একটি তেলরাষ্ট্র কীভাবে কপ-২৯–এর আয়োজক হলো

তেল উত্তোলনের ওপর নির্ভর করে দেশটির অর্থনীতিছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

এবার কপ-২৯ অনুষ্ঠিত হবে আজারবাইজানের বাকুতে। আজারবাইজান এমন একটি দেশ, যার অর্থনীতি পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের জন্য প্রধানত দায়ী জীবাশ্ব জ্বালানি। জীবাশ্ব জ্বলানি থেকে বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, ঠিক এমন এক মুহূর্তে জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব পেল আজারবাইজান?

১১ নভেম্বর জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। ঠিক এ সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জলবায়ু ফান্ড কমিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়ে আলোচনায় আছেন তিনি। ফলে তৈরি হয়েছে জলবায়ু বিশৃঙ্খলা। গণতন্ত্রের চর্চা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এমন এক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে, যেখানে স্বাগতিক দেশ পরিচালিত হয় একজন স্বৈরাচারী সরকারের মাধ্যমে। আবার দেশটির অর্থনীতি প্রায় পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।

জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজনটি হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আমলারা কোথায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, সে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। এবার সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব রেখেছে রাশিয়া। রাশিয়ার গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই দেশটিও অনেকাংশে তেল বিক্রির ওপর নির্ভর করে।

ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ বছর পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের কোনো দেশে এই সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। তবে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে কোন সদস্যদেশ কপ-২৯ আয়োজন করবে, তা নিয়ে সবার একমত হওয়ার পরেই ঠিক হয়েছে জলবায়ু সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ।

কোন দেশে সম্মেলন হবে, তা ঠিক করা নিয়ে কয়েক মাস ধরে বিতর্ক চলেছে। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। যাদের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে বুলগেরিয়া, স্লোভেনিয়া ও মলদোভার মতো দেশ। এই দেশগুলো রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছিল। তাই এমন কোনো দেশকে আয়োজক হতে বাধা দিয়েছে রাশিয়া। এর বাইরে শেষ পর্যন্ত সম্ভাব্য আয়োজক হিসেবে ছিল আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। এই দুই দেশ আবার দশকের পর দশক ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল।

আরও পড়ুন

গত বছরের সেপ্টেম্বরে আজারবাইজান জোর করে আর্মেনিয়া–সমর্থিত নাগোরনো-কারাবাখ ছিটমহল পুনরুদ্ধার করেছে। হাজার হাজার আর্মেনীয় মানুষ আজারবাইজানের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তখন পালিয়ে গিয়েছিল। এসব কারণে এই দুই দেশ কপ-২৯ আয়োজনের ক্ষেত্রে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।

এরপর রাশিয়া দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করে। এই চুক্তি অনুযায়ী আজারবাইজানকে ৩২ জন যুদ্ধবন্দী ফিরিয়ে দেবে আর্মেনিয়া। বিনিময়ে আর্মেনিয়া আজারবাইজানের কপ-২৯ হোস্ট হওয়ার পথে বিরোধিতা বাদ দেবে।

এসব কারণে আজারবাইজান কপ-২৯ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেয়েছে এক বছরেরও কম। সাধারণত বেশির ভাগ আয়োজক দেশ এর চেয়ে বেশি সময় পায়। স্বাগতিক দেশ হিসেবে চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজারবাইজান সম্মেলন সফল করতে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেখানে একত্র হবেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদ ও জলবায়ুকর্মীরা।

আজারবাইজানের পরিবেশমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির সাবেক নির্বাহী মুখতার বাবায়েভ এবার সম্মেলনের সভাপতি। তিনি জুলাই মাসে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘গ্রিন ট্রানজিশনে আমরা খুব পরিচিত না’। কারণ, আজারবাইজানের রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই তেল ও গ্যাস।

আয়োজক শহর বাকুর কাছেই একটি স্টেডিয়ামে সাজানো হয়েছে কপ-২৯–এর ভেন্যু। এই শহরে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোকের থাকার জায়গা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো কাজটি করা হয়েছে তেল বিক্রির টাকা দিয়ে। তুলনামূলকভাবে ছোট শহরে হচ্ছে এই বড় আয়োজন। এ শহরে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় ফর্মুলা ওয়ান গ্রাঁ প্রি। যেখানে শহরের আশপাশের রাস্তাগুলোকে রেসট্র্যাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এই স্টেডিয়ামের কাছেই তেল উত্তোলন খনি থেকে সারাক্ষণ তেল উত্তোলন করা হয়। এক মাইলেরও কম দূরের একটি তেল শোধনাগার প্রতিনিয়ত মিথেন পোড়ায়। মিথেন সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে একটি। আজারবাইজানের কাসপিয়ান সাগরের তীরবর্তী অসংখ্য তেল খননের প্ল্যাটফর্ম সারাক্ষণ তেল তোলে।

এই জীবাশ্ম জ্বালানির বেশির ভাগ অংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপের পশ্চিম অংশে পাঠানো হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপ নিজেদের ব্যাংকগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই সময়ে ইউরোপে ব্যবহার হচ্ছে আজারবাইজানের গ্যাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশা, তাঁরা তেল গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা দিলেও অন্যরা পাইপলাইন সম্প্রসারণে অর্থায়ন করবে।

ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের জলবায়ুবিশেষজ্ঞ ডেভিড ওয়াসকো বলেছেন, ‘অস্বাভাবিক কারণে আজারবাইজান এ বছরের হোস্ট হয়েছে। তবে এ সম্মেলনে জলবায়ু সংকটের মূলে থাকা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

আজারবাইজানের বাকুতে জলবায়ু সম্মেলন চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন