গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো
‘নিউরনে অনুরণন’ নামে একটি কলাম ছাপা হতো প্রথম আলোয়। এ কলামে একটা করে সমস্যা দেওয়া থাকত, কিন্তু কখনো এর সমাধান ছাপা হতো না। সমাধানের জন্য একটি ঠিকানা দেওয়া থাকত, এ ঠিকানায় পাঠকেরা সমস্যার সমাধান করে চিঠি পাঠাত। সেই সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত কোথাও ছাপা হয়নি। কিন্তু পরে সমস্যাগুলো নিয়ে দুটি বই ছাপা হয়েছে। বলা যায়, বাংলায় গণিত অলিম্পিয়াডের প্রথম দুটি বই হয়েছে এই দুটিই!
এরপর ২০০২ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম গণিত উৎসব শুরু হয়। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে এ বছর ২০২৫ সালের গণিত উৎসব শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। বিরতিহীনভাবে এই উৎসব আয়োজিত হচ্ছে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা ও ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায়।
বাংলাদেশের গণিত উৎসব পৃথিবীর সব দেশের গণিত অলিম্পিয়াড থেকে আলাদা। আমরা এটিকে উৎসব বলি। এর প্রধান কারণ আমাদের উদ্দেশ্য কেবল আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ বা পদক পাওয়া নয়, বরং গণিত শেখাকে আনন্দময় করে তোলা। মুখস্থকে ‘না’ বলে সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জন করতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। এ কারণেই আমরা গণিত অলিম্পিয়াড না বলে উৎসব বলি।
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক গণিত উৎসবে অংশ নেয় ২০০৫ সালে। প্রথম পদক অর্জন করে ২০০৯ সালে সামিন রিয়াসাত ও নাজিয়া চৌধুরী ব্রোঞ্জপদক অর্জন করেন। ২০১২ সালে প্রথম রৌপ্যপদক অর্জন করেন ধনঞ্জয় বিশ্বাস। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক অর্জন করেন আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী।
এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের মোট অর্জন ৪৪টি অনারেবল মেনশন, ৩৭টি ব্রোঞ্জপদক, ৭টি রৌপ্যপদক ও ১টি স্বর্ণপদক।
২০০৫ সালের প্রথম আন্তর্জাতিক গণিত উৎসবে বাংলাদেশ টিম মাত্র ৩ নম্বর স্কোর করতে সক্ষম হয় এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১১৫ নম্বর স্কোর করে।
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেওয়া সব শিক্ষার্থীই পরে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এমআইটি, হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, কেমব্রিজ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। শিক্ষা–পরবর্তী জীবনেও তাঁরা গবেষণা ও প্রযুক্তির অন্যান্য খাতে অবদান রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ গণিত উৎসবে ব্যতিক্রমী কার্যক্রম দিয়ে যা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তা পদক অর্জনের থেকে অনেক অংশে বড় এবং মহৎ। বাংলাদেশের হাজারো শিক্ষার্থী প্রতিবছর গণিতের ভয়কে দূরে সরিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে গণিত উৎসবে অংশ নেয়। স্বপ্নবান কিশোর–তরুণদের মধ্য থেকে ছয়জন শিক্ষার্থী সুযোগ পায় আন্তর্জাতিক পর্বে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু এই ছয়জন ছাড়াও আরও কয়েক হাজার শিক্ষার্থী প্রস্তুত হয় পরবর্তী বছরের উৎসবের জন্য। শীতের আমেজের সঙ্গে সঙ্গে গণিত উৎসবের আমেজ আসে প্রতি ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। শিক্ষার্থীরা আঞ্চলিক ও বিভাগীয় উৎসবে পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র এক ঘণ্টা। দিনের বাকি সময়টা তাদের কাটে প্রশ্নোত্তর পর্ব, গণিতের বই ও অন্যান্য স্টল ঘুরে। থাকে সুডোকু ও নানাবিধ আনন্দ আয়োজন। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গণিত উৎসব প্রাণের মেলায় পরিণত হয়।
জাতীয় গণিত উৎসব চলে দুই দিনব্যাপী। থাকে নানা আয়োজন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন বাংলাদেশি গণিতবিদ, বিজ্ঞানী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা পরিচিত মুখ। শুধু পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গণিত অলিম্পিয়াডকে উৎসবে পরিণত করা একমাত্র বাংলাদেশেই দেখা যায়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতের ভয় দূর করে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন আপনাআপনিই গেঁথে যায়। এই স্বপ্নবান কিশোর–তরুণেরাই বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত করে।
গণিত উৎসবে মোট চারটি ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে
• প্রাইমারি ক্যাটাগরি (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি)
• জুনিয়র ক্যাটাগরি (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি)
• সেকেন্ডারি ক্যাটাগরি (নবম থেকে দশম শ্রেণি)
• হায়ার সেকেন্ডারি (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি)
অনেকগুলো ধাপ পার করে আন্তর্জাতিক গণিত উৎসবের জন্য ছয়জনের গণিত দল নির্বাচন করা হয়।
• অনলাইন বাছাইপর্বের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাছাই করা হয়।
• বাছাইপর্বের বিজয়ীদের নিয়ে আঞ্চলিক ও বিভাগীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
• আঞ্চলিক ও বিভাগীয় পর্বের বিজয়ীদের নিয়ে জাতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
• জাতীয় পর্বের বিজয়ী প্রাইমারি ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রাইমারি গণিত ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।
• জাতীয় পর্বের বিজয়ী জুনিয়র ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের নিয়ে জুনিয়র গণিত ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।
• জাতীয় পর্বের বিজয়ী মেয়েশিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ লীলাবতী গণিত ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।
• জাতীয় পর্বের বিজয়ী সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতীয় গণিত ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।
• জাতীয় গণিত ক্যাম্প থেকে বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক্সটেনশন ক্যাম্প ও টিম সিলেকশন ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।
• বাছাই থেকে শুরু করে টিম সিলেকশন টেস্ট ও এশিয়ান-প্যাসিফিক ম্যাথ অলিম্পিয়াডের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই ছয়জনের দল বাছাই করা হয়।
এই বিশেষ বাছাইপ্রক্রিয়ায় সেরাদের সেরারাই বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। এখন চলছে গণিত উৎসব ২০২৫। উৎসবে অংশ নেওয়া সবার জন্য শুভকামনা।