মহাকাশে বাংলা ভাষার প্রথম বই

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভেসে বেড়াচ্ছে বাংলা ভাষার প্রথম বই

১৮ মার্চ ২০২২।

ঘুম থেকে উঠলাম কাজাখস্তানে অবস্থিত রাশিয়ার বাইকোনুর কসমোড্রোমের ভেতরের একটি হোটেলে। কসমোড্রোমের ভেতরের এই হোটেলে সচরাচর কোনো সাধারণ নাগরিক থাকার সুযোগ পান না, তবে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’–এর অতিথি হিসেবে আমি সে সুযোগ পেয়েছি। সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রেসিডেন্ট। আছেন মহাকাশচারী এবং রসকসমসের কর্মকর্তারা।

গতকাল ছিল ‘টি মাইনাস ওয়ান ডে’ (T -1 Day), অর্থাৎ এক দিন পরই রকেট উৎক্ষেপণ। সে হিসাবে আজ আর দিন নয়, বরং সময়গণনা। টি মাইনাস এত ঘণ্টা, টি মাইনাস অত ঘণ্টা—বিষয়টা এমন, যেন এখানে ঘড়ির সময়ের চেয়ে রকেট উৎক্ষেপণের সময়টাকে কেন্দ্র করেই সবকিছু করতে হচ্ছে। বাইকোনুর কসমোড্রোমের ভেতরের নিরাপত্তার কথা নতুন করে কিছু বলার নেই, পান থেকে চুন খসে যাওয়ার মতো ঘটনাকেও এখানে ছাড় না দিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই—কসমোড্রোম অঞ্চলের ভেতরে আমরা যে হোটেলে থাকি, সেখানেও প্রতিবার ঢোকার সময় মূল ফটকের বাইরে ৩০ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আমাদের। চেকিং হয়, মিলিয়ে দেখা হয় সব কাগজ। আজ সকাল থেকেই নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। যেখানে কোনো শব্দই শোনা যেত না, যত দূর চোখ যেত, শুধু ফাঁকা আর ফাঁকা, সেখানে ঘুম থেকে উঠেই দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনছি একটু পরপর। বারান্দায় গিয়ে চোখে পড়ল দূরের রাস্তা ধরে অনেক গাড়ি যাচ্ছে—পুলিশের গাড়ি, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স। সবকিছুই আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। লাগবে না–ইবা কেন, প্রথমবারের মতো আমি আজ সরাসরি কোনো রকেটের উৎক্ষেপণ দেখব। শুধু তা–ই নয়, রসকসমসের কর্মকর্তারা তো এটাও বলেছেন যে তুমিই প্রথম কোনো বাংলাদেশি নাগরিক, যাকে আমরা আমাদের এই বাইকোনুর কসমোড্রোমে রকেট উৎক্ষেপণ দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি। আজ কাজাখস্তান সময় রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে ‘সয়ুজ এমএস-২১’ রকেটে করে মহাকাশে পাড়ি জমাবেন তিনজন রুশ মহাকাশচারী—ওলেগ আর্তেমইয়েভ, ডেনিস মেতভেভ ও সার্গেই কোর্সাকোভ। মজার বিষয়, এই তিন রুশ মহাকাশচারী প্রত্যেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাউমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’-এর সাবেক শিক্ষার্থী। তাই এই উৎক্ষেপণের নামকরণও করা হয়েছে রুশ ভাষায় ‘বাউমানস্কি স্তার্ত’, অর্থাৎ বাউমানের উৎক্ষেপণ।

