খরগোশের গর্তে পড়ে যাওয়া সেই ছোট্ট মেয়ে অ্যালিসের কথা তো তোমাদের সবারই জানা। এই রহস্যময় গর্ত বেয়েই সে একদিন পৌঁছে গিয়েছিল আজব এক জাদুর দেশে। সেই দেশে দুঃসাহসিক সব কাহিনি লিখে সাত বছরের এই মেয়েটিকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছেন লেখক লুইস ক্যারল। তবে শুধু কল্পনায় নয়, বাস্তবেও আছে আরেক অ্যালিস। তার সঙ্গেও আজব রহস্যময় এক জাদুর দেশের সম্পর্ক রয়েছে। প্রায় অখ্যাত আট বছরের এই ছোট্ট মেয়েটির পুরো নাম অ্যালিস নিউটন। বাবা নিগেল নিউটন, ব্রিটেনের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ব্লুমসবুরির চেয়ারম্যান।
১৯৯৬ সালের ঘটনা। নতুন এক বইয়ের পাণ্ডুলিপি এসেছে ব্লুমসবুরিতে। পুরোটা নয়, শুধু প্রথম তিনটি অধ্যায়। অবশ্য তার আগে পাণ্ডুলিপিটি পাঠানো হয়েছিল অন্তত ১২টি প্রকাশনা সংস্থায়। কিন্তু একে তো নতুন লেখক, তারপর কাহিনিটাও আজগুবি, আবার বইটাও প্রায় ৮০ হাজার শব্দের। এত বড় আকারের বই শিশু-কিশোরদের কাছে বিক্রি হবে না ভেবে সবাই ফেরত পাঠিয়েছে সেটি।
ব্লুমসবুরির সেকালের সম্পাদক ব্যারি কানিংহ্যামও পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। কী করবেন বুঝতে না পেরে সংস্থার চেয়ারম্যান নিগেল নিউটনের কাছে পাঠালেন সেটি। পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে নিগেলের মাথায় চমৎকার এক বুদ্ধি খেলে গেল। নিউটন পাণ্ডুলিপিটির প্রথম অধ্যায়টি নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। তাঁর মেয়ে অ্যালিস বইয়ের পোকা। এই বয়সেই বইয়ের ভালো-মন্দ বেশ বোঝে। ভাবলেন, তাকেই পড়তে দেবেন। ভাবনামতো অ্যালিসের হাতেই তুলে দিলেন পাণ্ডুলিপিটির ভাগ্য।
অ্যালিস বেশ কিছুক্ষণ পুরো বুঁদ হয়ে রইল তাতে। প্রথম অধ্যায়টা নিমেষে শেষ হয়ে গেল। আনন্দ ঝলমলে অনুভূতি নিয়ে একটু পরেই ফিরে এসে পরের অধ্যায়গুলো পড়ার জন্য বাবার কাছে আবদার জুড়ে দিল। বইটি তাড়াতাড়ি প্রকাশেও প্রতিদিন তাগাদা দিয়ে বাবাকে প্রায় পাগল করে ফেলল সে। চেয়ারম্যান নিগেল যা বোঝার বুঝে নিলেন। অখ্যাত এক লেখকের আজগুবি কাহিনিই শেষ পর্যন্ত প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হলো হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন শিরোনামের সেই বইটি। লেখক জে কে রাওলিং। তারপরের কাহিনিটুকু তো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেল বইটি।
তকমা জুটল বেস্টসেলার বইয়ের। এক বছরের মাথায় সেটি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে প্রকাশিত হলো যুক্তরাষ্ট্রে। তবে এবার শিরোনামটা বদলে দাঁড়াল হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সর্সাস স্টোন। প্রকাশকদের আশঙ্কা, ফিলোসফার্স শব্দটা হয়তো শিশু-কিশোর পাঠকেরা বুঝবে না। তাই এ পরিবর্তন। আমেরিকাতেই টানা দুই বছর বেস্টসেলার তালিকায় রইল বইটি। এই চরম সাফল্যে যেসব প্রকাশক বইটির পাণ্ডুলিপিটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা যে হা-হুতাশ করেছেন তা এমনিতেই আন্দাজ করা যায়। এরপর একে একে প্রকাশিত হলো সিরিজটির আরও ছয়টি বই। বলা বাহুল্য, সেগুলোর ভাগ্যেও জুটেছিল বেস্টসেলারের পালক। এভাবে বছর না ঘুরতেই এক সেলেব্রিটিতে পরিণত হলেন জে কে রাওলিং। হয়ে গেলেন বিশ্বের সেরা নারী ধনীদেরও একজন।
তবে জে কে রাওলিংয়ের শুরুটা কিন্তু অতটা মধুর ছিল না। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের গ্লস্টারশায়ারের ইয়েট শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই (হ্যারি পটারের জন্মতারিখও তাই)। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন জোয়ান রাওলিং। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতেন। বাবা-মায়ের উৎসাহে আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের পোকা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ছোট্ট বোন ডায়ানকে গল্প পড়ে শোনাতেও ভালো লাগত তাঁর। এই গল্প শোনাতে গিয়েই একদিন তাঁর মাথায় গল্প লেখার ভূত চাপে।
স্বপ্ন দেখতে লাগলেন, একদিন তিনি অনেক বড় লেখক হবেন। তাঁর বইও শোভা পাবে নামী সব বুকস্টলে; স্থান পাবে বেস্টসেলার তালিকায়। এ চিন্তা থেকেই মাত্র ছয় বছর বয়সেই খরগোশ নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন ‘র্যাবিট’ নামের একটি গল্প। ১১ বছর বয়সে লিখে ফেলেন আস্ত একটা উপন্যাস। তবে হ্যারি পটারের চিন্তাটা তাঁর মাথায় এসেছিল আরও পরে, সেই ২৫ বছর বয়সে।
সেটি ১৯৯০ সালের ঘটনা। লন্ডন ছেড়ে ম্যানচেস্টারে বাসা বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জোয়ান। বাসা খুঁজতেই সেবার ট্রেনে চেপে ম্যানচেস্টারে হাজির হয়েছিলেন। ফিরতি পথে ট্রেনে বাধল বিপত্তি। ঠাসাঠাসি লোকের ভিড়ে শরীরটাকে কোনোমতে ভেতরে গলিয়ে দিলেন তিনি। ট্রেনের ভেতরে একেবারে দমবন্ধ অবস্থা। এ যাচ্ছেতাই অবস্থায় কী করে দীর্ঘ যাত্রাপথ কাটাবেন তা-ই ভাবছিলেন জোয়ান। আচমকা কেন যেন হাড় জিরজিরে, কালো চুল আর চশমাওয়ালা এক ছোট্ট ছেলের ছবি ভেসে গেল মনের পর্দায়। ছেলেটি অনেকটা তাঁর ছোট্টবেলার প্রতিবেশী ইয়ান পটারের মতো। ডানপিটে ইয়ান একসময় রংচঙে জাদুকরদের মতো অদ্ভুত এক পোশাকে পাড়ার রাস্তা দাবড়ে বেড়াত। সেই ছোট্ট পটারের কথা ভাবতে ভাবতে আজব এক দেশের গল্প মাথায় এল। মগজের কোষ থেকে রক্তস্রোত হয়ে সেই ভাবনা শিহরণ বইয়ে দিল পুরো দেহে। উত্তেজিত হয়ে আইডিয়াটা যত দ্রুত সম্ভব কাগজে লিখে রাখার কথা ভাবলেন। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে সেদিন জোয়ানের কাছে কোনো কাগজ বা কলম ছিল না। ট্রেনের যাত্রীদের কারও কাছে একটু কাগজ আর একটা কলম চেয়ে নিতেও লজ্জা লাগছিল তাঁর। অগত্যা মগজেই লিখে চললেন ছোট্ট এক ছেলে আর জাদুর এক দেশের গল্প। ততক্ষণে অবশ্য ছোট্ট ছেলেটির নামও দিয়ে ফেলেছেন, হ্যারি পটার। এভাবেই জন্ম নিল বিশ্বের শিশু-কিশোরদের জনপ্রিয় চরিত্রটি।
এমনিতে প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টায় ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু সেবার পাক্কা চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল জোয়ানকে। তবে এই চারটি ঘণ্টা তাঁর জীবনের সবচেয়ে সেরা সময় হিসেবেই মন্তব্য করেছেন তিনি। বাড়ি পৌঁছে দ্রুত হ্যারি পটারের আইডিয়াটা গুছিয়ে লিখে রাখলেন নোটবুকে।
