কিশোর আলোর ৯, করব বিশ্বজয়! এ স্লোগান যখন ধারণ করছি, তখনই সাফ নারী টুর্নামেন্টে নেপাল থেকে চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি নিয়ে ফিরল আমাদের মেয়েরা। পুরো দেশ খুশিতে মেতে উদ্বেল।
বিশ্বজয়ের কথা যখন উঠছেই, দক্ষিণ এশিয়ার সেরাদের নিয়েই তখন কিশোর আলোর জন্মদিন উদ্যাপন করা উচিত। ঢাকায় কিশোর আলো অফিসে শিশু–কিশোরেরা আসবে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে শিশু-কিশোরেরা জমজমাট আসর বসাবে সৃজনশীলতার পসরা নিয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিশোর আলোর জন্মদিনটা উদ্যাপন করতে আমাদের যাওয়া উচিত কলসিন্দুরে।
সাফ নারী দলে ৮ জন খেলেছে শুধু একটা অঞ্চলের, যারা সবাই কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। এটা তো একটা বিস্ময়। এক জায়গা থেকে এত খেলোয়াড় কীভাবে এল!
কথা বললাম সানজিদা, মারিয়া, দুই শামসুন্নাহার, শিউলি, সাজেদা, তহুরা, মারজিয়ার সঙ্গে। বললাম, কী আনব তোমাদের জন্য। ওরা বলল, বেশিক্ষণ থাকবেন। কিছু আনতে হবে না।
এই বাচ্চারা ২০১৫ সালে বেশি করে খাবার চেয়েছিল, আজকে তারা কত এগিয়ে গেছে, নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছে, আবার পরিবারের মুখে হাসি, বুকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। সবাই তাদের নিয়ে গর্বিত।
২০১৫ সালে প্রথম আলোর তথ্যচিত্র ‘অদম্য মেয়েরা’ দেখে ওরা বলেছিল, ‘আমাদের এলাকায় তো কারেন্ট নাই, এই ছবি আমরা দেখব কী করে?’ সে কথা প্রকাশিত হলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ওই এলাকার সব ফুটবলারসহ ৮০৩ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ওই স্কুলে নতুন ভবন ওঠে, উচ্চবিদ্যালয় সরকারি হয়। এবার সানজিদা প্রথম সুযোগেই বলে নিল, ‘মারিয়া মান্দার বাড়িতে যাওয়া কঠিন। সেতু নেই। বর্ষাকালে প্রচণ্ড স্রোত। শীতকালে নৌকা আটকে যায়। ওই পারে হাজার হাজার মানুষ আছে। অসুস্থ রোগীকে পার করা যায় না। ওই পারে মাঠ আছে। আমরা খেলতে যাই। কত কষ্ট হয়। নেতাই নদে সেতু চাই।’
১ অক্টোবর ভোর ৫টায় ঢাকা থেকে রওনা হলাম। বেলা সাড়ে ১১টায় পৌঁছলাম সানজিদার বাড়ি। ওকে নিয়ে চললাম মারিয়ার বাড়ি। ভাঙা রাস্তা। হেঁটে গেলাম নদের তীর। আসলেই ওই নৌকায় ওঠা কঠিন। নদ পাড়ি দিয়ে হেঁটে চললাম মারিয়া মান্দার বাড়ি।
জাতীয় দলের ৮ ফুটবলারের সঙ্গে কলসিন্দুর স্কুলে জড়ো হলাম।। সাজেদা-শিউলি জানাল, তাদের বাড়ি নদ ভেঙে ফেলছে, ব্লক দিতে হবে। এই পারে রাস্তা খারাপ। পাকা রাস্তা চাই। আমি লিখব, কর্তৃপক্ষকে জানাব, সেই কথাটা তাদের দিয়ে এলাম।
৪৫ জন প্রাথমিক আর উচ্চবিদ্যালয়ের নতুন খেলোয়াড়। ছোট ছোট শিশু–কিশোর। জার্সি পরে এসেছে। কিশোর আলোর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল ওরা। ৮ জন আপুর নামে জয়ধ্বনি দিল। তারপর কেক কাটল জাতীয় স্থানীয় শিশু কিশোর তরুণ খেলোয়াড়েরা।
ওদের সবার জন্য আমরা উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম। গামারীতলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খানের নেতৃত্বে ৮ খেলোয়াড়কে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। স্কুলও সংবর্ধনা দেবে। তাঁরা আমাদের আটকালেন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সংবর্ধনায় অংশ নিয়ে আমরা রওনা দিলাম ঢাকার দিকে। ভোর ৫টায় ঢাকা থেকে বেরিয়েছিলাম। বাসায় ফিরলাম রাত দুটোয়। কলসিন্দুর বা ধোবাউড়া কতদূর? জায়গাটা একেবারে গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। ময়মনসিংহ থেকে নিজের গাড়িতেই দুই ঘণ্টা লাগে।
সেই জন্যই ওখানকার মানুষগুলোর অন্তরে কোনো কলুষ নেই। আর এত সাফল্য পাওয়া সানজিদা, মারিয়া, তহুরারা এখনো সারল্য হারায়নি।
কতবার যে কিশোর আলোকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল ওরা।
ওদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম, সাধনা, প্রশিক্ষণ, ডিসিপ্লিন, জয়ের আকাঙ্ক্ষা, প্রতিকূলতাকে জয় করা—এসবই আমরা শিখি সানজিদা-মারিয়া-সাজেদা–তহুরাদের কাছ থেকে।
অক্টোবর ২ তারিখ ঘুম থেকে উঠে দেখি ওদের বার্তা: ঠিকমতো কি ঢাকা পৌঁছেছেন?