বিড়াল ভালোবাসে অনেকেই! নরম লোমের তুলতুলে শরীর নিয়ে ছোট্ট প্রাণীটি যখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, ইচ্ছা করে কোলে তুলে নিয়ে খুব আদর করে দিই। আবার যখন মিউ মিউ করে ডাকতে থাকে, তখন তার গলায় সুড়সুড়ি দিয়ে ভাব জমানোর সাধও জাগে মনে।
তবে তোমার-আমার কাছে বিড়ালকে শুধু তার বিড়ালসত্তার জন্য খুব ভালো লাগলেও প্রাচীন মিসরে তারা পেত দেবতাতুল্য সম্মান!
ঠিক কী কারণে নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা সভ্যতাটি এতটা বিড়ালভক্ত ছিল, সেটাই বরং বলি আর কথা না বাড়িয়ে।
সঙ্গী হিসেবে বিড়ালের উপযোগ
শুরু থেকেই হয়তো মিসরীয়রা বিড়ালকে দেবতার মর্যাদা দেয়নি, বরং শুরুতে তারা বিড়ালকে বেছে নিয়েছিল তাদের উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে। এর পেছনে যেসব কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিড়ালের উপকারী স্বভাব।
কী উপকার করত বিড়াল? খুব সহজ ব্যাপারটা। গ্রীষ্মের দাবদাহে বিড়ালেরা আশ্রয় নিত মানুষের ঘরে এবং তার প্রতিদানস্বরূপ তারা ধাওয়া করে তাড়াত বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রাণী ও পোকামাকড়। বিশেষ করে বিড়ালের ভয়ে মানুষের গৃহে প্রবেশ করতে ভয় পেত বিষধর সাপ ও কাঁকড়াবিছা। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বিড়াল হয়ে ওঠে মানুষের অতি উপকারী গৃহপালিত প্রাণী।
বিড়াল ছিল পরকালেরও সঙ্গী
পার্থিব জীবনের সঙ্গী হিসেবে নিজের উপযোগ প্রমাণের পর বিড়াল পেয়েছিল মানুষের পরকালের সঙ্গী হওয়ারও সম্মান। তখনকার দিনে মানুষ চাইত তাদের কবরে যেন সেই সব ঘটনার প্রতিফলন ঘটে, যেগুলো তারা জীবিত অবস্থায় উপভোগ করত। তাই মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে কবরে যেত তাদের অর্জন করা বিভিন্ন পদক, পুরস্কার এবং তাদের জীবনের উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনার ছবি। সেসব ছবিতে যেমন তাদের পরিবারের সদস্য ও প্রিয় মানুষেরা জায়গা পেত, তেমনই অনেক সময় ঠাঁই হতো তাদের পোষা বিড়ালেরও।
তবে কবরে বিড়ালের উপস্থিতি যে কেবল অঙ্কিত বা খোদাই করা ছবিতেই সীমাবদ্ধ থাকত, তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো, এমনকি বিড়ালকে মমি বানিয়েও মৃত্যুর পর কবরে নিয়ে যেত অনেকে। এ ক্ষেত্রে কবরে বিড়ালের সঙ্গ পাওয়ার পাশাপাশি আরেকটি চিন্তাও খেলা করত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনে। তারা ভাবত, কবরে যদি একটি বিড়ালের মমি রাখা হয়, পরে কোনো একসময় হয়তো মৃত ব্যক্তি ওই মমি করা বিড়ালের দেহ দখল করতে পারবে এবং পেয়ে যাবে মৃত্যুর পর এক নতুন জীবন।
বিড়াল ছিল রাজরাজড়াদেরও পছন্দ
ইতিহাসের অনেক সভ্যতা ও সংস্কৃতিতেই একসময় ছিল রাজা-বাদশাহ, ধনকুবের ও প্রভাবশালীদের পদাঙ্ক অনুসরণের চল। এমনকি বর্তমান সময়েও অনেক জায়গায় এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বলাই বাহুল্য, প্রাচীন মিসরের মানুষও এই প্রবণতার বাইরে ছিল না। সমাজের শীর্ষ আসনে আসীন ব্যক্তিরা যা করতেন, সাধারণ মানুষও করত সেই একই কাজের অন্ধ অনুকরণ।
মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন মিসরের তৎকালীন শাসকেরাও বিড়ালকে খুবই পছন্দ করতেন। তাই সাধারণ মানুষের মনেও এমন ধারণার জন্ম হয় যে বিড়াল পোষা বুঝি একটি রাজকীয় গুণ!
