টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার
হাউ আই ওন্ডার হোয়াট ইউ আর…
ছোটবেলায় তোমরা সবাই কমবেশি এই ছড়াটা পড়েছ বা শুনেছ। লিটল স্টার বলতে এখানে তারা বা নক্ষত্রকে বুঝিয়েছে। তবে নক্ষত্রকে কিন্তু বলা হয়েছে ছোট। আসলেই তো, রাতের আকাশে যে তারা দেখা যায়, তা তো ছোটই। ধরে আনতে পারলে একসঙ্গে অনেকগুলো পকেটে পুরে রাখা যাবে, এমন মনে হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই? তারা কি এতই ছোট?
তবে ছড়ার কথা বিশ্বাস কিন্তু কোরো না। সাহিত্যে লেখকেরা কল্পনা করে যা খুশি লিখতেই পারে। কিন্তু তার সব তো আর সত্যি হয় না। এই যেমন ধরো, চাঁদকে কত উপমা দিয়ে লেখা হয়েছে শতসহস্র গল্প, উপন্যাস, কবিতা। বলা হয়েছে, চাঁদের নাকি কলঙ্ক আছে! কিন্তু ওসব সাহিত্যে। বিজ্ঞানে এসবের জায়গা নেই। নিখুঁত প্রমাণ না পেলে বিজ্ঞান তা বিশ্বাস করে না। তাহলে আসল সত্যিটা কী?
নক্ষত্র আসলে অত্যন্ত গরম। গ্যাসের তৈরি উজ্জ্বল বলের মতো। রাতের আকাশে তাকালে তুমি অগণিত নক্ষত্র দেখতে পাবে। কিন্তু তা দেখে বুঝতে পারবে না, ওগুলো আসলেই গরম কি না। আচ্ছা বলো তো, দিনের আলোয় কি নক্ষত্র দেখা যায়? অবশ্যই দেখা যায়। দিনের আলো আসে তো একটি নক্ষত্র থেকেই। বুঝতে পারলে না? সূর্যের কথা বলছি। সূর্যও একটি নক্ষত্র। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। আর সূর্য থেকে আলো আসে বলেই পৃথিবীতে দিন হয়।
এখন তোমার মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, রাতের আকাশের নক্ষত্রকে এত ছোট দেখালেও, সূর্যকে তো বড় দেখায়। কারণ কী? সূর্যকে একটু বড় দেখার কারণ দূরত্ব। তুমি কখনো স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখলে এটা বোঝার কথা। স্টেডিয়ামের ওপরে দিক থেকে খেলা দেখলে সব খেলোয়াড়কে দেখতেই ছোট লাগে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে। মাঠে খেলোয়াড়দের ছোট দেখায় দূরত্বের কারণে। আবার তুমি একটি ১৫ বা ২০ তলা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে নিচের দিকে তাকালেও মানুষকে ছোট দেখবে। কারণ, ওই দূরত্ব।
এবার মূল কথায় আসি। পৃথিবী থেকে সূর্য কত দূরে? গণিতের ভাষায় দূরত্বটা প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্ব কতটা দূরে তা কি কল্পনা করতে পারছ? আরও একটু সহজ করে বলি। ধরো তোমার একটি গাড়ি আছে। গাড়িটি কোনো বিশ্রাম ছাড়াই টানা ২৪ ঘণ্টা চলতে পারে। ঘণ্টায় যেতে পারে ১০০ কিলোমিটার। এই গাড়ি নিয়ে সূর্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১০৬ বছর। বোঝো তাহলে, সূর্য কত দূরে!
তবে পৃথিবী সূর্যের কাছাকাছি না থেকে কিন্তু ভালোই হয়েছে। সূর্য আরও কাছে থাকলে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত। পৃথিবী আরও গরম হতো সূর্যের তাপে। সূর্যপৃষ্ঠ কিন্তু খুব গরম। এর বায়ুমণ্ডল আরও বেশি গরম। তবে সবচেয়ে গরম সূর্যের কোর বা কেন্দ্র। তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৃথিবীতে মাত্র ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলেই আমাদের বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যায়। হাঁসফাঁস করতে থাকে মানুষ।
পৃথিবী থেকে সূর্যমামাকে ছোট দেখালেও এটি কিন্তু আসলে অনেক বড়। কত বড়, তার একটা ধারণা দিই। পৃথিবী থেকে সূর্য প্রায় ১০০ গুণ প্রশস্ত। তবে এটাই কিন্তু মহাবিশ্বের বড় নক্ষত্র নয়। সূর্যের চেয়েও ১০০ গুণ বড় নক্ষত্র মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার সূর্যের চেয়ে ১০ গুণ ছোট নক্ষত্রও আছে। কিন্তু আমরা এখানে শুধু সূর্য নিয়েই কথা বলব আজ। সূর্য কত বড়, সেটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
প্রথমে একটু গাণিতিক কথা বলি। সূর্যের ব্যাস ১৩ লাখ ৯২ হাজার কিলোমিটার। ব্যাস কি জানো তো? একটি বৃত্তের মাঝবরাবর এক পাশ থেকে অন্য পাশে একটি রেখা টানলে সেই রেখাটি হবে ব্যাস। অর্থাৎ মাঝামাঝি সূর্যের এক পাশ থেকে আরেক পাশের দূরত্ব ১৩ লাখ ৯২ হাজার কিলোমিটার। পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের ব্যাস ১০৯ গুণ বেশি।
একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে কথাগুলো, তাই না? আরেকটু সহজ করে বলি। সূর্যের মধ্যে ১৩ লাখ পৃথিবী এঁটে যাবে অনায়াসে। আগে যে ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়ির কথা বলেছিলাম, ওটায় চড়ে সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে সময় লাগবে ৫ বছর। আর তুমি যদি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার হেঁটে সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে চাও, তাহলে ১০০ বছর লাগবে। বুঝতে পারছ, সূর্য কত বড়! কিন্তু সূর্য মামা আমাদের থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে ওইটুকু মনে হয়।
এ রকম বড় সূর্যের বয়স কত জানো? ৪৫০ কোটি বছর। সূর্য এখন আছে মাঝবয়সে। এই বয়সে এসে সূর্য হলুদ রং ধারণ করেছে। ফল যেমন কাঁচা থাকলে এক রকম রং থাকে, আবার পাকলে রং পরিবর্তন হয়, অনেকটা সে রকম। আমাদের সূর্য বাঁচবে আরও প্রায় ৫০০ কোটি বছর। আর শেষ বয়সে সূর্যের রং পরিবর্তন হয়ে ধীরে ধীরে লাল হবে। তারও কয়েক শ কোটি বছর পরে এটি লাল রং পরিবর্তন করে পরিণত হবে সাদা বামনে।
তবে তোমাদের একটা কথা জানিয়ে রাখি। সূর্য একটা সাধারণ নক্ষত্র হলেও এর কিছু বিশেষ গুণ রয়েছে। কী সেই গুণ?
সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে সৌরজগতের সবকিছু একত্রে আছে। মানে একটা থেকে আরেকটা ছিটকে দূরে চলে যায় না। পৃথিবী যেমন চাইলে সূর্যের থেকে সরে যেতে পারে না। আবার সূর্যের তাপে পৃথিবী উষ্ণ থাকে। সূর্যের তাপ না পেলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অসম্ভব হতো। সূর্যের আলো না পেলে কোনো উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করতে পারত না। জানো তো, উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করে। উদ্ভিদের খাওয়ার পরে যে খাবার রয়ে যায়, সেগুলো আমরা পাই ফল হিসেবে। তাই উদ্ভিদ যদি খাদ্য তৈরি করতে না পারে, তাহলে আমরাও খেতে পাব না। উদ্ভিদ ছাড়া আমরা অক্সিজেনই-বা কোথায় পাব? ফলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে উদ্ভিদের গুরুত্ব অপরিসীম। আর উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রাখতে সূর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আচ্ছা তুমি কি বলতে পারো, সূর্যের নিকটতম প্রতিবেশী কারা? সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ। কিন্তু সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র কোনটি? নামটা হয়তো তোমাদের কাছে নতুন লাগতে পারে। প্রক্সিমা সেন্টুরাই। দূরত্ব প্রায় ৪ আলোকবর্ষ। আলোকবর্ষ জিনিসটা কী, জানো তো?
আমরা যেমন দূরত্ব পরিমাপ করার জন্য মাইল, কিলোমিটার বা মিটার ব্যবহার করি, এটাও তেমনি দূরত্ব পরিমাপের একটি একক। তবে বেশি দূরত্ব পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয় আলোকবর্ষ। এক আলোকবর্ষ মানে, আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, সেই দূরত্ব। জানো নিশ্চয়ই, আলো ১ সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার যেতে পারে। এবার ভাবো ১ মিনিটে আলো কতটা দূরত্ব যায়। তারপর বের করতে হবে এক ঘণ্টায় যায় কতটা। হিসাবে এখনো শেষ হয়নি। এক ঘণ্টার হিসাব বের করে তার সঙ্গে গুণ করতে ২৪। কারণ, ২৪ ঘণ্টায় এক দিন হয়। এবার এতক্ষণ যে গুণফল বের করেছ, তার সঙ্গে ৩৬৫ গুণ করলে পাবে এক আলোকবর্ষ। যাই হোক, সূর্য থেকে সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টুরাইয়ের দূরত্ব ৪ আলোকবর্ষ।
সূর্য যে অনেক গরম, তা আগেই বলেছি। এমন গরম সূর্যের আশপাশে কি কোনো মহাকাশযান পাঠানো সম্ভব? উত্তর, হ্যাঁ। ভাবতে পারো, সূর্যের কাছে গেলেই তো সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তাহলে সেখানে যাবে কীভাবে? সে ব্যবস্থাও আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০১৮ সালে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাঠায় পার্কার সোলার প্রোব নামে একটি নভোযান। এটি সূর্যের বায়ুমণ্ডলের পাশ দিয়ে ঘুরছে। নভোযানে এমন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে নভোযানের কোনো ক্ষতি হয়নি। বড় হলে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে তোমরা আরও ভালোভাবে জানতে পারবে।
সূত্র: নাসা