অরোরা কী, কীভাবে এটি দেখা যায়
২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড় পৃথিবীতে আঘাত হেনেছে। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আকাশে দেখা যাচ্ছে বর্ণিল আলো—অরোরা বা মেরুজ্যোতি। চলো জেনে আসা যাক, এই অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টিরহস্য।
অরোরার প্রভাবে আকাশে দৃশ্যমান হয় আলোর খেলা। দিনের বেলায় হালকাভাবে দৃশ্যমান হলেও রাতে অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। এতে সবুজ, লাল, নীল, গোলাপিসহ নানা বর্ণের সমাবেশ ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সবুজ আলো। দেখে যে কারও মনে হতে পারে যে আকাশে বসে কেউ একজন অদৃশ্য চামচ দিয়ে সবুজাভ ঘন স্যুপ রান্না করছে। ভাষায় এর সৌন্দর্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভাইকিংরা একে ধরে নিত পৃথিবীর কোনো প্রান্তে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধের নিদর্শন হিসেবে। অন্যান্য সভ্যতার মানুষেরাও মেরুজ্যোতিকে নিজেদের মতো করে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করত। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে আড়ালেই ছিল এর সৃষ্টিরহস্য। তবে আধুনিক বিজ্ঞান খুঁজে পেয়েছে সেই রহস্যের সমাধান।
করোনাল মাস ইজেকশন
মেরুজ্যোতির দেখা পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো উপযুক্ত আবহাওয়া। তবে সেটা শুধু পৃথিবীতে হলে হবে না, হতে হবে মহাশূন্যেও। মহাশূন্যের আবহাওয়ার অন্যতম নিয়ামক হলো সূর্য। যদি সূর্যকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে এর পৃষ্ঠে কিছু কালো দাগের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এদের বলা হয় সৌরকলঙ্ক বা সানস্পট। পর্যায়ক্রমিকভাবে এদের সংখ্যায় তারতম্য হয়। সৌরকলঙ্কের জায়গাগুলোয় খুব শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের অস্তিত্ব থাকার কারণে এরা খুব সক্রিয় হয়। নির্দিষ্ট বিরতিতে এগুলো থেকে প্রচুরসংখ্যক বিভিন্ন ধরনের কণা ছিটকে বাইরে চলে আসে। কণাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রোটন, ইলেকট্রন, হিলিয়াম নিউক্লিয়াস (আলফা কণা) ইত্যাদি। এ ঘটনার নাম করোনাল মাস ইজেকশন। সৌরকলঙ্কের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে মোট নিঃসারিত কণার সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। নিঃসরণের পর কণাগুলো মহাশূন্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসে পৌঁছায় পৃথিবীতে। সামগ্রিকভাবে কণাগুলোকে একসঙ্গে ডাকা হয় সৌরবাতাস। সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক নিয়মেই অসংখ্য কণা পৃথিবীতে আসে। এই সব নিয়মিত কণা আর করোনাল মাস ইজেকশনের মাধ্যমে উৎপন্ন অস্বাভাবিকসংখ্যক কণা—উভয়ই সৌরবাতাসের অংশ। সৌরবাতাস যদি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পরিণত হয় সৌরঝড়ে। এরা উভয়ই অরোরার মূল চাবিকাঠি। পৃথিবীতে এদের মাধ্যমে বয়ে আসা চার্জিত কণাগুলোর মাধ্যমেই শুরু হয় অরোরা সৃষ্টির প্রক্রিয়া।
পৃথিবীতে আবহাওয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করলে সব সময় সেগুলোকে মিলতে দেখা যায় না। বিশেষ করে বাংলাদেশে। এ জন্য অবশ্য শুধু আবহাওয়াবিদদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। উন্নত যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণ রয়েছে এর পেছনে। তবে পৃথিবীর ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকলেও মহাশূন্যের আবহাওয়া নিয়ে এমন কোনো বিড়ম্বনা নেই। বিজ্ঞানীদের করা ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কারণ, সৌরবাতাস পৃথিবীতে পৌঁছাতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। এদের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৯ লক্ষ মাইল। এই বেগ নিয়ে পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে প্রায় ১৮ ঘণ্টা। তাই একরকম নিশ্চিত হয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন বিজ্ঞানীরা।
চৌম্বকক্ষেত্রের ফাঁকফোকর
সৌরবাতাসে থাকা বিকিরণ পৃথিবীর জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যদি এরা কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হয়ে সরাসরি পৃথিবীতে চলে আসে, তাহলে এদের প্রভাবে সমগ্র জীবজগৎ বিলুপ্ত পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে পৃথিবীর নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আমাদের প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে এমন পরিস্থিতি থেকে। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মূল হাতিয়ার হলো, পৃথিবীকে ঘিরে থাকা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ও এর বায়ুমণ্ডল। পৃথিবী নিজেই একটি বিশাল চুম্বক। এর প্রভাবেই কোনো দণ্ডচুম্বককে দড়ি দিয়ে মুক্তভাবে ঝুলিয়ে দিলে সেটি সর্বদা উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে মুখ করে থাকে। পৃথিবীর এই চৌম্বকক্ষেত্রের উৎস কী?
