সাপের নাম চন্দ্রবোড়া, ভয়ের নাম ভাইপার

রাসেলস ভাইপারছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৬টি প্রজাতি বিষধর। বাকি ৬৮ প্রজাতির সাপের বিষ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর দেশে সাপ প্রায় ৯ লাখ মানুষকে ছোবল দেয়। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ জন মারা যান, বছর শেষে সেই হিসাব ছয় হাজারে গিয়ে ঠেকে।

সর্পকুলের সবচেয়ে অলস সাপ চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া। অনেকটা কুম্ভকর্ণের মতো। ঘুম তার খুব পছন্দ। ক্ষুধায় একেবারে কাতর না হলে সে নড়াচড়ার ধার ধারে না। চুপচাপ পড়ে থাকে এক জায়গায়। এমনকি খুব বাধ্য হয়ে কাউকে কামড় দিতে হলে কামড়ের পরও সে অন্য সাপদের মতো পালিয়ে যায় না। তাই তাকে ধরা আর মারা তুলনামূলকভাবে সহজ। হুজুগে প্রচারণার কারণে চন্দ্রবোড়া এখন সারা দেশে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তার দিনকাল মোটেও ভালো যাচ্ছে না। মানুষ এখন সাপ দেখলেই মনে করছে, রাসেলস ভাইপার। প্রায় প্রতিদিনই বাচ্চাকাচ্চাসহ নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ হারাচ্ছে অলস এই সাপ। নির্বিচার সর্পনিধন যে ভালো কাজ নয় এবং পরিবেশের ওপর তার যে একটা সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়বে, সেটা আমাদের জানা। এই ব্যাপারে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষকসহ সব পরিবেশবিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিলেও সর্পনিধন বন্ধ হচ্ছে না ।

সাপ ইঁদুর খেয়ে ফসল সুরক্ষা করে, আবার তার বিষ অনেক ওষুধের কাঁচামাল। হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী, এমনকি ব্যথানাশক নানা ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। বেজি, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল সাপ খায়। আবার শঙ্খচূড়, গোখরা, কেউটে, গুইসাপ—এই সাপগুলোও চন্দ্রবোড়াসহ অন্য সাপ খেয়ে ফেলে। কিন্তু বন্য প্রাণী দেখলেই তা নিধন করার প্রবণতার কারণে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে শিকারি প্রাণী কমে গেছে। ফলে অলস এই সাপ আগের চেয়ে বেশি নজরে পড়ছে। এভাবে সাপ মারলে তা খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে আরও অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

কীভাবে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া রাসেলস ভাইপার হলো

স্কটিশ জীববিজ্ঞানী ও সরীসৃপ-বিশেষজ্ঞ স্যার প্যাট্রিক রাসেল আমাদের এই উপমহাদেশে আসেন সতেরো শতকের শেষের দিকে। সাপের শ্রেণিবিন্যাস বা ক্যাটালগিংয়ের কাজে তিনি এসেছিলেন। বলা হয়, তিনিই প্রথম কাগজে-কলমে এ অঞ্চলের সাপের পরিচিতি নথিভুক্ত করেছিলেন। তাঁর দেখা সাপের মধ্যে একটু অন্য রকম সাপ চন্দ্রবোড়াও ছিল। আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তাঁর নাম জুড়ে দেন এই সাপের সঙ্গে। সেই থেকে বইয়ের পাতায় চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আর সাপুড়েরা এটাকে এখনো চন্দ্রবোড়া বলেই ডাকেন।

