প্রাচীন মিসরের লোকেরা বিড়ালকে কেন সম্মান করত
বিড়ালকে পোষ মানানোর ইতিহাস অনেক পুরোনো। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে সাত হাজার বছর আগে এশিয়া ও আফ্রিকার মিসরে মূলত বিড়ালকে পোষ মানানোর চল শুরু হয়।
শস্য চাষ শুরু করার সঙ্গে বিড়ালকে পোষ মানানোর সম্পর্ক আছে। গোলায় তোলা শস্য ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন হয়েছিল বিড়ালের। ইঁদুর শস্য খায়, আর ইঁদুরকে শিকার করে বিড়াল। এ কারণে সম্ভবত মাছের কাঁটার লোভ দেখিয়ে মানুষ বিড়ালকে পোষ মানিয়ে নিয়েছে।
মিসরে বিড়ালকে রীতিমতো পূজা করা হতো। বিড়ালকে পোষ মানানোর কারণ ছিল ইঁদুর ও পাখির হাত থেকে শস্য রক্ষা করা। আবার বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছু মারার জন্য মিসরে বিড়ালকে অত্যন্ত পবিত্র ও প্রয়োজনীয় মনে করা হতো। তবে বিড়ালকে বিড়ালের আকারে নয়, এক মানবীর দেহ, যার মুখের আকৃতি বিড়ালের মতো—মিসরীয়রা এমন দেবীর পূজা করত।
এই সব দেবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন দেবী ছিল ‘মাফদেদ’। চিতার পোশাক পরা মাফদেদ প্রাচীন মিসরে সাপ ও কাঁকড়াবিছে বা স্করপিয়ন থেকে মিসরীয়দের রক্ষার দেবী হিসেবে পরিচিত ছিল।
এর কিছুদিন পর মিসরীয়রা ‘বাসতেত’ নামে এক দেবীর পূজা শুরু করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাসতেতের মাথায় সিংহী, একটি চাকতি ও গোখরা সাপ বসানো থাকত। প্রাচীন মিসরে অনেক জাঁকজমকের সঙ্গে বাসতেতের পূজা করা হতো।
প্রাচীন মিসরে নীল নদের উপত্যকায় বুবাসতিস নামের এলাকায় বাসতেতের উৎসব হতো, যেখানে বছরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ উৎসবে যোগ দিত। মিসরে বিড়ালের মুখাকৃতির ‘শেখমেত’ ছিল শক্তির দেবী।
বিড়ালের ভক্তিতে পরাজয়
মিসরে বিড়ালকে এতটাই ভক্তিভরে পূজা করা হতো যে বিড়াল দিয়ে পারস্যের এক রাজা মিসরের একটি এলাকা দখল করে নেন।
যিশুর জন্মের ৫২৫ বছর আগে পারস্য বা ইরানের রাজা দ্বিতীয় কম্বোসেসের সঙ্গে মিসরের ফারাও দ্বিতীয় আমেসিসের এক যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। মিসরের পেলুসিয়াম নামের জায়গায় এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় বলে একে পেলিসিয়ামের যুদ্ধ নামে ডাকা হয়। এই যুদ্ধে ইরানের রাজা তাঁর বাহিনীকে হুকুম দেন নিজেদের বাহিনীর সামনে যত ধরনের বিড়াল আছে, সেগুলো বেঁধে রেখে দিতে।
এর ফলে মিসরের যোদ্ধারা দেখেন, ইরানের সেনাদের সামনে নিজেদের দেবতার দল। এই দেখে মিসরের সেনা ইরানের সেনাদের বিরুদ্ধে বর্শা ও তির চালাতে পারেনি। কারণ, তির মারলে বা বর্শা ছুড়লে সেটা ইরানের সেনাদের আগে নিজেদের দেবীর গায়ে বিঁধবে। এভাবে রাজা কম্বোসেস সহজেই মিসর দখল করে নেন।
বিড়ালের প্রতি ভালোবাসার কারণে মিসরে বিড়াল হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। বিড়াল হত্যা করলে কঠিন শাস্তির বিধান ছিল মিসরে। ডিওডোরাস সিকুলাস নামের এক গ্রিক ইতিহাসবিদের লেখা থেকে জানা যায়, যিশুর জন্মের ৫০ থেকে ৬০ বছর আগে মিসরের এক শহরে গ্রিসের এক নাগরিককে মেরে ফেলা হয়েছিল। তাঁকে পিটিয়ে মারার কারণ, তিনি তাঁর পোষা বিড়ালকে মেরে ফেলেছিলেন।
মিসরে শুধু মানুষের নয়, বিড়ালেরও মমি করা হতো। শুধু মিসরের বিভিন্ন পিরামিডে নয়, মাটি খুঁড়ে গর্ত করে বিড়ালের মমি দাফন করা হতো। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যখন মিসরের পিরামিডের অনুসন্ধানে অভিযান চালানো শুরু করেন, তখন সেখানকার মাটি খনন করে তাঁরা হাজার হাজার বিড়ালের মমি পান। এমনকি একটা সময় কায়রোর রাস্তাঘাটে মমি করা বিড়াল বিক্রিও করা হতো।
প্রাচীন মিসরে একসময় বিড়ালের এত মমি করা হয়েছিল যে মিসরে কিছু অঞ্চলে খনন করলে শুধু বিড়ালের মমি পাওয়া যেত।
এই সব বিড়ালের মমির কিছু ইউরোপের জাদুঘরে ঠাঁই পায়। তবে বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিড়ালের মমির ভাগ্যে সে সুযোগ জোটেনি।
১৮৯০ সালে ইংল্যান্ডের লিভারপুল বন্দরে হাজার হাজার বিড়ালের মমি এসে হাজির হয়। এগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি জাদুঘরে আশ্রয় পেলেও, বাকিগুলো সার হিসেবে কৃষকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।