পৃথিবীর কোরের (Core) ভেতরের অংশে বল আকৃতিতে প্রচুর পরিমাণ কঠিন লোহার অস্তিত্ব আছে। এদের থেকে উৎপন্ন তাপ ও পরিপার্শ্বের প্রচণ্ড চাপের প্রভাবে কোরের বাইরের অংশে থাকা আয়রন পরিণত হয় তরল পদার্থে। এই গলিত আয়রন পৃথিবীর অভ্যন্তরে চলমান অবস্থায় থাকে। ফলে উৎপন্ন হয় শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র। এরাই প্রতিনিয়ত সূর্যের ক্ষতিকর কণা ও বিকিরণ থেকে রক্ষা করে চলেছে জীবজগৎকে।
সৌরবাতাসে থাকা চার্জিত কণাগুলো চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে ছিটকে বাইরের দিকে চলে যায়। তবে মজার ব্যপার হলো, ঢাল স্বরূপ এই চৌম্বকক্ষেত্র কিন্তু একেবারে নিখুঁত নয়। দুটি স্থানে এদের দুর্বলতা রয়েছে। সেগুলোর অবস্থান উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। এই দুই জায়গায় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের বলরেখাগুলো স্পর্শ করে বায়ুমণ্ডলকে। তাই এসব জায়গা দিয়ে সৌরবাতাসের চার্জিত কণাগুলোর খুব সামান্য পরিমাণ অংশ প্রবেশ করতে পারে বায়ুমণ্ডলে। ব্যপারটা অনেকটা এমন যে চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হওয়ার সময় কিছু পরিমাণ চার্জিত কণা আটকা পড়ে যায় এর ভেতরে। কণাগুলো ক্ষেত্রের বলরেখা বরাবর পরিভ্রমণ করে একসময় পৌঁছে যায় পৃথিবীর দুই মেরুতে। বিষুব অঞ্চলে বলরেখাগুলো বায়ুমণ্ডলকে স্পর্শ না করার কারণে সেখানে পৌঁছাতে পারে না কণাগুলো। নিচের ছবিটি দেখলে বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যাবে।
আলোর খেলা
চার্জিত কণাগুলো মেরু অঞ্চলে প্রবেশ করার পর সেখানকার বায়ুমণ্ডলে থাকা পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর মাধ্যমে কণাগুলোর শক্তি স্থানান্তরিত হয় পরমাণুগুলোর মধ্যে। তখন পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনগুলো লাফ দিয়ে ওপরের শক্তিস্তরে চলে যায়। সেখানে খুব অল্প সময় অবস্থানের পর ফোটন বিকিরণ করে পুনরায় আগের স্থানে ফিরে যায়। উৎপন্ন ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে পরমাণুর শক্তিস্তরগুলোর মধ্যকার শক্তির পার্থক্যের ওপর। এর মানে হলো, ইলেকট্রন শুরুতে যে স্তরে ছিল এবং সংঘর্ষের পরে যে শক্তিস্তরে যায়, তাদের মধ্যকার শক্তির পার্থক্যের ওপর। আবার ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় দৃশ্যমান আলোর বর্ণ। আমরা জানি, বাতাসের মূল উপাদান নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। বাকিগুলোর পরিমাণ খুব নগণ্য। তাই সৌরবাতাসের মাধ্যমে আগত চার্জিত কণাগুলোর সঙ্গে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাব্যতা সবচেয়ে বেশি। নাইট্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে উৎপন্ন ফোটনের বর্ণ হয় লালচে। আর নাইট্রোজেন আয়নের সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে পাওয়া যায় গাঢ় নীল বা গোলাপি বর্ণ। অন্যদিকে অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের আলো—লাল অথবা সবুজ পাওয়া যায়।
