আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, দুধ আর আনারস একসঙ্গে খাওয়া যায় না। লোকে বলে, দুধ আর আনারস একসঙ্গে মেশালে বিষ হয়। দুধ খেয়ে আনারস খেয়ো না বা আনারস খেয়ে দুধ খেয়ো না, এই রকম পরামর্শ আমরা অনেক শুনেছি। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এমনটা দেখা যায় মাঝেমধ্যে। হয়তো সেটা তোমারও চোখে পড়েছে। কিন্তু আসলে কি তা–ই? একসঙ্গে দুধ ও আনারস খেলে কি শরীরে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে? বিজ্ঞান কী বলে এ ব্যাপারে?
হেলথলাইন ডট কমে এ নিয়ে গবেষণার ফলও প্রকাশ করা হয়েছে। তারা দুধ আর আনারস গিনিপিগদের খাইয়েছে। কোনো ক্ষতি হয়নি। তারা শেষ সিদ্ধান্তে এসেছে, দুধ আর আনারস একসঙ্গে হলে কোনো রকমের বিষক্রিয়া হয় না।
যেহেতু আনারস ও দুধ একসঙ্গে খেলে কোনো সমস্যা হয় না, তাহলে গুজব চালু হলো কীভাবে? এ ব্যাপারে বারডেমের সাবেক প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার একটি প্রচলিত লোককাহিনির কথা বলেছেন। কাহিনিটা অনেকটা এ রকম—আনারস সাধারণত ঝোপঝাড়ের মধ্যে হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় আনারস লাগালেও পাশাপাশি অনেকগুলো আনারস গাছ থাকলে মনে হয় ঝোপের মতো। সেই ঝোপের মধ্যেই একবার এসে বসে একটি বিষধর সাপ। কোনোভাবে সেই সাপ আনারসের গায়ে বিষ ঢেলে দেয়। তারপর কেউ একজন সেখান থেকে আনারস কেটে নিয়ে যান নিজের বাড়িতে। আনারস খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীর বিষাক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা টের পাননি। এরপর মনের সুখে এক গ্লাস দুধও খান। কিন্তু ততক্ষণে বিষের প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। দুধ খাওয়ার দুই–এক মিনিটের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আনারস খেয়ে দুধ খাওয়ার কারণে তিনি মারা গেছেন। এভাবে মুখ থেকে মুখে ঘুরে ঘুরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
কিন্তু এই লোককাহিনি কতটা সত্য, তা এখন আর নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে দুধ ও আনারস একসঙ্গে খেলে শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মৃত্যু হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
আবার কারও যদি ‘ল্যাকটোজ ইন টলারেন্স’ থাকে, তাহলে সমস্যা হতে পারে। দুধের একটি মূল উপাদান ল্যাকটোজ। অনেকের পাকস্থলী ল্যাকটোজ পরিপাক করতে পারে না। তাই দুধ খেলে বমি হতে পারে। আর যদি এর আগে-পরে ঘটনাক্রমে আনারস খায় কেউ, তাহলে তো কথাই নেই। মনে হবে, দুধ-আনারসের জন্যই দুর্ভোগ! হয়তো কোনোকালে কারও দুধ-আনারসে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। হয়তো তার ছিল ল্যাকটোজ ইন টলারেন্স। চিকিত্সকদের ধারণা, এ রকম কোনো ঘটনা থেকে ‘দুধ-আনারসের’ বিষক্রিয়ার কল্পকাহিনি চালু হয়ে থাকতে পারে।
আসলে দুধ একটি আদর্শ খাবার। এতে থাকে প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট। তাই যেকোনো মানুষের জন্য দুধ উপকারী। এক কাপ গরুর দুধে প্রায় ১৪৯ ক্যালোরি শক্তি, ৮ গ্রাম প্রোটিন, ৮ গ্রাম ফ্যাট ও ১২ গ্রাম কার্ব থাকে। আর আনারসে থাকে প্রচুর ভিটামিন সি। পাশাপাশি আরও থাকে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস। এখন কারও কারও দুধ সহ্য হয় না, সেটা আলাদা ব্যাপার। কারও কারও আনারসও সহ্য না–ও হতে পারে।
কিন্তু দুধ ও আনারসের মিথস্ক্রিয়ায় আসলে কী হয়? দুটি জিনিস হতে পারে। এক, দুধ পরিণত হতে পারে দধিতে; কিংবা দুই, দুধ খেতে তেতো লাগতে পারে। দুধ ও আনারস মিশিয়ে খেলে অবশ্য পেটব্যথা হতে পারে। কারণ, আনারসে থাকে প্রচুর আঁশ, এ কারণে অ্যাসিডিটির সমস্যাও হতে পারে পেটে। কিন্তু এর সঙ্গে দুধের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু আনারস খেলেও পেটে ব্যথা করতে পারে।
আনারসে থাকে ব্রোমেলাইন। এটা একধরনের এনজাইম। এই এনজাইমের প্রভাবে প্রোটিন ভেঙে যায়। এর ফলে আনারসের সঙ্গে দুধ মেশালে একটু তেতো লাগে। তবে আনারসকে যদি গরম করে দুধের সঙ্গে মেশানো হয়, তাহলে আর তেতো লাগবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুধ আর আনারস মিশিয়ে খাওয়ায় কোনো অসুবিধা নেই। বরং আনারস আর দুধ মিশিয়ে মিল্কশেক বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
তবে তুমি যদি দুধের মধ্যে আনারস দাও, তাতে দুধ ফেটে ছানা পড়ে যেতে পারে। দুধ আর আনারস মিশিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখো, দুধ পচে যেতে পারে। আর দুধ আর আনারস মিশিয়ে খেলে স্বাদটা তোমার ভালো না–ও লাগতে পারে।
দুধ–আনারসের শেক বানানোর জন্য ঠান্ডা আনারসের সঙ্গে ঠান্ডা দুধ মিশিয়ে নিলে আর ছানা হয়ে যাবে না। দুধ আর আনারস ডাল-ভাতের মতোই একটা নিরাপদ খাবার।
সূত্র: বিজ্ঞানচিন্তা