রাতের বেলা ঘুমিয়েছি মাত্র দুই ঘণ্টা। কারণ, সারা রাত মহাকাশচারীসহ আমরা কয়েকজন আড্ডা দিয়েছি। আমার সদ্য চলে যাওয়া (১৬ মার্চ) জন্মদিনের জন্য তাঁরা আমাকে আবারও শুভেচ্ছা জানালেন। মহাকাশচারী সার্গেই কুদ-সভেরচকোভ আমাকে সুভিনির হিসেবে একটি মূল্যবান খাম উপহার দিলেন, যেটা এই মহাকাশ মিশনের উপলক্ষেই বানানো হয়েছে এবং শুধু সেই দিনই ব্যবহার করা হয়। সেখানে সেই দিনের সিলও দেওয়া আছে। মহাকাশে চিঠি নিয়ে যেতেও এই খাম ব্যবহার করা হয়। এই খাম পাওয়া খুবই দুষ্কর এবং কালেক্টরদের কাছে খুবই মূল্যবান। শুধু তা–ই নয়, মহাকাশ নিয়ে আমার স্ট্যাম্প সংগ্রহ দেখে অভিভূত হলেন তিনি। আমাদের পুরো আড্ডা জমেছিল হোটেলে, আমার রুমে।

এই খামটি দিয়েছিলেন মহাকাশচারী সার্গেই কুদ-সভেরচকোভ

দ্রুত মুখ ধুয়ে, পোশাক পরে চলে গেলাম হোটেলের ডাইনিংয়ে, সকালের নাশতা করতে। নাশতা করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম রকেট উৎক্ষেপণ প্যাডে। ততক্ষণে সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রকেট—সয়ুজ। কয়েক ঘণ্টা পরেই এই রকেট মহাকাশে পাড়ি জমাবে, ভাবতেই অবাক লাগছে। আমাদের সঙ্গে যেহেতু রাশিয়ার মহাকাশচারী এবং রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমসের কর্মকর্তারা আছেন, তাই আমরা সর্বোচ্চ কাছ থেকে রকেটটি দেখার সুযোগ পেলাম। মজার বিষয়, এখানে আমি শুধু একমাত্র বাংলাদেশিই না, একমাত্র বিদেশিও। রকেটের সামনে সবার সঙ্গে ছবি তোলার পাশাপাশি আমি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ছবি তুললাম, আমার বই মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি নিয়ে ছবি তুললাম। এ ছাড়া যেহেতু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের মধ্যে আমি একাই সেখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাই তাঁরা একটা কাগজে তাঁদের সিগনেচার করে দিয়েছিল, সেই কাগজ নিয়ে ছবি তুললাম।

তারপর সেখান থেকে আমরা চললাম বাইকোনুর কসমোড্রোমের বাইরে বাইকোনুর শহরের দিকে একটি হোটেলে, গাড়িতে প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ, যেখানে আজ যেই তিনজন মহাকাশচারী মহাকাশে গমন করবেন, তাঁরা আইসোলেশনে আছেন। প্রথমবারের মতো তাঁরা আইসোলেশন থেকে বের হয়ে বাইকোনুর কসমোড্রোমের ভেতরে আসবেন। আজকের মিশনের কমান্ডার মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভকেও আমি অনেক দিন পর দেখব। যিনি তৃতীয়বারের মতো মহাকাশে যাচ্ছেন। ওলেগ আর্তেমইয়েভই আমাকে বাংলাদেশের মহাকাশচারী হওয়ার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করছেন।

শেষবার তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হয়, সেটা ছিল এ বছরের জানুয়ারি মাস। তখনই তাঁকে আমি আমার লেখা মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি বইটি উপহার হিসেবে দিই। তিনি এই বইয়ের বিষয়ে আগে থেকেই জানতেন। বইয়ের ফ্ল্যাপের জন্য সুন্দর একটা লেখাও দিয়েছিলেন তিনি। যেহেতু তিনি মহাকাশে চলে যাবেন এবং মহাকাশে যাওয়ার আগে তখন সেটিই ছিল আমাদের শেষ দেখা, তাই আমি বইটি তাঁকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। বইটি বাংলায় লেখা, তিনি পড়তে না পারলেও নেড়েচেড়ে দেখলেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ভাষার নাম কি বাংলাদেশ ভাষা?’ আমি তাঁকে শুধরে দিয়ে বললাম, ‘না, এটা বাংলা ভাষা।’ তিনি বারবার বইয়ের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন, বইয়ের ছবিগুলো দেখলেন, তাঁর ছবিসহ ফ্ল্যাপের লেখাটা দেখলেন, আমি যে রুশ ভাষায় তাঁকে অটোগ্রাফ দিয়েছি, সেটা পড়লেন এবং আমার রাশিয়ান হাতের লেখার প্রশংসা করলেন। তারপর কৌতূহলী হয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাংলা ভাষার কোনো বই কি এখন পর্যন্ত মহাকাশে গিয়েছে?’ আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, ‘না।’ তিনি ফিরতি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি চাও তোমার এই বইটা আমি মহাকাশে নিয়ে যাই?’ আমি এবার উল্টো প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি পারবেন এটা মহাকাশে নিয়ে যেতে?’ তিনি বললেন, ‘আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। অনেক অনুমতি নেওয়ার বিষয় আছে। আমরা চাইলেই যেকোনো কিছু মহাকাশে নিয়ে যেতে পারি না। এর গুরুত্ব বুঝিয়ে যদি আমি অনুমতি নিতে পারি, তাহলে হয়তো নিয়ে যেতে পারব। না হলে ১০০-১৫০ গ্রামের একটি জিনিস নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। শুধু তা–ই নয়, আমরা সঙ্গে করে কী কী নিয়ে যাচ্ছি, সেটারও একটি তালিকা করা হয়। নিয়মের বাইরে কিছুই করতে পারব না বা নিতে পারব না। তবে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাকপ্যাক থেকে আরেকটি র‌্যাপিং করা বই বের করে দিয়ে বললাম, ‘এটা তাহলে মহাকাশে নিয়ে যাবেন, আর ওটা আপনার জন্য।’ উনি উত্তর দিলেন, ‘ঠিক আছে, এটা আমার বাসার লাইব্রেরির জন্য আর ওটা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরির জন্য। তবে তুমি আমাকে বাংলা ভাষা নিয়ে আরও বিস্তারিত কিছু লিখে দিয়ো, যেন আমি অনুমতি নিতে পারি।’ তারপর তিনি আমাকে তাঁর এই মহাকাশ মিশনের কিছু গিফট দিলেন, আমরা ছবি তুললাম এবং একটু গল্প করে বিদায় নিলাম।

এর কিছুদিন পরেই আমি তাঁকে বাংলা ভাষা নিয়ে অনেকগুলো তথ্য পাঠাই। বাংলা ভাষা যে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষা, এ প্রসঙ্গে সহায়ক সব তথ্যই দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। সেই সঙ্গে তাঁকে আমি মনে করিয়ে দিই, যে বইটি আমি তাঁকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়েছি, সেটিই যেন তিনি মহাকাশে নিয়ে যান। কারণ, সেই বইয়ে আমি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মহাকাশচারীদের জন্য অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম।

আর তাঁর এ বিষয়টি জানার কথা নয়, কারণ আমি তাঁর সামনে ব্যাকপ্যাক থেকে শুধু র‌্যাপিং করা একটি বই বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখনই আমি প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম, সুযোগ পেলে বইটি তাঁকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলব। তিনি রাজি হলে বইটি বের করে দেব। যেহেতু তিনি নিজ থেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাই আর আমার সেটি করতে হয়নি।