অক্সিজেন পরমাণু থেকে আলাদা দুটি বর্ণের আলো পাওয়ার কারণ কী? এগুলোতে সংঘর্ষের মাধ্যমে প্রাপ্ত শক্তির ব্যবহার করে ওপরের শক্তিস্তরে গমন করা ইলেকট্রনের, পুনরায় আগের স্তরে ফিরে আসার সময়ের তারতম্য হওয়ার কারণেই এমনটা হয়। সাধারণত খুব দ্রুত ইলেকট্রনগুলো শক্তি বিকিরণ করে নিচের শক্তিস্তরে ফেরত চলে আসে। যখন ফিরে আসার সময়কাল এক সেকেন্ডের কম হয়, তখন পাওয়া যায় সবুজ বর্ণের অরোরা। অন্যদিকে অক্সিজেন পরমাণুতে ইলেকট্রন ফিরে আসতে বেশি সময় লাগলে পাওয়া যায় লাল বর্ণের অরোরা। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৫০ কিলোমিটারের ওপর দেখা মেলে এদের। এই উচ্চতায় অক্সিজেন পরমাণুর ঘনত্ব বেশ কম থাকে। তাই চার্জিত কণার সঙ্গে এদের সংঘর্ষের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। এতে করে ইলেকট্রনগুলোর ওপরের শক্তিস্তরে বেশি সময় ধরে থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাদের গড় অবস্থানকাল দাঁড়ায় প্রায় ১০০ সেকেন্ডে। ফলে দেখা পাওয়া যায় লাল বর্ণ প্রদর্শনকারী ফোটন। অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের ১০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় সবুজ বর্ণের অরোরা। কারণ, সেখানে অক্সিজেন পরমাণুর আধিক্য অনেক বেশি। চার্জিত কণার সঙ্গে সংঘর্ষের মাত্রা বেশি হওয়ায় সেখানকার অক্সিজেন পরমাণুর (অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে অক্সিজেন অণুকে মিলিয়ে ফেলো না। নিশ্বাসের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে অক্সিজেন অণু, পরমাণু নয়। দুটি অক্সিজেন পরমাণু মিলে তৈরি হয় একটি অক্সিজেন অণু। ভূপৃষ্ঠের কাছে এদের মাত্রা পর্যাপ্ত পরিমাণ থাকে।) উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলোর পক্ষে ওপরের শক্তিস্তরে বেশি সময় ধরে থাকা সম্ভব হয় না। সেখানে ইলেকট্রনের গড় অবস্থানকাল হয় শূন্য দশমিক ৭ সেকেন্ড। এরপর তারা দ্রুত ফোটন নিঃসরণ করে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এ সময় পাওয়া যায় সবুজ বর্ণের অরোরা। আরও নিচে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বে অক্সিজেন পরমাণুর ঘনত্ব অনেক কমে যায়। তাই এর মাধ্যমে কোনো বর্ণের ফোটনই পাওয়া সম্ভব হয় না।
বায়ুমণ্ডলের ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে আধিক্য থাকে নাইট্রোজেন পরমাণু ও নাইট্রোজেন আয়নের। তাই সেখানে উৎপন্ন হতে পারে লালচে, গাঢ় নীল অথবা গোলাপি বর্ণের। মোটামুটি এভাবেই পাওয়া যায় নানা বর্ণের অরোরা। যেগুলো উত্তর অক্ষাংশে সুমেরুজ্যোতি আর দক্ষিণ অক্ষাংশে কুমেরুজ্যোতি নামে পরিচিত।
লেখাটি আদর্শ থেকে প্রকাশিত লেখকের ‘মজার পদার্থবিজ্ঞান’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে।