ঠান্ডা পানির চেয়ে গরম পানি কি দ্রুত বরফ হয়

গরম পানির দ্রুত বরফে পরিণত হয়ছবি: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

সাধারণ এক বোতল পানি ফ্রিজে রাখো। আর এক বোতল পানি ফুটিয়ে গরম করে ফ্রিজে রাখো। এই দুই বোতল পানির মধ্যে কোন বোতলের পানি দ্রুত বরফ হবে? সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করলে মনে হতে পারে, ঠান্ডা পানিই আগে বরফ হবে। কারণ, বরফ হওয়ার কাজটা তো ঠান্ডা পানি কিছুটা এগিয়েই রেখেছে। গরম পানি বরং ঠান্ডা হয়ে ধীরে ধীরে বরফ হবে! তবে বাস্তবে এই চিন্তার সঙ্গে সব সময় মেলে না প্রকৃতির নিয়ম। আসলে গরম পানির বোতলটাই মাঝেমধ্যে আগে বরফে পরিণত হয়। তবে কখন যে এই ঘটনা ঘটবে, তা জানেন না স্বয়ং বিজ্ঞানীরাও। তবে কিছু ধারণা বা হাইপোথিসিস আছে, সে ব্যাপারে পরে আসছি।

গরম পানি যে দ্রুত বরফে পরিণত হয়, এ ব্যাপারে অ্যারিস্টটল, ফ্রান্সিস বেকন ও গণিতবিদ রেনে দেকার্তেও বলে গেছেন। কিন্তু কেউ তেমন ব্যাখ্যা দিয়ে যাননি। তবে ঘটনাটা জোরালোভাবে প্রথম সামনে আসে ১৯৬০-এর দশকে। এক স্কুল ছাত্র বিষয়টা খেয়াল করে। নাম এমপেম্বা। বাসায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করে, ফ্রিজে রাখা আইসক্রিমের তুলনায় ঘরের কক্ষ তাপমাত্রার আইসক্রিম দ্রুত জমে যায়। চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন। তোমার হাতে ধরা আইসক্রিমটা ফ্রিজের তুলনায় দ্রুত জমে গেলে অবাক হওয়ারই কথা। যা হোক, এমপেম্বা বিষয়টা আবার পরীক্ষার জন্য আইসক্রিমের সঙ্গে পানি মেশাল। এবারও ফলাফল একই। এই ভুতুড়ে কাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যা না পেয়ে পরের দিন স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষকের কাছে কারণ জানতে চাইলেন। শিক্ষক জানালেন, এমপেম্বার পর্যবেক্ষণ বা তথ্যে কোনো ভুল আছে। কারণ, এমন ঘটনা অসম্ভব।

আরও পড়ুন

কিন্তু এমপেম্বা নিশ্চিত, তার তথ্যে কোনো ভুল নেই। একাধিকবার পরীক্ষা করে দেখেছে সে। তাই আগ্রহ নিয়ে গেলেন অধ্যাপক অসবর্নের কাছে। একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে। অধ্যাপক জানান, তিনি এ ব্যাপারে জানেন না। তবে নিরাশ করেনি এমপেম্বাকে। বিষয়টি পরীক্ষা করার কথা জানিয়ে এমপেম্বাকে বিদায় করেন। কিছুদিন পরে একটা ল্যাবে তিনি পরীক্ষা চালালেন। ছেলেটি যা বলেছিল, তাই ঠিক। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। বারবার পরীক্ষা করে পেলেন একই ফলাফল। ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক অসবর্ন এমপেম্বাকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। তারপর থেকে এই বিষয়টাকে বলা হয় এমপেম্বা ইফেক্ট।

শুরুতে বলেছিলাম, এই ইফেক্টের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে আছে কিছু ধারণা বা হাইপোথিসিস। এরমধ্যে একটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। সে জন্য তোমাকে বুঝতে হবে, পানি কীভাবে গরম হয়। আমাদের মায়েরা যখন হাড়িতে ভাত রান্না করে, তখন প্রথমে হাঁড়িটা আগুনের তাপে গরম হয়। তারপর হাঁড়ির তাপে গরম হয় পানি। যেহেতু হাঁড়ির নিচে আগুন জ্বলে, তাই প্রথমে হাঁড়ির নিচের পানি গরম হয়। আর পানি গরম হলে হালকা হয়ে যায়। তখন গরম হওয়া হালকা পানি ওপরের দিকে উঠে আসে, আর ঠান্ডা পানি নেমে যায় নিচে। এভাবে ঠান্ডা পানি নিচে যেতে যেতে গরম হতে থাকে। এই যে ঠান্ডা পানি নিচে যায় এবং নিচের গরম পানি ওপরে ওঠে, এতে একটা ছোট স্রোতের মতো তৈরি হয়। আর স্রোতের কারণে পানি ঠান্ডা হওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত ঘটে এবং দ্রুত জমে বরফে পরিণত হয়। কিন্তু ঠান্ডা পানিতে এমন কোনো স্রোত থাকে না। তাই পানি বরফ হতে সময় বেশি লাগে।

আরও পড়ুন

আরেকটা হাইপোথিসিস হলো, গরম পানির অণুগুলো তুলনামূলক বেশি দূরে থাকে। আসলে পানি গরম হওয়ার কারণেই বাড়ে এ দূরত্ব। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত হয় পানি। এই অণুগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে পানির ঘনত্ব কমে যায়। ফলে এসব অণুর মধ্যে সঞ্চিত শক্তি ছড়িয়ে যায়। এই শক্তি ছড়িয়ে যাওয়া বা নির্গত হওয়া মানেই পানি দ্রুত ঠান্ডা হয়। এ কারণে গরম পানি দ্রুত বরফে পরিণত হয়।

এই আলোচনার সবটাই পরীক্ষিত। বিজ্ঞানীরা ভুতুড়ে এই কাণ্ড নিয়ে গবেষণাও কম করেননি। তারপরেও যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তাহলে নিজেই একবার পরীক্ষা করে দেখ না! শুধু তো দুই বোতল পানিরই ব্যাপার, তাই না!

সূত্র: থটকো ডট কম, সায়েন্টিফিক আমেরিকান

আরও পড়ুন