ডলফিন আর তিমির খোঁজে

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড! বঙ্গোপসাগরের গভীরে অতল এক খাদ এটা। এখানে ঘুরে বেড়ায় ডলফিন, তিমি আর অসংখ্য জলজ প্রাণী। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা যাদের রক্তে, এই তথ্যটুকুই তাদের জন্য যথেষ্ট। এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছিল দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে। এই যাব সেই যাব করে কোনোভাবেই সময় মেলাতে পারছিলাম না। এ তো আর এক-দুই দিনের ব্যাপার না, অনেকগুলো দিন লাগে এই নীল সাগরের বুকে সৌন্দর্যে ডুবে যেতে। তা ছাড়া ইচ্ছা করলেই একা একা যাওয়া যায় না, টিম নিয়ে ভালো প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হয়। অবশেষে এবার সুযোগ পেলাম বাংলাদেশের সীমানার অদ্ভুত এই নীলের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য, বলা চলে একধরনের আমন্ত্রণই পেলাম। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইসাবেলা ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে (এসওএনজি) গবেষণা অভিযান পরিচালনা করে, সেখানেই আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমন্ত্রণ পাই ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে। স্বপ্ন হয়ে উঠে বাস্তব।

ইসাবেলা ফাউন্ডেশন সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় দ্বিতীয়বারের মতো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে গবেষণা অভিযান পরিচালনা করে ১৯-২৪ নভেম্বর। যার চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ার স্যার। তাঁর নেতৃত্বেই ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমুদ্রবিজ্ঞানী, জিআইএস স্পেশালিস্ট ও অন্য বন্য প্রাণী গবেষকদের সঙ্গে আমি বন্য প্রাণী গবেষক হিসেবে অংশগ্রহণ করি। এই টিমে আমি সোয়াচের স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপ প্রাণী দেখার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড হলো তিমি ও ডলফিনের নিরাপদ আবাসস্থল। বঙ্গোপসাগরের নিচে অতল খাদ বলে পরিচিত এই স্থান এক রহস্যময় এলাকা, এখানে একই সঙ্গে তিমি, ডলফিন আর হাঙরের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় বহু প্রজাতির মাছ ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এ তথ্য যারা জানবে, তাদের মাথায় এসওএনজির ঘুরে বেড়ানোর নেশা চাপতেই পারে, আমিও সেই নেশাতুর মানুষদের দলে। তাই আমন্ত্রণ পেয়েই তল্পিতল্পা গুটিয়ে নরসিংদী থেকে ছুট লাগালাম সাগরের টানে।

আমাদের গবেষণা অভিযানটি শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৭ নভেম্বর ২০১৭ থেকে। রাজীব ভাইয়ের ডাকে চলে আসি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। এখানে এসেই জানতে পারি সাগরের আবহাওয়া খারাপ হয়েছে, দেওয়া হয়েছে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত। এমন আবহাওয়ায় নদীতে চলাই দুষ্কর, আর এ তো সাগরের ব্যাপারস্যাপার! ঝুঁকি নিয়ে আর যেখানেই হোক, সোয়াচে যাওয়া সম্ভব না। ফলাফল টিম লিডার কবির বিন আনোয়ার স্যার সোয়াচ অভিযান সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। মনটি বিষাদে ভরে যায়, তৈরি হয় অজানা ভয়, আবহাওয়া ভালো হবে কি? সোয়াচে যেতে পারব তো? রাতে খবর আসে সোয়াচ অভিযান দুই দিন পর ১৯ নভেম্বর থেকে শুরু হবে।

১৮ নভেম্বর দুপুরের মধ্যে ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অভিযানের সব মালামাল ও গবেষণার যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে পতেঙ্গা বন্দরে চলে যাই, সেখানে আগে থেকেই আমাদের জাহাজ নোঙর করা ছিল।

১৯ নভেম্বর ২০১৭। সকালে সংবাদ সম্মেলন করার পর দুটি জাহাজ ‘মীন সন্ধানী’ ও ‘টর্নেডো’ করে সোয়াচ অভিমুখে গবেষক দলের যাত্রা শুরু হয়। আমরা ছিলাম ‘টর্নেডো’ জাহাজে। ঘণ্টাখানেক পর নদী পেরিয়ে জাহাজ দুটি মূল বঙ্গোপসাগরের সীমানায় ঢুকে পড়ে, শুরু হয় উত্তেজনা। আমার যেন তর সইছে না, বারবার প্রশ্ন কতক্ষণ লাগবে সোয়াচে যেতে? জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসাব করে জানালেন স্রোত, জোয়ার-ভাটা, বাতাস ইত্যাদি সবকিছু অনুকূলে থাকলে পতেঙ্গা থেকে সোয়াচে যেতে ২০-২২ ঘণ্টা লাগে। বোঝো অবস্থা! অর্থাৎ এই ২০-২২ ঘণ্টা পানি দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের! কী আর করা, ডেকে বসে পানি খাই, পানি দেখি, পানিতে ভিজি আর পানির ছবি তুলি!

জাহাজ দিনরাত শুধু চলছেই। অন্ধকারেও ক্যাপ্টেন জিপিএস, ম্যাপ ও রাডার দিয়ে পূর্ণ স্পিডে জাহাজ নিয়ে যাচ্ছেন সোয়াচের অভিমুখে। জাহাজের কোনো বিশ্রাম নেই, জাহাজ হলো তারার মতন, বাতাসের মতন সব সময় চলে।

২০ নভেম্বর ২০১৭। খুব ভোরে অল্প আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম জাহাজ তখনো চলছে। চারদিকে শুধু থইথই পানি। জাহাজের চারপাশে উড়ছে দুই প্রজাতির অনেক গাঙচিল। রাজীব ভাই জানালেন, সোয়াচ এলে খুব সহজেই বোঝা যাবে। এখানে পানির রংই আলাদা হয়ে যায়! প্রথমে ময়লা বাদামি থেকে ড্যাবড্যাবে নীল। এরপর গাঢ় নীলে ছেয়ে যায় চারপাশ। পাখি দেখতে ও ডেটা শিটে বিভিন্ন তথ্য টুকে রাখতে রাখতেই সকাল নয়টার দিকে সোয়াচের খুব কাছে পৌঁছে গেলাম। পানির রং নীল হতে শুরু করেছে। আর আমাদের ঠোঁটে ফুটতে শুরু করেছে হাসি।

গবেষণার পদ্ধতি অনুসারে সোয়াচের বিভিন্ন জায়গায় দুটি জাহাজ পাশাপাশি রেখে নির্দিষ্ট স্পিডে চালু করা হলো। গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সোয়াচের অতি স্বচ্ছ, গাঢ় নীল সুন্দর পানির দিকে। কিছু সন্দেহ হলেই চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ চলে। কোনো ডলফিন, কচ্ছপ বা তিমি দেখার আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় বসে চলে পর্যবেক্ষণ। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল চলে যাচ্ছে কিন্তু একটিও ডলফিন বা তিমির দেখা নেই। সোয়াচে যারা প্রথম যায় তাদের মতো আমারও একটা ধারণা ছিল সোয়াচে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো শত শত ডলফিনের দেখা পাব। সারা দিনেই শেখা হয়ে গেল সাগরের স্তন্যপায়ীদের বিচরণ এলাকা কীভাবে এত বিশাল হয়। এই বিশাল সমুদ্রে কোথায় ডলফিনের ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে তা খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়।

যখন ভাবছি কেন সারা দিন তপ্ত রোদে পুড়ে পুড়েও ডলফিন বা তিমি দেখতে পেলাম না। ঠিক সেই পড়ন্ত বিকেলে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে দেখলাম পানির ফোয়ারা। প্রথমে সাগরের সাধারণ ঢেউ বলে ধারণা হলো। রাজীব ভাইকে বিষয়টা জানাতেই বললেন, তিমি হতে পারে, ভালো করে খেয়াল করেন। কিছুক্ষণ পর আবার দেখতে পেয়েই রাজীব ভাইকে দেখালাম। রাজীব ভাই চিৎকার করে বললেন, এটা তিমির ফোয়ারা। ততক্ষণে আমাদের তিমি তিমি চিৎকার পুরো জাহাজে ছড়িয়ে পড়ল। রাজীব ভাই ফোয়ারার একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন। আমিও স্থিরভাবে বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে আছি। বাইনোকুলার দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম বিশাল তিমির বিশাল পিঠ। একবার-দুবার নয়, একের পর এক বেশ কয়েকবার। কী বিশাল, কী পরাবাস্তব সুন্দর!

