কারও কারও শীত বেশি লাগে কেন
শীত বুঝি চলেই এল। সকাল-সন্ধ্যায় আবছা কুয়াশা পড়ে। অন্যদিকে ঠান্ডা বাতাস আর হিম সবাইকে গরম কাপড় পরতে উৎসাহ দিচ্ছে। রাস্তায় চোখে পড়ছে নানা রকম শীতের পোশাক পরা শিশু-কিশোর ও বয়স্ক মানুষ। দোকানে ক্রেতারা শীতের পোশাক নেড়েচেড়ে দেখছেন, কিনছেন।
এদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখলে মনে হবে, তাপমাত্রা বুঝি চলে গেছে হিমাঙ্কের নিচে। হিমাঙ্ক মানে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। পানি বরফ হয় যে তাপমাত্রায়। কেউ কেউ এত বেশি গরম কাপড় পরে বাইরে বের হচ্ছেন, দেখলে মনে হবে যেন জরুরি কাজে যাচ্ছেন তুষারঝড়ের মধ্যে।
এর উল্টোটাও আছে। পাতলা কোনো শার্ট গায়ে চাপিয়ে ঘুরছেন কেউ কেউ। যেন একদম শীত নেই। এত গরম কাপড় পরা মানুষ কেন দেখা যায়? কেন কিছু লোক খুব কম কাপড় পরেন শীতের দিনে? আসলে তাপমাত্রা যা-ই হোক, সবার সমান শীত লাগে না। কেউ কম, কেউ বেশি শীত অনুভব করেন। কারও জন্য একটা সোয়েটারই যথেষ্ট। কেউ আবার হাতে গ্লাভস, মাথায় কানটুপি, ইনার, জ্যাকেট বা ওভারকোট গায়ে চাপিয়েও দাবি করেন যে ঠান্ডা লাগছে তার। তাঁদের দাবি মিথ্যা নয়। ঠান্ডা সবার সমান লাগে না।
মানুষ উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণী হওয়ায় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পরিবেশের সঙ্গে তাদের শরীরের তাপমাত্রা কমে বা বাড়ে না। মানুষের শরীরের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা সাধারণত ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীরের তাপমাত্রা ব্যক্তির বয়স, কাজ, এমনকি দিনে কতটুকু সচল থাকে, তার ওপর নির্ভর করে।
কিছু মানুষকে দেখা যায় ঠান্ডা উপভোগ করতে। আবার কেউ ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অস্থির হয়ে যান। ঠান্ডা লাগার অনুভূতি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। শীতের সময়টুকু কাটিয়ে দেওয়ার জন্য শীতনিদ্রায় যায় কিছু প্রাণী। যেমন মেরু ভাল্লুক। অনেক সরীসৃপ শীতকালটুকু ঘুমিয়ে কাটায়, কখনো খাবারের অভাবে, কখনো বেঁচে থাকার স্বার্থে। তবে মানুষ শীতকালে জেগেই থাকে। যেকোনো আবহাওয়াজনিত পরিবর্তন ভালোভাবে টের পায়। বেঁচে থাকার জন্য টের পেতেই হয়। কারণ, তাপমাত্রার ছোট ছোট পরিবর্তন শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গ্রীষ্মে হিট স্ট্রোক বা শীতকালে হাইপোথারমিয়ার ঝুঁকি থাকে শুধু তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে।
উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর শরীরের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার কারণে তেমন ওঠানামা করে না। তবে ত্বক তাপ অনুভব করে এবং বাইরের তাপের বিপরীতে তাপমাত্রা স্থির রাখার চেষ্টা করে। বাইরের তাপমাত্রার ওঠানামা থেকে শরীরকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রথম প্রতিরোধ করে ত্বকের স্নায়ু। তাপমাত্রা পরিবর্তনের সংকেত গ্রহণ করে তথ্য পাঠায় মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক ত্বকে রক্ত চলাচল কমিয়ে দিতে রক্তনালিতে সংকেত পাঠায়। এই প্রক্রিয়া শরীরে তাপ কমে যাওয়া রোধ করে এবং শরীরকে রক্ষা করে। ত্বকে রক্তপ্রবাহ কমে গেলে আমরা কাঁপতে শুরু করি। অনৈচ্ছিক ও ছন্দময় পেশি সংকোচন (কাঁপুনি) শরীরকে উষ্ণ করতে তাপ ছেড়ে দেয়।
দেহের আকৃতির জন্য মানুষের ঠান্ডার অনুভূতি কমবেশি হতে পারে। শরীরপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল যত বড়, ঠান্ডায় শরীর তত বেশি তাপ হারায়। ত্বকের নিচে চর্বি বেশি থাকলে কম তাপ ছাড়ে শরীর।
নারী ও পুরুষের ঠান্ডার অনুভূতি শরীরের আকৃতির কারণে আলাদা হতে পারে। ধরা যাক, নারী ও পুরুষের শরীরে একই পরিমাণ চর্বি আছে। শরীরের আকৃতিও সমান। সে ক্ষেত্রে নারীর ওজন কম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, নারীর তুলনায় পুরুষের বডি ফ্যাট বা চর্বি ও হাড়ের ঘনত্ব বেশি থাকে। ফলে নারী দ্রুত তাপ হারায়। শীতও লাগে বেশি।
তবে শুধু এটাই নয়। শরীরের ঠান্ডা অনুভূতির পেছনে আরও নানা কারণ আছে। এখানে শুধু বিষয়টা বোঝার সুবিধার্থে সহজ করে বলা হয়েছে।
দেহের তাপ ধরে রাখা এবং ঠান্ডা অনুভব করার ক্ষমতা কমতে শুরু করে প্রায় ৬০ বছর বয়স থেকে। মধ্যবয়স্ক পুরুষের তুলনায় একই বয়সী নারীর ঠান্ডা কম লাগতে পারে। এর জন্য দায়ী তাদের হরমোনের পরিবর্তন। খেয়াল করলে দেখা যায়, ছোটরা ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করে। সে তুলনায় তাপমাত্রা কম না হওয়া পর্যন্ত কাঁপতে শুরু করেন না বয়স্ক ব্যক্তিরা। বয়স্কদের শরীর উষ্ণ হতেও সময় লাগে। তবে বয়স্কদের বিপাকীয় প্রক্রিয়া ধীরগতির হওয়ায় তীব্র ঠান্ডা ও বেশি গরম অনুভূত হতে পারে।
রেনোডস নামের একটি রোগ আছে। এই রোগ হলে হাত ও পায়ের আঙুলে ঠান্ডার অনুভূতি বেশি হয়। হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণেও ঠান্ডা বেশি অনুভূত হতে পারে। গলার মাঝামাঝি থাইরয়েড গ্রন্থি হরমোন তৈরি করে, শরীরের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। হরমোনের ক্ষরণ অনিয়মিত হলে বিপাক হয় ধীরে। ফলে ঠান্ডা অনুভূত হয়। রক্তে লোহিত কণিকা কম থাকলে বলে অ্যানিমিয়া। যাঁদের শরীরে রক্ত কম, তাঁদের বেশি ঠান্ডা অনুভূত হতে পারে।
তাই শরীরের তাপ ধরে রাখতে ঠান্ডার দিনে গরম কাপড় পরতে হবে। কারও ক্ষেত্রে বেশি বেশি কাপড় লাগবে, কারও অল্প কিছু পোষাকেই শীতের অনুভূতি কম হবে। তাই যাঁর যেমন অনুভূতি শীতের, তিনি তেমন পোশাকই পরবেন। এ ছাড়া তো উপায় নেই।