রকেটের সামনে লেখক

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সব মহাকাশচারীকে দুটি ভাষা অবশ্যই জানতে হয়—রুশ ও ইংরেজি। তাই আমি দুই ভাষাতেই অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম বইটিতে। তাঁকে পরে মেসেজ পাঠিয়ে যখন আমি মনে করিয়ে দিলাম, যেন সঠিক বইটি নিয়ে যান, তিনি আমাকে জানালেন, মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বইটি আমি তাঁকে দিয়েছিলাম, সেটি ইতিমধ্যেই তাঁর বাইকোনুর কসমোড্রোমে যাওয়ার লাগেজে উনি ঢুকিয়েছেন। কিন্তু তিনি এখনো নিশ্চিত নন যে সেটা নিয়ে যেতে পারবেন কি না, তবে সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করবেন। এরপর তাঁর সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’ যে আমাকে কোনো ভিসা ছাড়া আরেকটি দেশে চার্টার ফ্লাইটে করে বাইকোনুর কসমোড্রোমে নিয়ে এসেছে, এর কোনো কিছুই তিনি জানেন না। শুধু তাঁর সঙ্গে যেদিন আমার শেষ দেখা হয়, সেদিন ‌বলেছিলাম,‌‌ ‌‌‌‌‘ইশ্‌, যদি আপনাকে বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে মহাকাশে যাওয়ার সময় বিদায় দিতে পারতাম!’

মহাকাশচারীরা যেই হোটেলে আইসোলেশনে রয়েছেন, আমরা সেই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সঙ্গে আছেন এই মিশনের মহাকাশচারীদের স্ত্রী, সন্তান এবং পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়া আছেন অন্যান্য মহাকাশচারী, তাঁদের পরিবার, রুশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ রাশিয়ার মহাকাশ গবেষেণা সংস্থা ‘রসকসমস’–এর কর্মকর্তারা। অপেক্ষা করে আছে দুটি বাস। এই বাসে করেই এই মিশনের মহাকাশচারীরা এবং ব্যাকআপ ক্রুরা বাইকোনুর কসমোড্রোমের ভেতরে যাবেন। হঠাৎ সাউন্ড বক্সে বেজে উঠল রুশ ‘ত্রাভা উ দোমা’ গানটি। পৃথিবী নিয়ে লেখা এই অসাধারণ সুন্দর গানটি ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে যখন রুশ মহাকাশচারীরা বাইকোনুরে আইসোলেশন থেকে বের হয়ে কসমোড্রোমে যান, তখন বাজানো হয়। এর আগে কতবার যে ইন্টারনেটে এই ভিডিও দেখেছি! কিন্তু এবার প্রথম সামনাসামনি দেখছি, আমার বুক কেঁপে উঠছে। গানের সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডার ওলেগ আর্তেমইয়েভ তাঁর ক্রু মেম্বারদের নিয়ে বের হয়ে আমাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বাসে গিয়ে উঠলেন। আমার বারবার মনে হচ্ছিল—একবার কি তিনি আমাকে দেখতে পাবেন? এত রাশিয়ান মানুষের ভিড়ে এই বাংলাদেশের ছেলেটাকে কি দেখতে পারবেন? কিন্তু না, তিনি পেলেন না। তিনি হয়তো জানতে পারলেন না, আমি তাঁকে বিদায় দিতে এত দূর চলে এসেছি! তাঁর কল্পনাতেও হয়তো এটা নেই! এই ভাবতে ভাবতেই মহাকাশচারী সার্গেই কুদ-সভেরচকোভ বাইরে থেকে মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভের ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসের জানালার কাছে ধরলেন। কাচের জানালার বাইরে থেকে সে বাবাকে একবার স্পর্শ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। দৃশ্যটা খুবই বেদনাদায়ক।

যে বইটি আমি মহাকাশে পাঠিয়েছি, সেটিতে এই অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম

তাঁদের বাস ছেড়ে দিল। তাঁরা বাইকোনুর কসমোড্রোমের ভেতরে গিয়ে স্পেসস্যুট পরবেন। আমরাও কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে রওনা করলাম।