প্রাচীন মিসরের রাজা বা ফারাওরা চাইতেন বিড়ালের মাধ্যমে নিজেদের রাজকীয়তা ও ক্ষমতার জাঁক প্রদর্শন করতে। তাই তাঁরা পুষতেন বিশালকায় একেকটি বিড়াল। সেসব বিড়ালকে আবার পরাতেন স্বর্ণখচিত পোশাক ও অলংকার। এতটাই ভালোবাসতেন নিজেদের বিড়ালকে যে নিজেদের থালা থেকেও বিড়ালকে খাবার খেতে দিতেন।
সমাজের শীর্ষ পর্যায়ে বিড়ালের এতটা কদর প্রভাবিত করে সাধারণ মানুষকেও। তারা হয়তো নিজেদের বিড়ালকে সোনা-রুপার পোশাক পরাতে পারত না, দিতে পারত না চকচকে অলংকার। কিন্তু তারপরও নিজেদের সাধ্যে যতটুকু কুলায়, তাই দিয়েই চেষ্টা করত বিড়ালকে সাজানোর, দৃষ্টিনন্দন করে তোলার।
প্রশংসিত হতো বিড়ালের অন্য গুণাবলিও
মানুষের ঘরকে ইঁদুর, সাপ, কাঁকড়াবিছা প্রভৃতি থেকে সুরক্ষিত তো রাখতই, এ ছাড়া বিড়ালের আরও বিভিন্ন গুণবাচক বৈশিষ্ট্যও সমাদৃত হতো। প্রধানত প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে বিড়ালের যে গুণ খুব ভালো লাগত, তা হলো সব আকারের বিড়ালই ছিল বিচক্ষণ, ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ও শক্তিশালী।
তা ছাড়া প্রাচীন মিসরের মানুষ বিড়ালের আরেকটি ক্ষমতাকেও খুব সমীহ করত, সেটি হলো বিড়ালের উর্বরতা। প্রতিবার গর্ভবতী হলেই যে বিড়াল একাধিক সন্তানের জন্ম দিত, বিষয়টিকে খুব তাৎপর্যমণ্ডিত মনে করা হতো। তাই বিড়াল যখন কোনো নারীর বসে থাকা চেয়ারের নিচে গিয়ে বসত, সেটিকে সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভাবা হতো, ওই নারীও বুঝি বহু সন্তানের জননী হতে পারবে।
দেবতাদের বিড়াল-অবতার গ্রহণ
যেমনটি আগেই বলেছি, শুরু থেকেই প্রাচীন মিসরীয়রা বিড়ালকে দেবতাতুল্য মর্যাদা দিত না। কিন্তু ক্রমে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে দেব–দেবীরা বিভিন্ন রূপ বা অবতার গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাণীর অবতার গ্রহণের ধারণাটিই সবচেয়ে বেশি কল্কে পায়। বাদ যায় না দেবতাদের বিড়াল-অবতার গ্রহণের সম্ভাবনাও।
প্রাচীন মিসরীয়রা এমনটি ভাবত না যে দেবতারা বিড়ালের কেবল মাথাটিই পরিগ্রহ করছেন। তারা ভাবত যে দেবতারা বিড়ালের গোটা শরীরটিরই অধিকার নিচ্ছেন।
আর মানুষের এই বিশ্বাসের কারণেই দেবতাতুল্য হিসেবে বিড়ালের মমি করার প্রচলন শুরু হয় এবং সামগ্রিকভাবেই অর্থনীতির একটি নতুন ধারা গড়ে ওঠে বিড়াল লালন–পালন ও মমি করাকে কেন্দ্র করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই বিড়ালকেন্দ্রিক অর্থনীতির বদৌলতে ফুলেফেঁপে ওঠে অনেক ব্যবসায়ীরই কোষাগার।
সব মিলিয়ে প্রাচীন মিসরে একপর্যায়ে বিড়ালকে এতটা মর্যাদা ও সম্মানে আসীন করা হয় যে মমি করা ছাড়া অন্য কোনোভাবে বিড়াল হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তবে অর্থনীতি বা সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলা ছাড়াও বিড়াল প্রাচীন মিসরের মানবজীবনে যে বিমূর্ত পরিবর্তনটি নিয়ে আসে, তা হলো ঈশ্বরভীতি। চোখের সামনে দিয়ে বিড়াল তো গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যেতই, সেই সঙ্গে শিল্প, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর সাজানোর উপকরণ—সর্বত্র বিড়ালের উপস্থিতি বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিত দেবতাদের কী অপরিসীম ক্ষমতা!