যানজটে নাকাল আমস্টারডামকে যেভাবে বাঁচাল সাদা সাইকেল
ষাটের দশকে লুদ শিমেলপেনিংক নামের এক লোক বাস করতেন নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। দূষণ এবং গাড়ির ধোঁয়া নিয়ে তাঁর ছিল ভীষণ দুশ্চিন্তা। দূষণ ঠেকানোর জন্য এক বুদ্ধি বের করলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পনার নাম ‘সাদা সাইকেল’। পৃথিবীতে নিয়ে এলেন নতুন ধারণা। শুধু সাইকেলে সাদা রং করে বিশ্বে গণপরিবহনে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন লুদ।
বিষয়টি খুব সাধারণ। একটি পুরোনো সাইকেল নিন। সাদা রং করুন। শহরের যেকোনো জায়গায় রেখে দিন। মানুষকে সাইকেলটা বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে বলুন। কাজ শেষ। সাইকেল শেয়ারিংয়ের ধারণাটা এভাবেই এসেছিল। ১৯৬০-এর দশকে আমস্টারডামে, লুদ শিমেলপিংকের হাত ধরে।
সমাজকে আমূলে বদলে দিতে চায় একদল ডাচ মাঠে নামিয়ে ফেলে পরিকল্পনাটি। তাদের আন্দোলন নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে মানুষকে। খুঁজে পাওয়া যায় বিশ্বজুড়ে গণপরিবহনের দূষণের সমস্যা সমাধানে নতুন পথ। পৃথিবীর বহু শহর এখন সাইকেলবান্ধব। সাইকেল শেয়ারিংব্যবস্থা আছে শত শত শহরে। ঢাকাতেও চালু হয়েছিল এমন ব্যবস্থা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জো বাইক নামের সাইকেল শেয়ারিংব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। সাদা সাইকেল বিপ্লবের উত্তরসূরি এরা সবাই। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাদা সাইকেল তালা খুলে রাখা হয়েছিল। নিজের যাতায়াতের প্রয়োজনে যে কেউ ব্যবহার করতে পারত।
ষাটের দশকে আমস্টারডামে নগরায়ণ হচ্ছিল বেশ দ্রুত। শহরের আকার অল্প সময়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। মানুষ বেড়ে যাতায়াতে একরকম ভজকট লেগে যায়। ঢাকার কথা মনে পড়ছে? ঢাকায় যেমন সব গাড়ি সিগন্যাল ছাড়লে একসঙ্গে হুড়মুড় করে যাওয়ার চেষ্টা করে, পরে সব কটি জট পাকিয়ে আটকে থাকে, আমস্টারডামও তেমন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
এ জন্য ওই শহরে নিয়ম করা হয়েছিল, শহরের এক পাশে ‘ক্যারেজ স্কোয়ারে’ গাড়ি রেখে মানুষ হেঁটে নিজের গন্তব্যে যাবে। তাদের গাড়ি থাকবে ক্যারেজ স্কয়ারে। পরিবর্তনকামী দল প্রোভো ঠিক এটাই চেয়েছিল। গাড়িগুলো শহরের বাইরে ক্যারেজ স্কয়ারে রেখে সাদা সাইকেল চালিয়ে লোকে গন্তব্যে যাবে।
প্রোভোর একজন সদস্য স্টলক ডুইজ। এক সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘আমরা তরুণ ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমরা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারব। সাদা সাইকেলটি ছিল বাড়তে থাকা গাড়ির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ।’
আমস্টারডামের মূল সমস্যাগুলোর একটি ছিল গাড়ি। ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বায়ুদূষণ আর শিশুদের নিরাপদে রাস্তায় খেলতে না পারা বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে। উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য ডুইজ তাঁর দাদার পুরোনো সাইকেলটি সাদা রং করে তাতে চেপে বিয়ে করেছিলেন। শহরে বেশ সাড়া ফেলেছিল এই ঘটনা। সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনা ফলাও করে ছাপে। বিয়ের পর সাইকেলটি তিনি শহরে ছেড়ে দেন।
এই উদ্যোগ অনেক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু বেশি দিন টিকতে পারেনি। সাইকেলগুলো পুলিশ দ্রুত সরিয়ে ফেলে। তারা প্রোভোর এনার্কিস্ট দলের উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখেনি।
প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে কয়েকটি সাইকেল সাদা রং করা হয়েছিল। তখন উদ্যোগ আর এগোয়নি। দুই বছর পর লুড শিমেলপেনিংক আমস্টারডাম সিটি কাউন্সিলের সদস্য হন। তখন বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা লেগে যায়। তিনি কাউন্সিলে প্রস্তাব করেন, আমস্টারডাম পৌরসভা শহরে ১০ হাজার সাদা সাইকেল বিনা মূল্যে ব্যবহারের জন্য নামাবেন। যেন সবাই যাতায়াতে ব্যবহার করতে পারেন। ভালোভাবে তিনি হিসাব করে দেখিয়েছিলেন, একটি সাদা সাইকেল ব্যবহার করলে জনপ্রতি প্রতি কিলোমিটারের জন্য পৌরসভার খরচ হবে, সেই সময়ের প্রতি কিলোমিটারে জনপ্রতি গণপরিবহনের তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ।
আমস্টারডাম কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলেছিল, সাইকেল জিনিসটি পুরোনো দিনের। আধুনিক বাহন হলো গাড়ি। গাড়ির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। শিমেলপেনিংক মনে মনে হাসলেও দমে যাননি।
বৈদ্যুতিক গাড়ি উইটকারেন
এরপর তিনি ছোট একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি শেয়ার করার একটি সিস্টেম তৈরি করেছিলেন, যা উইটকারেন নামে পরিচিত। কিন্তু একটিমাত্র স্টেশন এবং চারটি বৈদ্যুতিক গাড়ি মিলে ছিল এই সিস্টেমে। এই গাড়ি ব্যবহার করে প্রতি মাইল যাতায়াতের জন্য অল্প খরচ দিয়ে সদস্য হতে হতো। পুরো বিষয়টি চলছিল একটি কম্পিউটার সিস্টেম ব্যবহার করে।
শুরুর দিকে উইটকারেন কোনো ভুল করে কি না, দেখার জন্য উইটকারেনের পেছনে পেছনে পুলিশ গাড়ি চালাত। রাতে এই গাড়িগুলো গির্জায় পার্ক করা হতো। ভয় ছিল, গাড়িগুলো চুরি হয়ে যাবে। উদ্যোগ সফল করার জন্য কমপক্ষে ২৫টি স্টেশনের নেটওয়ার্ক দরকার ছিল। শেষ পর্যন্ত টাকা জোগাড় করা যায়নি। উদ্যোগও সফল হয়নি। তবে ১০ বছর ধরে রাস্তায় উইটকারেন ছিল। সিস্টেম কাজ করে, এটি ছিল তার প্রমাণ।
নতুন রূপে সাইকেল শেয়ারিং
শিমেলপেনিংক কখনো সাইকেল শেয়ারিংয়ে বিশ্বাস হারাননি। নব্বইয়ের দশকে ডেনমার্কের দুজন লোক কোপেনহেগেনে একটি পদ্ধতি চালুর জন্য তাঁর সাহায্য চেয়েছিলেন। এভাবে শুরু হয় বিশ্বের প্রথম বড় আকারে সাইকেল শেয়ারিং সুবিধা। সাইকেল নেওয়ার সময় একটি কয়েন জমা দিতে হয়। ফেরত দেওয়ার সময় কয়েন ফেরত দেওয়া হয়। অনেক সাইকেল চুরি হয়েছিল এই সিস্টেমে। কারণ, কোনো রেজিস্ট্রেশন ছিল না। ছোটখাটো ভুল হলেও পুরো প্রকল্প সফল ছিল। মানুষ গ্রহণ করেছিল।
ডেনমার্কে সফল হওয়ার পর শিমেলপেনিংক নেদারল্যান্ডসে আবার ভাগ্য যাচাই করার চেষ্টা করলেন। তিনি ডাচ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। কারণ, তখন মানুষ পরিবেশ ও জলবায়ুর ব্যাপারে আরও সচেতন। তাই ১৯৯৯ সালে আমস্টারডামে একটি নতুন সাইকেল শেয়ারিং সুবিধা চালু হলো। এবারও সাইকেলের রং সাদা থাকছে। তবে বিনা মূল্যে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। প্রতিবার ব্যবহারে এক গিল্ডার খরচ করতে হতো। একটি ডাচ-ব্যাংক চিপ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করার সুবিধা দেয়। কার্ডের মাধ্যমে সাইকেলের লক খোলা যেত। ২৫০টি সাইকেল দিয়ে এটি শুরু হয়। পাঁচটি স্টেশনে সাইকেল পাওয়া যেত। তবে আগের মতোই একটা সমস্যা থেকেই যায়। লক ভেঙে সাইকেল চুরি। প্রতি সপ্তাহে এক-দুইটি সাইকেল হারিয়ে যাচ্ছিল। একসময় ব্যাংক কার্ড দেওয়া ও টাকা জমা নেওয়ার চুক্তি থেকে সরে আসে। কারণ প্রকল্পটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক ছিল না।
এই পর্যায়ে শিমেলপেনিংক হতাশ ছিলেন। তবে বেশি দিন নয়। ২০০২ সালে তিনি ফরাসি বিজ্ঞাপন করপোরেশন জেসি ডিকক্স থেকে একটি ফোনকল পান। তারা ভিয়েনায় সাইকেল শেয়ারিং শুরু করতে চায়। সাইকেল শেয়ারিং ভিয়েনায় সফল হয়। এরপর লিয়নে চালু হয়। ২০০৭ সালে প্যারিসে শুরু হয়। সাইকেল শেয়ারিংয়ের ইতিহাসে প্যারিস একটি সফল উদাহরণ।
প্যারিসবাসী সাইকেল শেয়ারিং ধারণাকে খুব পছন্দ করেন। বর্তমানে ২০ হাজার শেয়ারিং সাইকেল আছে প্যারিসে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন শহরে একই ধরনের সাইকেল শেয়ারিং চালু হতে থাকে। শিমেলপেনিংক সাইকেল শেয়ারিংয়ের এই ধারণাকে সব সময় উন্মুক্ত রেখেছেন। পেটেন্ট করেননি। ব্যক্তিগত লাভের জন্য এটি ব্যবহার করেননি।
২০১৪ সালের শেষে বিশ্বে শেয়ার্ড সাইকেল ছিল প্রায় এক মিলিয়ন। চীন ২৩৭টি শহরে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি সাইকেল নিয়ে সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল। ফ্রান্সের ৩৮টি শহরে প্রায় ৪৩ হাজার সাইকেল আছে৷ ব্রিটেনে ১১ হাজার সাইকেল শেয়ারিং হয়। এখন এসেছে ইলেকট্রিক সাইকেল।
২০১৬ সালে আমস্টারডামের মোট যাতায়াতের প্রায় ৩৮ শতাংশ সাইকেল ব্যবহার করা হয়েছে। পরের অবস্থানে আছে কোপেনহেগেন। এই দুই শহর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সাইকেলবান্ধব রাজধানী হিসেবে সম্মানিত।