জীবনে প্রথমবারের মতো সাগরে নিজ চোখে তিমি দেখার অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা পরবর্তী প্রায় দেড় ঘণ্টা তিমির দলকে অনুসরণ করেছি। আনোয়ার স্যার ছোট স্পিডবোটে করে তিমির দলকে অনুসরণ করেও কাছাকাছি যেতে পারেননি। ততক্ষণে বিকেলের আলো কমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার হতে থাকে। তা ছাড়া তিমির দলও গভীর সাগরে ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় যত দূর দৃষ্টি যায় তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি বিস্তৃত সোয়াচের নীল জলে।

নীল জলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় ডলফিনের দল

প্রথম দিনেই বেশ ভালো তথ্য, ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পেয়ে স্যার অনেক খুশি। চলল পরের দিনের কর্মপরিকল্পনা। মাছের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে গবেষণার তথ্য পেতে নির্দিষ্ট সময় ধরে জাল ফেলা হয় সাগরে। জালে উঠে আসে নানান বৈচিত্র্যের প্রচুর মাছ। প্রতিটি মাছের প্রজাতি আলাদা করে ট্রেতে সাজিয়ে চলে মাপজোখ ও ছবি তোলার কাজ।

এভাবে পরের দুই দিন অর্থাৎ ২১ ও ২২ নভেম্বর আমরা সোয়াচের আরও অনেক জায়গা চষে বেড়াই। দ্বিতীয় দিন দেখা পাই তিন প্রজাতির ডলফিনের। তৃতীয় দিন ডলফিন ছাড়াও খুব কাছ থেকে আবারও তিমির দেখা পাই। এ ছাড়া সোয়াচের গভীরতা, বন্য প্রাণী, মাছ, পানির গুণাগুণ ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে ২৩ তারিখ ফেরত আসি।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড আমাদের সাগরের সংরক্ষিত এলাকা এবং বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। গবেষণার কার্যক্রম ও পূর্ব অনুমতি ছাড়া সাধারণ পর্যটকের জন্য যাওয়ার অনুমতি নেই। সোয়াচ শুধু ডলফিন বা তিমির আবাসস্থল বলেই নয়। সোয়াচ হলো সামুদ্রিক মাছের এক বিশাল রত্নভান্ডার। সমুদ্রসীমার বিজয়ের মাধ্যমে সোয়াচের অনেক বড় অংশে আমাদের একচ্ছত্র অধিকার লাভ হয়। সোয়াচে এখন নিয়মিত টহল দেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান বিশ্বের সেরা ১১টি গভীর খাদ বা ক্যানিয়নের মাঝে অন্যতম। সোয়াচে একসময় জাহাজ বা নৌকা নোঙর করতে গিয়ে কোনো তলদেশ খুঁজে পেত না। এ জন্য নাম দেওয়া হয়েছিল সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, সোয়াচের গভীরতা কোথাও কোথাও ১ হাজার ৩৪০ মিটার পর্যন্ত রয়েছে, কোথাও কোথাও এখনো অজানা। সোয়াচে বোতল নাক ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, ঘূর্ণি ডলফিন, গোলাপি পিঠকুঁজো ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন ও মসৃণ পিঠের ডলফিন (পাখাহীন) পাওয়া যায়।

এই জাহাজে চেপেই ঘুরে বেড়িয়েছি সোয়াচের জলে

আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে সোয়াচে গেলেও সোয়াচে যাওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি ও সহজ জায়গা হলো মোংলা বন্দর থেকে যাওয়া। মোংলা ছাড়া কুয়াকাটা থেকেও সোয়াচে যাওয়া যায়। সোয়াচে সাধারণ মানের লঞ্চ বা ট্রলার দিয়ে যাওয়া যাবে না। গভীর সাগরে চলাচল উপযোগী জাহাজে করে সোয়াচে যাওয়া খুব ব্যয়বহুল হতে পারে। তা ছাড়া সোয়াচের আশপাশে প্রচুর মাছ ধরার নৌকা মাছ ধরতে যায়। এসব মাছ ধরার নৌকা করেও কম খরচে সোয়াচে যাওয়া যাবে। তবে সরকার থেকে অনুমতি নিয়েই যেতে হবে।