ডাইনোসর কেন বিলুপ্ত হয়ে গেল

পৃথিবী শাসন করে মানুষ। জল, স্থল, আকাশ—সবখানেই মানুষের ছড়াছড়ি। পৃথিবীতে এমন কোনো দুর্গম জায়গা নেই, যেখানে পা পড়েনি মানুষের। প্রযুক্তির উন্নয়ন আর খাবারের সহজলভ্যতার কারণে সংখ্যাগত দিক থেকে মানুষের বিস্ফোরণ ঘটেছে। বর্তমানে পৃথিবীতে আট বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কাজকর্ম করছে। প্রতিদিনই বাড়ছে মানুষের সংখ্যা।

পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো জাদুঘর। জাদুঘর তোমাকে একটি বিশেষ সময়ের ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে পারে। তোমার মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে, আগে কোন কোন প্রাণী দাপিয়ে বেড়াত পৃথিবীর বুকে? উত্তরটা তোমার জানা থাকার কথা। ভয়ংকর যে প্রাণীর কথা তোমার কল্পনায় আসতে পারে, সেই প্রাণীর কঙ্কাল আছে জাদুঘরে।

ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে সবচেয়ে বড় যে কঙ্কালটি আছে, সেটি একটি তিমির। আকারে বেশ বড়। পৃথিবীর সমৃদ্ধ কোনো জাদুঘরে যদি যাও, বিশেষ করে প্রাণিজগতের জাদুঘরে গেলে দেখতে পাবে ডাইনোসরের ফসিল। কঙ্কালের মতো করে সাজিয়ে রাখা। ছোট-বড় থেকে শুরু করে বিশাল আকারের কঙ্কাল দেখে তোমার বিস্ময় জাগবে। ডাইনোসরের কঙ্কাল দেখলে ধারণা পাবে, কত বড় ছিল এটি।

বহু বছর আগে ডাইনোসরের বিচরণ ছিল পৃথিবীতে। ডাইনোসর নিয়ে অনেক কিছুই জানার আছে। ডাইনোসর শব্দের অর্থ মনস্টার লিজার্ড বা দৈত্যাকার টিকটিকি। প্রাণিজগতের হারিয়ে যাওয়া একটি বৈচিত্র্যময় দল ডাইনোসর। ২৩ দশমিক ১৪ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগে প্রথম আবির্ভূত হয়। জুরাসিক যুগের শুরু থেকে ক্রিটেসিয়াসের শেষ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি বছর ধরে পৃথিবী শাসন করে। শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী এই প্রাণী কিছু কারণে বিলুপ্তির মুখে পড়ে হারিয়ে যায়।

ডাইনোসররা জীবিত অবস্থায় কেমন ছিল, এ সম্পর্কে একদম নির্ভুল তথ্য নেই। শিল্পীরা বিজ্ঞানীদের সরবরাহ করা তথ্য ব্যবহার করে জীবিত ডাইনোসরের অনুমান করে আঁকেন। হাড়ের ওপর ভিত্তি করে আঁকাআঁকি করেন তাঁরা। ডাইনোসরকে বিশাল আকারের সরীসৃপ বলা হলেও এর সঙ্গে পাখির মিল আছে।

ডাইনোসরের টিকটিকির তুলনায় পাখির সঙ্গে বেশি মিল পাওয়া যায়। পৃথিবীতে আজ আর কোনো ডাইনোসর নেই। তারা বিলুপ্ত হয়েছে বহু বছর আগে। পৃথিবীতে মানুষ আর ডাইনোসর কখনো একসঙ্গে বসবাস করেনি। মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

জীবাশ্মের রেকর্ড থেকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জুরাসিক যুগে ডাইনোসর থেকে পাখির উদ্ভব হয়। তাই এখন আমরা পাখিকে ডাইনোসরের উত্তরসূরি হিসেবে ধরে নিতে পারি। কিছু পাখি ৬৬০ লাখ বছর আগে ঘটা বিলুপ্তির ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এদের বংশধরেরা বর্তমানে ডাইনোসরের বংশ হিসেবে টিকে আছে। তাই বলতে পারো, ডাইনোসররা এখনো আমাদের মধ্যে বাস করে!

বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন, একটি সুপার আগ্নেয়গিরির মতো কোনো ভূতাত্ত্বিক ঘটনার কারণে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল। তবে এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান ধারণা অনুযায়ী, ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে মহাকাশ থেকে আসা একটি বিশাল উল্কাপিণ্ডের কারণে। মহাকাশে কোটি কোটি উল্কা বা পাথরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। কিছু উল্কা আকারে বেশ বড়। কিন্তু বেশির ভাগ উল্কা ছোট। অধিকাংশ বালুর দানা এবং বেজবলের মাঝামাঝি আকৃতির। মহাকাশে উল্কাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কিছু উল্কা পৃথিবীর দিকে আছড়ে পড়ে। এ সময় উল্কাটি প্রচণ্ড গতিতে বায়ুমণ্ডলে আঘাত করে। সাধারণত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উল্কা পুড়ে যায়। তবে উল্কার ছোট টুকরা বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে পৃথিবীতে এসে মাটিতে পড়ে, পুড়ে যায় না। এটি খুব বিরল ঘটনা। তবে এটি কখনো কখনো ঘটে। মাটিতে উল্কার টুকরা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

ডাইনোসর বিলুপ্তির ক্ষেত্রে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, মহাকাশ থেকে একটি বিশাল উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে এসে আছড়ে পড়েছিল। যখন উল্কাটি পৃথিবীতে আঘাত হানে, তখন এটি বায়ুমণ্ডলে ধুলাবালু দিয়ে ভরিয়ে ফেলে। বিশাল আকারের বিস্ফোরণ হলে চারপাশ যেভাবে ধুলায় ঢেকে যায়, তেমন। এর ফলে বিশাল আকারের গর্ত তৈরি হয়। ধুলাবালু চারদিকে অনেক বেশি পরিমাণ ছড়িয়ে যাওয়ায় সূর্যের আলো মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এই কারণে পৃথিবীর বেশির ভাগ উদ্ভিদ মারা যায় এবং তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম অনেকবার ঘটেছে বলে মনে করা হয়। যেসব প্রাণী এই অবস্থায় মানিয়ে নিতে পারেনি, আকাশ পরিষ্কার হওয়ার আগেই তারা মারা গেছে। এভাবেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে কি না, এখনো নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। যদিও ভূতাত্ত্বিকেরা অন্তত একটি খুব বড় গর্ত আবিষ্কার করেছেন, যা ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়ার সময় উল্কাপিণ্ডের প্রভাবে তৈরি হয়েছে।

পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্যে ডাইনোসরের জীবাশ্ম বা হাড় চাপা পড়ে আছে। জীবাশ্মবিদেরা ডাইনোসরের হাড় থাকতে পারে, এমন একটি এলাকা খুঁজে পেলে খননের যন্ত্রপাতি নিয়ে এগিয়ে যান। এরপর খুব সাবধানে খনন শুরু করেন। খননের জন্য তাঁরা সরল যন্ত্র ব্যবহার করেন। জীবাশ্মের চারপাশের পাললিক শিলা ধীরে ধীরে সরানোর জন্য ধারালো ছোট ছুরি আর ছোট ব্রাশ ব্যবহার করেন। একটি হাড় খনন করতে কখনো দিন, এমনকি সপ্তাহও লেগে যায়। এটি একটি ধীরগতির কাজ। তবে উত্তেজনাপূর্ণ। পৃথিবীতে ১০ কোটি বছর ধরে পাথরের নিচে চাপা পড়ে থাকা হাড়টিকে উন্মোচন করার চেষ্টার কাজটি অবশ্যই উত্তেজনাপূর্ণ।

ভূত্বকের নিচে চাপা পড়া অনেক ডাইনোসরের হাড় একসঙ্গে মিশে যেতে পারে। কোন হাড় কোন ধরনের ডাইনোসরের, তা নির্ধারণ করতে গোয়েন্দাদের মতো করে অনুসন্ধান করেন জীবাশ্মবিদেরা। এক সূত্র থেকে আরেক সূত্রে সামনে এগিয়ে যান। কখনো কখনো তাঁরা সত্যিকার গোয়েন্দাদের দক্ষতাও ব্যবহার করেন!

আর্কিওপ্টেরিক্স লিথোগ্রাফিকা নামের ডাইনোসরটির সঙ্গে বর্তমান পাখির খুব মিল পাওয়া যায়। এই ডাইনোসর মেসোজোয়িক যুগ নামে পরিচিত। আর্কিওপ্টেরিক্সের পাখির মতো ডানা এবং হাড়যুক্ত লম্বা লেজ ছিল। জার্মানির বার্লিন মিউজিয়ামে সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তুগুলোর মধ্যে একটি এই ডাইনোসর। মানুষ যেমন পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে, ডাইনোসরও তেমন। পৃথিবীর সবখানে চরে বেড়াত ডাইনোসর। সব কটি মহাদেশে ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া গেছে।

