কুকুরের সহজাত ভাষা

কাঁটাবনের পোষা প্রাণীর মার্কেটে আনা বিদেশি কুকুরটা কি পাশের খাঁচার দেশি কুকুরের কথা বুঝতে পারে? কিংবা ইতালিয়ান কুকুরটা কি বুঝতে পারে পাশের খাঁচার জার্মান কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের মানে?

তোমরা নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যে কুকুরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো। কুকুরকে বলো, ‘বস’ কিংবা ‘বিস্কুট খাবি?’ অনেক কুকুর এসব কথা বুঝতেও পারে। একই সঙ্গে কুকুর কিন্তু কথাও বলে। এই যে কুকুরগুলো সারা দিন ডাকছে, সেগুলো কিন্তু একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে। কখনো সাবধান করছে, কখনো হুমকি দিচ্ছে, খেলতে ডাকছে আবার কখনো না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করছে, ‘কী বললে?’

কুকুর যে এত কথা বলছে, এটা শিখছে কখন? তুমি কত বছর বয়সে কথা বলতে শিখেছিলে? দেড় বছর? দুই বছর? কিংবা আরও বেশি? কিন্তু কাঁদতে শিখেছ কখন? শিখতে হয়নি। জন্ম থেকেই কাঁদতে জানো। কান্নার এই স্বর আসলে তোমার মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটা উপায়। এটাও একরকম ভাষা।

কুকুরেরও তেমন জন্ম থেকে জানা একটা ভাষা আছে। যেটাকে বলা হয় কুকুরের সহজাত ভাষা। এই ভাষা ওকে শিখতে হয় না। ওরা কিছু শব্দ জন্ম থেকেই জানে।

আমরা কথা বলি আমাদের ভোকাল কর্ডে নানা রকম কম্পন তৈরি করে শব্দ উৎপন্ন করার মাধ্যমে। ডাঙার প্রায় সব মেরুদণ্ডী প্রাণীই এই কাজ করে। কুকুরও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কুকুরের যে কথা বলার ক্ষমতা, সেটি আসলে তাদের কোষের জিনে লুকিয়ে আছে। এই শব্দ করার ক্ষমতা সে জন্মের আগেই তার ডিএনএতে থাকা কোড থেকে পেয়ে যাচ্ছে। তাই তাকে শিখতে হচ্ছে না। মোটামুটি চার সপ্তাহ বয়সে সব রকম ভোকালাইজেশন বা শব্দ তৈরি শিখে ফেলে কুকুর।

আরও পড়ুন

কুকুর জানে, কাউকে সতর্ক করতে হলে কোন শব্দটি কতবার করে তৈরি করতে হবে। কাউকে হুমকি দিতে হলে কীভাবে বলতে হবে, সেটাও তার জন্ম থেকে জানা। শব্দগুলো কত দ্রুত করতে হবে, সেটিও কুকুর জানে। এই শব্দগুলো জেনেই জন্ম নিচ্ছে সব কুকুর এবং পৃথিবীর দুই প্রান্তের কুকুরও মোটামুটি একই ধরনের শব্দ তৈরি করে একটি জিনিস বোঝায়। যেমন বাংলাদেশের একটা কুকুর যদি খুব দ্রুত ঘেউ ঘেউ ঘেউ বলে ওঠে, জার্মান কুকুর ঠিকই বুঝতে পারবে, তাকে দেখে আশপাশের অন্য কুকুরগুলোকে সাবধান করার চেষ্টা করছে এই বাংলাদেশি বন্ধু। কিংবা হয়তো এই জার্মান কুকুরও খুব উচ্চ কম্পাঙ্কের লম্বা শব্দ করে বুঝিয়ে দেবে, ‘আমিও কিন্তু ছাড় দেব না।’ সেই হুমকিও বাংলাদেশি কুকুর ঠিকঠাক বুঝে নেবে।

আমি বলছি, সব দেশের কুকুরের ভাষা একই। কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, একেক দেশের কুকুরের ডাক একেক রকম শোনায়। এবার একটা দৃশ্য কল্পনা করা যাক। একটা পার্কে কয়েকটা জার্মান কুকুর খেলছে এবং সেটা টের পেয়ে একদল বাংলাদেশের কুকুর এগিয়ে আসছে। দুই দল যখন একে অপরকে আক্রমণের হুমকি দিতে শুরু করবে, তখন তুমি মজার একটা জিনিস লক্ষ করবে। বাংলাদেশের কুকুরগুলো যে সুরে, যে কয়বার করে ডাকছে, জার্মান কুকুরগুলোও অনেকটা একই সুরে প্রায় সমানসংখ্যকবার ডাকছে। কিন্তু বাংলাদেশের কুকুরের ডাক হবে অনেকটা ঘাউ ঘাউ ঘাউ ধরনের। আর জার্মান কুকুরের ডাকটা শোনাবে অনেকটা ভাউ ভাউ ভাউ ধরনের। এটা কেন?

