তোমার জন্মের এক বছরের মধ্যে এমন কোনো ঘটনা কি তোমার মনে আছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, একদম ছোটবেলার স্মৃতি বড় হয়ে মনে করা যায় না। তবে ছোটবেলায় স্মৃতি তৈরি হয়। শিশুরা কিছু দেখলে মনে রাখতে পারে। বড় হয়ে সেই স্মৃতি ভুলে যায়। জন্ম থেকে প্রথম তিন-চার বছর কোথায় ছিল, কী করেছে, সব ভুলে যায় শিশুরা। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরে ভেবেছেন, কোথায় হারিয়ে যায় এই স্মৃতি? শিশুরা যেহেতু স্মৃতি তৈরি করে, তাহলে কেন আমরা আমাদের শৈশবের প্রথম বছরগুলোর কথা মনে করতে পারি না?
এমআরআই স্ক্যান থেকে দেখা গেছে, শিশু ও টডলারদের (দুই থেকে চার বছর বয়স) মস্তিষ্ক স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সেই স্মৃতি মনে করা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি মস্তিষ্ক-স্ক্যানিং গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এক বছর বয়সী শিশুরাও স্মৃতি তৈরি করতে সক্ষম। এই গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, জীবনের প্রথম কয়েক বছরের ঘটনা মনে রাখতে না পারা সম্ভবত স্মৃতি তৈরির অসুবিধার কারণে ঘটে না, বরং স্মৃতি পুনরায় স্মরণ করতে না পারার কারণে ঘটে।
এই গবেষণার সহ-লেখক ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একজন স্নায়ুবিজ্ঞানী ট্রিস্টান ইয়েটস বলেছেন, ‘সম্ভাবনা আছে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও স্মৃতিগুলো হয়তো আমাদের মস্তিষ্কে থেকে যায়, তবে আমরা সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারি না’।
আমরা মানুষের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করতে পারি না, তবে এটি এখন পর্যন্ত সেরা প্রমাণ—স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে থেকে যায়টার্ক-ব্রাউন
আমরা যত চেষ্টা করি না কেন, প্রাপ্তবয়স্ক হলে শৈশবের প্রথম কয়েক মাস বা বছরের ঘটনা মনে করতে পারি না। দীর্ঘদিন ধরে গবেষকেরা ভেবেছেন, হিপোক্যাম্পাস (মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা স্মৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে) পর্যাপ্তভাবে বিকশিত না হওয়ার কারণে শৈশবের স্মৃতি ভুলে যাই আমরা। এই স্মৃতি ভুলে যাওয়ার কারণ এটিই, নাকি প্রাপ্তবয়স্করা স্মৃতি স্মরণ করতে পারে না—এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে গবেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এই রহস্য উদঘাটনের জন্য ইয়েটস এবং তাঁর সহকর্মীরা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এফএমআরআই) ব্যবহার করে ২৬জন শিশুর মস্তিষ্ক স্ক্যান করেন। যাদের বয়স ৪ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত। গবেষকেরা দুই দফায় শিশুর হিপোক্যাম্পাসের কার্যকলাপ পরিমাপ করেন। পরীক্ষার সময় শিশুদের একটি নির্দিষ্ট কাজ করানো হয়। প্রথমে ২ সেকেন্ডের জন্য একটি নতুন মুখ, বস্তু বা দৃশ্যের ছবি দেখিয়ে শিশুর এফএমআরআই করা হয়। এর প্রায় এক মিনিট পর তাদেরকে সেই একই ছবি আবার দেখিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
গবেষকেরা দেখেন, শিশু নতুন ছবির দিকে তাকালে হিপোক্যাম্পাস বেশি সক্রিয় থাকে। পরে সেই ছবি আবার দেখালে শিশু ছবির দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকে। যেহেতু শিশুরা সাধারণত পরিচিত জিনিসের দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকে, তাই এই ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, তারা যা দেখেছে তা মনে রেখেছে।
হিপোক্যাম্পাসের যে অংশটি স্মৃতি পুনরুদ্ধারের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত, পেছনের সেই (posterior) অংশে স্মৃতি সংরক্ষণ করেছে বেশি। এই গবেষণার সহ-লেখক ইয়েল ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট নিক টার্ক-ব্রাউন বলেছেন, ‘এই গবেষণা দেখায়, শিশুদের স্মৃতি সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে’।
গবেষক ইয়েটস বলেছেন, ‘যদিও আমরা এই কার্যকলাপ সব শিশুর মধ্যেই দেখেছি, তবে ১২ মাসের বেশি বয়সী শিশুদের মধ্যে এটি আরও শক্তিশালী। এটি ইঙ্গিত দেয়, হিপোক্যাম্পাসের স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষমতা একটি পরিবর্তন বিকাশের মধ্য দিয়ে যায়’। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যামি মিল্টন বলেছেন, ‘এত ছোট শিশুদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। তবে এটি স্পষ্টভাবে বোঝায়, অপরিণত হিপোক্যাম্পাস অন্তত কিছু পরিমাণে স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে’।
টার্ক-ব্রাউন মনে করেন, তাই প্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে নিজেদের শৈশবের প্রথম বছরগুলোর স্মৃতি মনে করতে না পারাটা আসলে পুনরুদ্ধারের (recall) সমস্যা বলে মনে হচ্ছে। এটি সম্ভবত ‘স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল এবং আমাদের মস্তিষ্ক সেই স্মৃতি খুঁজে পাওয়ার জন্য যে সংকেত বা অনুসন্ধান পদ্ধতি ব্যবহার করে, তার মধ্যে অমিলের কারণে ঘটে’।
এর কারণ হতে পারে, শিশুর অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতার তুলনায় এত আলাদা যে, শৈশবে মস্তিষ্ক যা দেখে বা শোনে, তা যথাযথভাবে ঘটনা অনুযায়ী সাজাতে পারে না। ইয়েটস বলেছেন, ‘শুধু হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শেখার পরিবর্তনই পুরো দুনিয়ার প্রতি শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে’।
ইঁদুরের ওপর করা গবেষণাগুলোও ইঙ্গিত দেয়, শৈশবের স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে বহু বছর ধরে থেকে যেতে পারে। ২০১৬ সালের এক গবেষণায়, স্নায়ুবিজ্ঞানীরা অপ্টোজেনেটিকস (optogenetics) নামক একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুরের মস্তিষ্কে ছানা অবস্থার স্মৃতিগুলো সক্রিয় করেছিলেন। এটি দেখিয়েছে, স্মৃতিগুলো সেখানে সংরক্ষিত ছিল। টার্ক-ব্রাউন বলেছেন, ‘আমরা মানুষের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করতে পারি না, তবে এটি এখন পর্যন্ত সেরা প্রমাণ—স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে থেকে যায়’।
সূত্র: নেচার