যে কক্ষে তাঁরা স্পেসস্যুট পরবেন, সেই কক্ষেই স্পেসস্যুট পরার পর শেষবারের মতো পুরোপুরি কাচের একটি দেয়ালের এক পাশ থেকে আরেক পাশে থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলবেন। সচরাচর এ সময় রাশিয়ার মহাকাশ গবেষেণা সংস্থা ‘রসকসমস’–এর প্রধান কর্মকর্তারা মহাকাশচারীদের সঙ্গে কথা বলেন, কথা বলেন তাঁদের পরিবার এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ দু–একজন মানুষ। তারপরই মহাকাশচারীরা সেখান থেকে বের হয়ে অনুমতি নিয়ে বসেন রকেটে। এর আগে এই সবকিছুই আমি অসংখ্যবার রাশিয়ার বিভিন্ন মহাকাশ মিশনের ভিডিও দেখার সময় দেখেছি।

এই কক্ষে সবার ঢোকার অনুমতি নেই। ছোট্ট রুমের মধ্যে মানুষ গিজগিজ করলেও প্রত্যেকেই রুশ সরকারের বড় কর্মকর্তা। এ ছাড়া কোনো মহাকাশচারী, নয়তো সেই মিশনের মহাকাশচারীর পরিবারের কাছের কেউ। আমি ‘রসকসমস’-এর অতিথি। তাই ভাগ্যক্রমে আমি এই কক্ষে ঢোকার সুযোগ পেয়ে গেলাম। এটা প্রায় অসম্ভব একটি বিষয় ছিল। কারণ, বাইরে আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনেক শিক্ষক, বড় বড় গবেষক, সরকারি অনেক কর্মকর্তাও ছিলেন, যাঁদের এখানে ঢোকার সুযোগ ছিল না।

এই মিশনের কমান্ডার মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভ ও তাঁর মেয়ে

এই কক্ষে ঢুকেই আমি পেছনে একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে ওলেগ আর্তেমইয়েভের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে পাড়ি জমাবেন। কী ভাবছেন এই মুহূর্তে? হেসে হেসে সবার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে কী চিন্তা কাজ করছে? তিনি অনেকের দিকে তাকাচ্ছেন, কাচের ওপাশ থেকে পরিচিত মানুষের অনেককেই হাত নেড়ে হাই দিচ্ছেন।

তিনি কি আমাকে দেখতে পাবেন? দেখলেও কি চিনতে পারবেন? মহাকাশচারীরা পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট মানুষ হন, দেখলে চিনতে না পারার কোনো প্রশ্নই আসে না। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল আমার দিকে, তিনি ঝুঁকে বসা থেকে সোজা হলেন, কাচের ওপাশ থেকে ‘ওয়াও’ বা এই ধরনের একটা শব্দ করলেন, টেবিলের ওপরে রাখা তাঁর মুঠোফোনে আমার একটা ছবি তুললেন। সামনে বসে থাকা ওলেগের স্ত্রী পেছন ফিরে তাকালেন। আমার চোখ ছলছল করছে!

এই মিশনের ৩ মহাকাশচারী, কমান্ডার ওলেগ আর্তেমইয়েভ (মাঝে) এবং আমি (পেছনের দিকে ডানে পাশে নীল জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে)

একজন রাশিয়ান মহাকাশচারী, যিনি কিছুক্ষণ পর মহাকাশে গমন করবেন এবং যিনি এই মিশনের কমান্ডার, তিনি মহাকাশে যাওয়ার আগে একজন বাংলাদেশি ছেলেকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন! আমার কাছে সত্যিই সবকিছু থেমে গিয়েছিল সে সময়। মহাকাশচারী হওয়ার ওই আসনে বসা আমার স্বপ্ন, আর সেখানে বসে থাকা একজন, যিনি তাঁর পুরো পরিবার এবং সবাইকে ছেড়ে ১৯৫ দিনের জন্য পৃথিবীর বাইরে চলে যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেও আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন! আমি তাঁর দিকে একনজরে তাকিয়ে আছি। ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবু আমি আমার জায়গা পরিবর্তন করলাম না। আমার মনে হয়েছে, ওলেগ যদি আমাকে আবার কিছু বলতে চান, তিনি সেদিকেই তাকাবেন, যেখানে আমি ছিলাম। ঠিক তা-ই করলেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে হাত মুষ্টি করে বারবার নাড়াতে নাড়াতে রুশ ভাষায় বললেন, ‘মালাদিয়েৎস’। যেটা তিনি বাংলায় ‘শাব্বাশ’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমি আমার বুকে হাত রেখে তাঁকে বললাম, ‘স্পাসিবা, স্পাসিবা ভাম বালশোই’ অর্থাৎ ‘ধন্যবাদ, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ’। উনি বুঝতে পেরেছেন এই বাংলাদেশি ছেলেটা কত দূর চলে এসেছে তাঁকে বিদায় দিতে। অন্ততপক্ষে এই কক্ষ পর্যন্ত আসাটা যে কতটা কঠিন, তা তিনি ভালো করেই জানেন। কক্ষটায় তখনো বেশ কিছু মানুষ আছেন, তাই আমিও থাকলাম। অনেকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শেষে একটু ফাঁকা হলে, তিনি আবার তাকালেন আমার দিকে। এবার তিনি কাচের ওপাশ থেকেই হাত দিয়ে ইশারাতে ছোট্ট একটা চারকোনা বক্স বানিয়ে (আম্পায়াররা যেভাবে থার্ড আম্পায়ারের সাইন দেখায়), আঙুল দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে ওপরে যাচ্ছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে উনি আমার বইটি মহাকাশে নিয়ে মহাকাশে যাচ্ছেন। সে সময় কী মনে হচ্ছিল জানি না। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো যথেষ্ট ভাষাজ্ঞান হয়তো আমার নেই। আমি প্রথমবারের মতো জানতে পারলাম আমার লেখা একটি বই, বাংলা ভাষায় লেখা একটি বই প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছে। আমি শুধু তাঁকে বুকে হাত রেখে ধন্যবাদই জ্ঞাপন করেছিলাম। এই আনন্দ আমি কাকে বোঝাব? কীভাবে বোঝাব? শুধু এতটুকু বুঝতে পারছিলাম, এটা আমার একার অর্জন নয়, এটা বাংলাদেশের অর্জন, বাংলা ভাষার অর্জন। আমরা যাঁরা দেশের বাইরে পড়তে যাই, তখন আমরা আর একজন একক ব্যক্তি থাকি না, আমরা প্রত্যেকেই একটা গোটা দেশ হয়ে যাই।

একসময় সেই কক্ষ থেকে আমরা সবাই বের হয়ে গেলাম। মহাকাশচারীরা শেষ অনুমতি নিয়ে রকেটে গিয়ে বসলেন। তখনো রকেট উৎক্ষেপণের অনেক সময় বাকি। আমরা হোটেলে ফিরে প্রায় বিকেলের দিকেই দুপুরের খাবার খেলাম। রকেট উৎক্ষেপণের ২ ঘণ্টা আগে আমরা আবার উৎক্ষেপণের কাছে জড়ো হলাম। উৎক্ষেপণ দেখার জন্য তাঁবু করা হয়েছে। সেখান থেকেই দেখতে হবে। উৎক্ষেপণের ১ ঘণ্টা আগে কসমোড্রোমের ভেতরের এলাকায় সব ধরনের চলাচল বন্ধ থাকে। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা, তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তো হবেই। তার মধ্যে ফাঁকা অঞ্চলের জন্য প্রচুর ঠান্ডা বাতাস। শীতের ভারী ভারী কাপড় পরেও আমার হাড়সহ কেঁপে উঠছিল, হাত বের করে ভিডিও করতেও পারছিলাম না। একসময় উৎক্ষেপণের সেকেন্ড গণনা শুরু হলো। বিকট শব্দে রকেটের ইঞ্জিন স্টার্ট হলো, মনে হলো পুরো এলাকা কেঁপে উঠল, মুখের মধ্যে আগুনের ঝলকানি এসে লাগল। তারপর গর্জন দিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমাল বিশালাকার রকেটটি। আমি রকেট সায়েন্স নিয়েই পড়াশোনা করছি, এর আগে ভিডিওতে অসংখ্য রকেটের উৎক্ষেপণ দেখেছি, কিন্তু এর বিশালত্ব, গর্জন দিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমানো, এটা সরাসরি না দেখার আগে অনুমান করতে পারিনি। আনন্দে সত্যি সত্যি এবার আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমার ক্ষুদ্র জীবনের এখন পর্যন্ত এটাই শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। আমি সরাসরি শুধু একটি রকেট উৎক্ষেপণই দেখছিলাম না, এই রকেটে করে আমার প্রিয় মহাকাশচারী মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, এই রকেটে করেই বাংলা ভাষার প্রথম বই মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছিল।

