লক্ষ্য অর্জনে বয়স কোনো বাধা নয়

কিংবদন্তি সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের অসাধারণ একটা কবিতা ‘জীবনের হিসাব’। এ কবিতায় একজন বিদ্বান ব্যক্তি শখের বশে নৌকায় চড়ে নানান প্রশ্ন করে কাবু করতে থাকেন মাঝিকে। গ্রামের নৌকার এক মাঝি, লেখাপড়া জানে না। বিদ্বান বাবুমশাইয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তরই দিতে পারছিলেন না। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় ওঠে নদীতে। কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি ভয় পেয়ে জানান, সাঁতার জানেন না তিনি। মাঝি দেখলেন, লোকটা এত কিছু জানেন অথচ জীবন বাঁচানোর জন্য যা দরকার, সেই সাঁতারটাই জানেন না। তখন মাঝি বলেন, ‘বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে/তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে।’

আসলে সাঁতার জানা আমাদের খুব জরুরি। আমরা কেউ শখের বশে সাঁতার শিখি। কেউ শিখি স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য। আবার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্যও সাঁতার শেখেন অনেকে। দূরপাল্লার সাঁতারে দক্ষতা অর্জন করেন অনেকে। বয়স, গভীর পানি অথবা সাগরের উত্তাল ঢেউ বা হাঙর কিংবা বিষাক্ত জেলিফিশ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না তাঁরা। তাঁদের রয়েছে অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তি। তেমনিই এক সাহসী নারীর কথা বলব আজ, যিনি সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন কিউবা থেকে ফ্লোরিডা। ১৮০ কিলোমিটার সাঁতারানো এই সাঁতারুর নাম ডায়ানা নিয়াদ। আজকে তাঁর কথাই বলব তোমাদের।

ডায়ানা নিয়াদ একাধারে সাংবাদিক ও দূরপাল্লার সাঁতারু। বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডায়। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার শুরু করেন তিনি। হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় সাঁতারে এতই পারদর্শী হয়েছিলেন যে ব্যাকস্ট্রোক সাঁতারে হয়েছিলেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন।

জেলিফিশের কবলে

১৯৭৩ সালে ইলিনয়ের লেক ফরেস্ট কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন নিয়াদ। শুরু করেন সাঁতারের ম্যারাথন। পরের বছরই ইতালির বে অব নেপলস প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি। ২২ মাইলের এই দূরত্ব নিয়াদ শেষ করেছিলেন মাত্র ৮ ঘণ্টা ১১ মিনিটে। পরের বছর গতি আর দূরত্ব দুটিই বাড়ান নিয়াদ। নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটান দ্বীপের চারপাশে ২৮ মাইল দূরত্ব সাঁতরে পাড়ি দেন ৭ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটে। ১৯৭৯ সালে উত্তর বিমিনির বাহামিয়ান দ্বীপ থেকে ফ্লোরিডার জুনো বিচ পর্যন্ত ১০২ মাইল অতিক্রম করেন ২৭ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে। তখনকার সময়ে সমুদ্রের বুকে এটা ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম সাঁতার। ১৯৭৮ সালে নিয়াদ কিউবা থেকে সাঁতরে ফ্লোরিডা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু উত্তাল সমুদ্র আর ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ায় ব্যর্থ হয় তাঁর প্রচেষ্টা।

