্থীরা করে খাতায়। কিন্তু বাজারে কাজ করা শিশুরা এটাকে ভিন্নভাবে গুণ করে। যেমন, ওরা প্রথমে ৪৩-কে ১০ দিয়ে গুণ করে পরে গুণফলের সঙ্গে ৪৩ যোগ করে। এতে সহজেই সমাধান পেয়ে যায়। কিন্তু স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই নিয়ম জানে না বললেই চলে।

তাহলে বাজারে কাজ করা শিশুরা এটা কোথায় শেখে? নিজেরা হিসাব করতে করতে তারা নানা সহজ কৌশল শিখে যায়। বড়রা যারা বাজারে, দোকানে বা অন্যান্য পেশায় কাজ করেন, তাঁরাও এ ধরনের সহজ কৌশল জানেন। তাঁদের কাছ থেকে এই শিশুরা শেখে।

ক্লাসরুমে যেভাবে গণিতের সমাধান করে স্কুলপড়ুয়ারা

গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের শেখার ধরন আলাদা হওয়ায় তারা বাস্তব গাণিতিক দক্ষতা থেকে খাতায় করা হিসাবে সহজে যেতে পারে না। বাজারে কাজ করা শিশুদের জন্য স্কুলের গণিত কঠিন ও অর্থহীন। কারণ, সেখানে বাস্তব জীবনের কোনো প্রসঙ্গ থাকে না। অন্যদিকে, স্কুলের শিশুদের জন্য বাজারের হিসাব-নিকাশ ছিল নতুন ধরনের সমস্যা, যা তাদের শেখানো হয়নি। ফলে তারা বাস্তবে এটি প্রয়োগ করতে পারছে না।

গবেষকরা বিভিন্ন উপায়ে এই সমস্যার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, যদি শিশুদের আগে থেকে উৎসাহ দেওয়া হয় বা আর্থিক পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাতেও ফলাফলে কোনো পরিবর্তন হয় না। এমনকি স্কুলের শিশুদের বাজারের সমস্যাগুলো স্কুলের ভাষায় বুঝিয়ে দিলেও তারা ভালো করতে পারেনি। অর্থাৎ, সমস্যাটা মূলত শিক্ষার ধরন ও পদ্ধতিতে।

গবেষকেরা বলছেন, ভারতের গণিত শেখার পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা প্রকাশ পায়। স্কুলের গণিত পাঠ্যক্রমে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ নেই। এই সমস্যা দূর করার জন্য শিক্ষাক্রমে বাস্তব জীবনের উদাহরণ ও সমস্যা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। শিশুদের শুধু বইয়ের অঙ্ক শেখানোর পরিবর্তে বাস্তব সমস্যার সমাধানে দক্ষ করে তুলতে হবে। খেলাধুলার মাধ্যমে, ব্যবসা পরিচালনার ছোটখাটো অনুশীলন বা বাজারের পরিস্থিতির ভিত্তিতে গাণিতিক সমস্যা তৈরি করে শেখানো যেতে পারে। এ ছাড়া গণিত শেখানোর পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা দরকার। শিশুরা যাতে গাণিতিক সমস্যার সমাধানে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে পারে, সেটিকে উৎসাহিত করতে হবে।

গবেষকেরা মনে করেন, এই পরিবর্তন যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই ভালো। কারণ, একবার যদি শিশুদের শেখার ধরন নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সেটা পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ছোটবেলা থেকেই বাস্তবমুখী গণিত শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, বাস্তব জীবনেও গণিত ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।

তবে জীবনমুখী এসব গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ের গণিতও গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যবইয়ের গণিত জানা না থাকলে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা যায় না।

সূত্র: নেচার ও জেডএমই সায়েন্স ডটকম

আরও পড়ুন