তার পর থেকেই অপেক্ষা করেছিলাম, কবে মহাকাশ থেকে আমার বই নিয়ে কোনো তথ্য পাব। মহাকাশে মহাকাশচারীরা প্রচুর ব্যস্ত থাকেন এবং প্রতিটি কাজ শিডিউল অনুযায়ী করতে হয় তাঁদের। প্রতি ৫ মিনিটের জন্য কাজের শিডিউল তৈরি করা থাকে। এ ছাড়া মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনেরও কমান্ডার। তাই তাঁর কাজের চাপ অন্যদের চেয়ে বেশি। আমি সাহস করিনি তাঁকে বিরক্ত করার। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, তিনি আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন। আমি তাঁকে উত্তর দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, আমাকে একটি ছবি পাঠালেন, যেই ছবিতে তিনি আমার বই ধরে আছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। তারপর একটি ভিডিও পাঠালেন, যেখানে বইটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভাসছে। ভিডিওটি দেখে আমার হাত কাঁপছিল। আমি সবকিছু জানলেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যে আমার সৃষ্টি, আমার লেখা বাংলা ভাষার একটি বই এখন মহাকাশে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁকে কৃতজ্ঞতাসহ উত্তর দিলাম। ঠিক তখনই তিনি রাশিয়ান ভাষায় একটি মেসেজ পাঠালেন, যার অর্থ, ‘তোমার দেশ এবং তোমার দেশের মানুষের জানা উচিত যে তোমাদের ভাষার বই ইতিমধ্যেই মহাকাশে চলে এসেছে এবং পরবর্তী ধাপ হওয়া উচিত মহাকাশে তোমার দেশের মানুষের কোনো প্রতিনিধি (মহাকাশচারী) এবং এটা তোমার হওয়া উচিত।’

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কুপোলাতে মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভের হাতে বইটি

আমি মেসেজটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। দিনটি ছিল ৩ জুন ২০২২, শুক্রবার। তারপর আমি আমার ফেসবুক পেজে বিষয়টি নিশ্চিত করে সেই ভিডিওটি প্রকাশ করি। পরে ১০ জুন তিনি আমাকে আবার বইটিসহ আন্তর্জাতিক মহাকাশস্টেশনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ‘কুপোলা’-তে কয়েকটি ছবি পাঠান। যে ছবিতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ভেতর ভাসতে থাকা বাংলা একটি বইয়ের সঙ্গে পৃথিবী এবং মহাকাশচারীদের জন্য অপেক্ষা করে থাকা সয়ুজ স্পেসক্রাফটও দেখা যাচ্ছিল।

বাংলা ভাষার একটি বই মহাকাশে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। কতই না মনোমুগ্ধকর হবে যখন বাংলাদেশের কোনো মহাকাশচারী মহাকাশে ভেসে বেড়াবেন! গবেষণা করে বের করে নিয়ে আসবেন মহাকাশের অজানা সব রহস্য! সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা পাড়ি জমাব মহাকাশে। সেদিনই সার্থক হবে আমাদের জাতীয় কবির লেখা কবিতার এই লাইনগুলো—

‘হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন “‌‌‍‍‍‍‍‍‌‌‌‍‍‍‍মঙ্গল” হতে আসছে উড়ে।’
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।”