৩০ বছর বয়সে এসে সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়েন নিয়াদ। ছেড়ে দেন সাঁতার। কিন্তু কয়েক দশক পর আবার সাঁতারের লক্ষ্য ঠিক করলেন অভিজ্ঞ এই সাঁতারু। মা বারবার উৎসাহ দিতেন লড়াই করার জন্য। মনে সাঁতারের লক্ষ্য নিয়ে নিয়াদও তাঁর ক্যারিয়ার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালে মারা যান তাঁর মা। মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন এই সাঁতারু। কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকে ঠিকই ঘুরে দাঁড়ান আবার। ২০১১ সালে আবার চেষ্টা করলেন কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু পরপর দুবার ব্যর্থ হলেন তিনি। হাঙর ঠেকানোর শিল্ড ছাড়াই সাঁতারে নেমেছিলেন নিয়াদ। প্রথমবার অগাস্টে অ্যাজমার কারণে প্রায় ২৯ ঘণ্টা পর হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আবার চেষ্টা করেন। ৪০ ঘণ্টা সাঁতার কেটে উঠে আসেন নৌকায়। কারণ, বিষাক্ত জেলিফিশের কবলে পড়েছিলেন তিনি। আক্রান্ত হন মারাত্মকভাবে। ২০১২ সালে চতুর্থবারের মতো সাগরে নামেন। কিন্তু এবার ব্যর্থ হন সামুদ্রিক ঝড়ের কারণে। এবার তিনি ৬০ ঘণ্টা সাঁতার করেছিলেন।

কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা

২০১৩ সালে এসে নতুন লক্ষ্য স্থির করলেন ডায়ানা নিয়াদ। আবারও কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত সাঁতারের পরিকল্পনা করলেন নিয়াদ। দীর্ঘ এই প্রণালির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ মাইল বা ১৮০ কিলোমিটার। ৬৪ বছর বয়সে এমন দীর্ঘ দূরত্ব সাঁতরে পাড়ি দেওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ডায়ানা নিয়াদ পিছু হটার মানুষ নন। কিউবা থেকে নেমে পড়লেন সাগরে। এই প্রণালিতে রয়েছে সামুদ্রিক প্রাণীর চলাচল। রয়েছে প্রচুর হাঙর। কিন্তু কোনো রকম সুরক্ষা ছাড়াই কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত ১৮০ কিলোমিটার সাঁতার কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিয়াদ। শরীরের সব শক্তি দিয়ে সাঁতার কাটলেন তিনি। কিউবার হাভানার অন্য পাশে ফ্লোরিডার মানুষ ইতিমধ্যেই বলাবলি করছিলেন, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। ৫২ ঘণ্টা কেটে গেলেও কেউ বিশ্বাস করেননি যে ফ্লোরিডায় পৌঁছাতে পারবেন নিয়াদ। কিন্তু ৫২ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট পর ঠিকই ফ্লোরিডায় পৌঁছে গেলেন দূরপাল্লার এই সাঁতারু। তাঁর এই যাত্রায় সঙ্গে ছিল ৩৫ জনের একটি সহায়তাকারী দল। ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষকও। টানা ৫২ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট ১৮.৬ সেকেন্ড পর নিয়াদ ২ সেপ্টেম্বর এই দীর্ঘ পথটি সাঁতরে পাড়ি দেন।

এই কৃতিত্ব তাঁকে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার এক দারুণ উদাহরণ। ডায়ানা নিয়াদ প্রমাণ করেছেন, দুঃসাহসী লক্ষ্য অর্জনে বয়স কোনো বাধা নয়। তিনি ওপেন ওয়াটার সুইমিং বা খোলা জলে সাঁতার কাটায় সব বয়সী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে আছেন। অসাধারণ এই অর্জন মাকে উৎসর্গ করেছিলেন নিয়াদ।

এই ডকুমেন্টারিত নাম–ভূমিকায় অভিনয় করে অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন অ্যানেট বেনিং
ছবি: সিনে ম্যাটেরিয়াল

নিয়াদ বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে স্মৃতিকথা ‘দ্য আদার শোরস (১৯৭৮)’ এবং ‘ফাইন্ড আ ওয়ে (২০১৫)’। নেটফ্লিক্স তাঁকে নিয়ে তৈরি করেছে বায়োপিক নিয়াদ (২০২৩)। এই ডকুমেন্টারিত নাম–ভূমিকায় অভিনয় করে অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন অ্যানেট বেনিং। দারুণ এ চলচ্চিত্রটি দেখে ফেলতে পারো।