মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছ। কিন্তু তোমার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে দুষ্টু মশা। কানের কাছে ভনভন করেছে সেই কখন থেকে। যখনই কষে থাপ্পড় মারছ, নিজেই ককিয়ে উঠছ ব্যথায়। মশার কিচ্ছু করতে পারছ না। কখন যে কে বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি মেরে দিচ্ছে, তা-ও ঠিক করে দেখতে পারছ না নচ্ছার মশাগুলোর জন্য। আজকাল মশা মারার স্প্রেগুলোতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। তুমি যতই ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করো না কেন, ওদের কিছুই করতে পারবে না। ঠিকই লাখ লাখ মশা জন্ম নেবে আবার।
আচ্ছা ভাবো তো, বাংলাদেশে মশা না থাকলে কেমন হতো? কী মজার একটা ব্যাপার হতো, তাই না? খেলা দেখাই বলো আর পড়তে বসার কথাই বলো, একটু পরপর তো কষে চড়–থাপ্পড় মাড়তে হতো না নিজের শরীরে। কী ভাবছ? যা সম্ভব নয়, তা নিয়ে কেন কথা বলছি? অবশ্য খুব একটা মন্দ ভাবোনি তুমি। মশাবিহীন বাংলাদেশের কথা চিন্তা করা অসম্ভবই বটে। তবে একটা দেশ আছে, যেখানে কোনো মশা নেই। দেশটির নাম আইসল্যান্ড। একটিও মশা নেই ইউরোপের এই দেশটিতে। কেন মশা নেই? কী এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে দেশটি? নাকি এটা কোনো অমীমাংসিত রহস্য?
আসলে এখানে রহস্যের কিছু নেই। প্রকৃতির নিয়মের কারণে আইসল্যান্ডে মশা বাঁচতে পারে না। মশার বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু। আরও একটু সহজ করে বলি। বংশবিস্তারের জন্য স্থির জলাশয় প্রয়োজন। মানে যেখানে পানিতে স্রোত নেই তেমন জলাশয়। কিন্তু আইসল্যান্ডে স্রোতহীন এমন কোনো জলাশয় নেই। আরও একটা কারণ আছে সে দেশে মশা না জন্মানোর।
সাধারণত ডিম ফুটে একটি পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সময় লাগে ৪০ দিন। কিছু মশা অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। পাঁচ দিনেই পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়। ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমেই। ও কথা বলে লাভ নেই। যাহোক, মশার পূর্ণাঙ্গ হতে ৪০ দিন সময় লাগলেও আইসল্যান্ডের তাপমাত্রা পরিবর্তন হতে কিন্তু এত সময় লাগে না। মানে দেশটিতে একবার শীত শেষ হয়ে আবার শীত শুরু হয় ৪০ দিনের আগেই। ফলে কিছুটা বরফ গলে যা-ও একটু পানিতে পরিণত হয়, তা আবার বরফই হয়ে যায়। এতে মশা আর বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। তা ছাড়া তীব্র শীতে মশার বেঁচে থাকাও মুশকিল।
আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, আইসল্যান্ডের জলাশয়ে রাসায়নিক পদার্থের যে অনুপাত রয়েছে, তা মশার বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে সব মিলিয়ে জলাশয়ের অভাব, তীব্র শীত ও স্রোতহীন নদীর অভাবে আইসল্যান্ডে মশা জন্মাতে পারে না।
এখন তোমার মাথায় প্রশ্ন জাগতে পারে, আইসল্যান্ডের মতো আরও কিছু দেশেও তো তীব্র শীত হয়। যেমন আইসল্যান্ডের পাশের দেশ গ্রিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া ইত্যাদি। সেখানে কীভাবে মশা বংশবিস্তার করে! আসলে ওসব দেশে এত দ্রুত শীত ফিরে আসে না। মানে একবার শীত গিয়ে আবার ফিরে আসতে আসতে মশার বংশবিস্তার করা সাড়া।
তোমাদের আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি। আইসল্যান্ড ছাড়াও অ্যান্টার্কটিকায় কিন্তু মশা পাওয়া যায় না। আসলে অ্যান্টার্কটিকা কোনো দেশ নয় তো, তাই এতক্ষণ বলিনি। আইসল্যান্ডের মতো এখানেও তীব্র শীতের কারণে মশা জন্মাতে পারে না। এটি একটি মহাদেশ। প্রায় ৯৮ শতাংশই ঢাকা থাকে বরফে। স্থায়ীভাবে কোনো মানুষও এখানে বাস করে না। তবে অনেক দেশ এখানে গবেষণা স্টেশন বানিয়েছে। ওসব স্টেশনে থাকেন কয়েকজন বিজ্ঞানী ও গবেষক। তাঁরাও গবেষণা শেষ করে যে যাঁর দেশে ফিরে যান। তাই যদি বলো কতটি দেশে মশা নেই, তাহলে বলতে হবে একটি দেশ—আইসল্যান্ড।
আরেকটা মজার তথ্য বলি? এতক্ষণ যে বললাম, আইসল্যান্ডে একটি মশাও নেই, এতে একটু ভুল আছে। আসলে একটি মশা আছে দেশটিতে। যদিও জীবিত নয়, মৃত। দেশটির আইসল্যান্ডিক ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরে গেলে মশাটির দেখা পাওয়া যাবে। ১৯৮০ সালে মশাটি পাওয়া গেছে গ্রিনল্যান্ড থেকে ফেরা একটি বিমানে। মানে মশাটি গ্রিনল্যান্ড থেকেই হয়তো ভ্রমণে এসেছিল। বেচারা আর স্বদেশে ফিরে যেতে পারেনি। ধরে বোতলে আটকে রেখেছে আজ ৪৩ বছর হলো।
এবার একটি ভয়াবহ তথ্য দিয়ে লেখার ইতি টানি। তুমি কি জানো, বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী কোনটি? যদি ভাবো আমি মশার কথা বলছি, তাহলে তোমার অনুমান শতভাগ ঠিক। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাসসহ অসংখ্য রোগ হয়ে এই পিচ্চি মশার কারণে। ছোট বলে একে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই। মশার কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী গড়ে ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। আর কোনো প্রাণীর জন্য এত মানুষ মারা যায় না। তা ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কেমন, তা তো ইদানীং দেখতেই পাচ্ছ। পৃথিবীতে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির মশা আছে। আড়াই হাজার বছর বেশি সময় পৃথিবীতে টিকে আছে মশা।