তবে এরপরের কয়েক বছর একনাগাড়ে বেশ কিছু ঘটনা তাঁর জীবন ওলটপালট করে দিল। মেয়ে জেসিকার জন্ম, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, প্রচণ্ড অসুস্থ মায়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেলেন তিনি। টাকাপয়সার অভাবটাও ছিল নিত্যসঙ্গী। অথচ কোনো আয়রোজগার নেই। কিন্তু মাথায় তখনো হ্যারি পটারের গল্প ঘুরছে। একটু একটু করে লিখতেও শুরু করলেন জোয়ান। সে সময় কোনোমতে মাথা গুঁজে বেঁচে থাকতে সরকারি সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিলেন। ছোট্ট মেয়েকে দেখাশোনার জন্য আর কেউ ছিল না। একা হাতেই সামলাতে হতো সবকিছু। মেয়ে জেগে থাকলে লেখার ফুরসত মিলত না। তাই মজার এক উপায় বের করলেন তিনি। জেসিকাকে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে যেত জেসিকা। এবার তাকে ঘুম পাড়িয়ে পাশের কোনো ক্যাফেতে ঢুকে পড়তেন। এডিনবার্গের বেশ কিছু ক্যাফেতে বসে পুরোনো ম্যানুয়াল টাইপরাইটারে এভাবে পাতার পর পাতা লিখে যেতেন অনাথ ছেলে হ্যারি পটারের কাহিনি।
১৯৯৫ সালের দিকে লেখা শেষ হলো হ্যারি পটারের প্রথম বইটি। এবার প্রকাশককে পাঠানোর পালা। এজেন্টের মাধ্যমে প্রথম তিনটি অধ্যায় বিভিন্ন প্রকাশকের দরবারে পাঠানো হলো। কিন্তু সব আশায় গুড়েবালি। একে একে সবাই হতাশ করল জোয়ানকে। কেউই এই প্রমাণ সাইজের অদ্ভুতুড়ে কাহিনি ছাপতে রাজি নয়। শেষমেশ ব্লুমসবুরি প্রকাশনী বইটির পাণ্ডুলিপি পছন্দ করে, সে কথা তো আগেই বলেছি। তবে বইটি ছাপার আগে নিজের নামটিই বিসর্জন দিতে হয় জোয়ানকে। প্রকাশকের মতে, লেখক হিসেবে জোয়ান রাওলিং ছাপলে পাঠক বইটি কিনতে চাইবে না। তাঁদের পরামর্শে নামের সঙ্গে দাদির নাম ক্যাথলিন যোগ করেন তিনি, যাতে নাম দেখে লেখক ছেলে না মেয়ে তা বোঝা না যায়। শর্ত মেনে তাঁর নাম দাঁড়াল জে কে রাওলিং (জোয়ান ক্যাথলিন রাওলিং)।
বইটা শেষ পর্যন্ত ছাপালেও খুব বেশি বিক্রির আশা করেনি ব্লুমসবুরি। তাই প্রথম মুদ্রণে ছাপা হলো মাত্র এক হাজার কপি। সে জন্য জোয়ানকে অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল মাত্র দেড় হাজার পাউন্ড। অবশ্য পারিশ্রমিক কম দিলেও জোয়ানকে বিনা মূল্যে একঝুড়ি উপদেশ দিলেন ব্লুমসবুরির চেয়ারম্যান। নিউটনের পরামর্শ: শিশু-কিশোরদের বই লিখে খুব বেশি অর্থ আয়ের সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রুত একটা চাকরি খুঁজে নেওয়াই মঙ্গল। সে কথা শুনে জোয়ান হতাশ হলেও লেখালেখি চালিয়ে গেলেন পুরোদমে। কবছরের মাথায় ব্রিটেনের সর্বকালের সেরা শিশুসাহিত্যিকদের অন্যতম হিসেবে উঠে এল তাঁর নাম। একে একে পেতে লাগলেন পুরস্কার আর সম্মাননা। আবার নিউটনের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে প্রমাণ করে শুধু বই লিখেই ব্রিটেনের রানির চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক হলেন তিনি। ২০১৮ সালের হিসাবে, বিশ্বজুড়ে ৮০টি ভাষায় হ্যারি পটারের প্রায় ৫০ কোটি বই বিক্রি হয়েছে। এভাবেই জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে শুধু ব্রিটেন নয়, পুরো বিশ্ব জয় করলেন জোয়ান রাওলিং ওরফে জে কে রাওলিং।