২ হাজার ৩০০ লাখ বছর আগে যখন ডাইনোসরের উদ্ভবের সময় পৃথিবী এখনকার মতো ছিল না। মহাদেশগুলো তখন একসঙ্গে ছিল। যাকে বলে প্যানজিয়া। প্যানজিয়াকে একটি সুপারমহাদেশ বলা যায়। ডাইনোসর ১ হাজার ৬৫০ লাখ বছর ধরে পৃথিবীতে বাস করেছে। এরপর সুপারমহাদেশটি ধীরে ধীরে ভেঙে আলাদা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। আস্তে আস্তে মহাদেশগুলো একটি থেকে আরেকটি সরে যাচ্ছে! এত আস্তে-ধীরে সরছে, বোঝা যায় না।

ডাইনোসরের একটি দলের কঙ্কাল আবিষ্কার হয় বেলজিয়ামে। ১৯ শতকের শেষের দিকের ঘটনা। বেলজিয়ামের বার্নিসার্টের একটি কয়লাখনিতে পাওয়া যায় ইগুয়ানোডন ডাইনোসরের কঙ্কাল। ৩২২ মিটার মাটির নিচে ৩০টি ইগুয়ানোডন কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। যার প্রায় সব হাড় অক্ষত ছিল। হাড়গুলো ঠিকভাবে সাজানো ছিল। তাই কঙ্কালগুলো খুব জীবন্ত হিসেবে যখন দেখানো হয়, সারা বিশ্বের মানুষ খুব আকৃষ্ট হয়।

টাইটানোসর হলো এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় ডাইনোসর। এই ডাইনোসর এত বড় ছিল, আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির একটি বিশাল গ্যালারিতে এর কঙ্কাল রাখার জায়গা হচ্ছিল না। সামনের পায়ের আকারের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়েছে, টাইটানোসরের কাঁধ মাটি থেকে ২০ ফুট (৬ মিটার) উঁচু ছিল। সোজা দাঁড়িয়ে ডাইনোসরটি খুব সহজে একটি পাঁচতলা ভবনের জানালায় উঁকি দিতে পারবে! ডাইনোসর কীভাবে এত বড় হলো? এ নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। যেমন উচ্চ অক্সিজেন ঘনত্ব এবং প্রচুর পরিমাণে খাদ্য। তবে এটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে বিতর্কিত। এর পেছনে কিছু রহস্য অজানা রয়ে গেছে। সব ডাইনোসর বড় ছিল না। বিভিন্ন আকারের ডাইনোসর পাওয়া যেত। যাদের অভ্যাস বিভিন্ন ধরনের। যেমন টি-রেক্স মাংস পছন্দ করত। জিরাফাটাইটান নামের ডাইনোসর একা একা গাছপালা খেতে ভালোবাসত।

ডাইনোসরের কথা ভাবলেই আমরা বিশালাকার যে প্রাণীর কথা ভাবি, সব ডাইনোসর তেমন বিশাল আকারের ছিল না। কিছু ডাইনোসর সত্যিই ছোট ছিল। যেমন কমসোগনাথাস ডাইনোসর। ছোট্ট এই ডাইনোসর মাত্র দুই ফুট লম্বা ছিল। এর ছিল পাখির মতো দুটি ছোট পা।

ডাইনোসররা যখন পৃথিবীর স্থলভাগ শাসন করত, তখন সমুদ্র ও আকাশ কাদের দখলে ছিল? তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। প্লেসিওসর নামের একটি সামুদ্রিক সরীসৃপের কথা জানা যায়। যারা ডাইনোসরের মতো একই সময়ে সমুদ্রে বাস করত। প্রায় ৬ দশমিক ৬ কোটি বছর আগে ডাইনোসরদের সঙ্গে এরাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের শরীরের দুই পাশে শক্তিশালী প্যাডেলের মতো পাখনা ছিল। এগুলো ব্যবহার করে চলাচল করত প্লেসিওসর।

ডাইনোসর কেন বিলুপ্ত হয়ে গেল? ইতিহাসে বেশ কয়েকবার উল্কাপাতের আঘাতে পৃথিবীতে প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়েছে। প্রায় ৬ দশমিক ৬ কোটি বছর আগে মেক্সিকোর ইউকাটানে একটি উল্কা আঘাত হেনেছিল। সম্ভবত এটিই ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণ। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণ এখনো রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, রোগব্যাধি এবং ভূতাত্ত্বিক কোনো ঘটনার যেকোনো কারণ অথবা সব কটি কারণই হতে পারে। ডাইনোসরের বিলুপ্তি নিয়ে এখন অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তোমার কী মনে হয়? ডাইনোসরকে কি কোনো প্রাণী হত্যা করেছিল? কেন বিলুপ্ত হলো এই বিশালাকার প্রাণী?