আরও পড়ুন

এখানেই আসে কুকুরের ডাকের সবচেয়ে মজার গল্পটা। একেক অঞ্চলের কুকুর সেখানকার শব্দ, বিশেষ করে লোকালয়ে থাকা কুকুর সে অঞ্চলের মানুষের ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে ডাকে। জার্মান ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে জার্মান কুকুরের ডাকের মিল পাবে। তেমনি স্প্যানিশ কুকুরের ডাকে একটা মোলায়েম স্বর পাবে। আবার বাংলাদেশের কুকুরের স্বর আলাদা হবে। এটা তাদের উচ্চারণের পার্থক্য। কুকুর স্বর নকল করতে খুব পছন্দ করে এবং তারা যে শুধু স্বর নকল করে তা নয়, আচরণও নকল করে। আর পোষা কুকুর সাধারণত তার মালিকের স্বর নকল করে।

কুকুরের নিজের ভাষার ব্যাপারে তো বেশ জানা হলো। এবার আসা যাক মানুষের কোন ভাষা কুকুর বোঝে। সাধারণভাবে কুকুর অনেক শব্দ শিখতে পারে। তার কাছে ভাষার কোনো রকমফের নেই। চেসার নামে একটি কুকুরকে তোমরা চিনতে পারো। সে এক হাজার খেলনা পুতুল আলাদা করে চিনতে পারে। তবে সাধারণ কুকুর অতগুলো শব্দ শিখতে পারে না। ড. স্ট্যানলি কোরেন নামের এক বিজ্ঞানী গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি কুকুর গড়ে মোটামুটি ১৬৫টি শব্দ শিখতে পারে (বলতে নয়, শুধু বুঝতে পারে)। একটু বুদ্ধিমান কুকুর ২৫০ শব্দ পর্যন্ত শিখতে পারে। এই শব্দগুলো যেকোনো ভাষার হতে পারে। এমনকি একই কুকুর একই শব্দ কয়েকটি ভাষায় শিখতে পারে। যেমন একটি কুকুরকে একই সঙ্গে ‘sit’, ‘বস’, ‘sisntate’ দিয়ে বসতে বলা শেখাতে পারো তুমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকাররম ভবনের টংদোকানের আশপাশে থাকে, এমন একটা কুকুর আছে। একটি ভিডিও করেছিল আমার এক বন্ধু, যেখানে ওকে ‘বস’ বললে বসছে না, কিন্তু ‘sit’ বললে ঠিকই বসে পড়ছে। কেউ হয়তো ওকে শিখিয়ে দিয়েছে যে ‘sit’ বললে বসতে হয়। শেখানোর কাজটা প্রথমে করা হয় হাতের ইশারা, দেহভঙ্গি, কুকুরের গায়ে স্পর্শ করে বা এ রকম কোনো ইশারার কমিউনিকেশনের মাধ্যমে। কাজটি ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে মুখে বলতে থাকতে হয়। তাহলেই কুকুর একসময় শিখে ফেলে শব্দটার মানে। গবেষণায় দেখা গেছে, শেখানোর সময় খাবারের, কিংবা আদরের লোভ দেখালে কুকুরকে শব্দ দ্রুত বুঝতে শিখিয়ে ফেলা যায়।

আরও পড়ুন

তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, কুকুর শব্দ করার পাশাপাশি দেহভঙ্গির মাধ্যমেও কিছু বোঝাতে চেষ্টা করে। যেমন একটি কুকুর দ্রুত লেজ নাড়লে সবাই বুঝতে পারে, কুকুরটি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে চাইছে। কুকুরের এসব দেহভঙ্গিরও একটা ভাষা আছে। এই ভাষা তারা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগেও ব্যবহার করে। লেজ নাড়া, মাথা নাড়া, ঘাড় কাত করে তাকানো, গোল গোল চোখ করে তাকানো, কুঁই কুঁই করে বসে পড়া—এই সবকিছুর কিন্তু আলাদা অর্থ আছে। এগুলোও আসলে কুকুরের ভাষার মধ্যে পড়ে। কুকুর দূরের কোনো প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শুধু শব্দের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কাছে থাকলে শব্দের সঙ্গে দেহভঙ্গিও ব্যবহার করে থাকে।

এসব মিলিয়ে কুকুর আসলে অল্প কথার প্রাণী। তার ভান্ডারে আছে অল্প কটি শব্দ (নাকি বাক্য?), আর অল্প কটি দেহভঙ্গি। এ নিয়েই কুকুরের ভাবপ্রবণ যোগাযোগ। যেটা পৃথিবীর সব প্রান্তের কুকুরের ক্ষেত্রেই অনেকটা একই রকম। প্রায় সব জাতের কুকুরের ক্ষেত্রেও এটা প্রায় একই। আর তারা কণ্ঠ বা ভঙ্গি নকল করতে খুবই পছন্দ করে। কুকুরকে তাই নকলবাজ বা কপিক্যাটও বলা হয়ে থাকে। তোমার এলাকার কুকুরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছ কখনো?

আরও পড়ুন