চন্দ্রবোড়া কতটা বিষধর

সামাজিক মাধ্যমে অনেকে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাবি করছেন, চন্দ্রবোড়া নাকি পৃথিবীর পঞ্চম বিষধর সাপ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে এটা মারাত্মক প্রথম ৩০ সাপের মধ্যেও নেই; বরং এটির অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা সাপের পরে। গোখরা সাপ কামড়ানোর পর চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়ার কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্য কোনো অসুস্থতা না থাকলে এ সাপের কামড়ে ৭২ ঘণ্টার আগে রোগী সহজে মারা যান না। বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (২০০৮-০৯) এবং দেশের প্রখ্যাত সর্পদংশন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ মনে করেন, চন্দ্রবোড়া নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, অধ্যাপক ফয়েজ ১৯৭৮ সাল থেকে সর্পদংশনের ওপর গবেষণা করে আসছেন। তাঁর মতে, মানুষ ওঝার কাছে গিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করার কারণে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

সময়মতো সঠিক চিকিৎসা বলতে কী বোঝায়

যেকোনো বিষধর সাপ কামড়ালে ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার অ্যান্টিভেনম শরীরে প্রবেশ করাতে পারলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়। এটাই হচ্ছে সময়মতো সঠিক চিকিৎসার প্রথম এবং একমাত্র শর্ত। তাই একে বলা হয় ‘গোল্ডেন রুল অব ওয়ান হান্ড্রেড’। আমাদের দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ায় অনেক বেশি বিষধর সাপ আছে। গোল্ডেন রুল মেনে চলার কারণে সেখানে সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় পাঁচ বছরে দুই থেকে তিনজনের। আসলে আমাদের দেশে এখনো বহু মানুষ সাপে কাটার পর ডাক্তারদের চেয়ে ওঝা কিংবা ঝাড়ফুঁকের ওপর বেশি ভরসা রাখেন। ফলে রোগীর গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট (গোল্ডেন আওয়ার) বিনা চিকিৎসায় নষ্ট হয়ে যায়। সমীক্ষা অনুযায়ী, সাপে কাটা রোগীদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ সময়মতো সরকারি হাসপাতালে আসেন।

হঠাৎ এত সাপ কেন

সাপ লোকালয়ের প্রাণী নয়। সে জলাভূমির কাছাকাছি থেকে তার খাবার (পোকামাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুর ইত্যাদি) সংগ্রহ করে। তবে বর্ষাকালের শুরুতে সে শুকনা জায়গার খোঁজে বের হয়। আবার বর্ষাকাল সাপের প্রজননকাল, তাই যেখানে বন্যার পানি উঠবে না, এমন একটা নিরাপদ স্থানের খোঁজে তার চলাফেরা বেড়ে যায়। বর্ষায় সাপের প্রধান খাদ্য ছিল ব্যাঙ। ব্যাঙের পা রপ্তানির নামে আমরা একসময় দেশকে ব্যাঙশূন্য করে ফেলেছিলাম। ব্যাঙ পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করত। ব্যাঙের অবর্তমানে নানা ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক আমাদের কৃষির অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়। এসব কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সাপকে এক ভয়াবহ খাদ্যসংকটে ফেলে দিয়েছে। এসব কারণে প্রতিবছর বর্ষার সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সাপ আমাদের চোখে পড়ে। বেড়ে যায় সাপের কামড়ের ঘটনা। মুঠোফোনের কল্যাণে এখন হাতে হাতে ক্যামেরা থাকায় মুহূর্তের মধ্যে সর্পকাণ্ডের নানা ছবি সহজেই ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ছড়িয়ে দেওয়ার সময় অনেক শোনা কথা বা কাল্পনিক, কিন্তু ভয় লাগানো তথ্য যোগ করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সাপ বাড়ুক না বাড়ুক, আতঙ্ক বাড়ছে।

কিছু কাল্পনিক তথ্য

‘চন্দ্রবোড়া আগে ছিল না, অন্য দেশ থেকে এসেছে।’

‘খুবই আগ্রাসী সাপ, তেড়ে এসে কামড় দেয়।’

‘মহা বিষধর সাপ।’

‘চিকিৎসা নেই।’

বলা বাহুল্য, এর কোনোটারই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। চন্দ্রবোড়া এ দেশে সব সময় ছিল। আগে মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০০০ সালে অভূতপূর্ব বন্যার পর এটা ক্রমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই বন্যায় মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক প্রজাতির সাপও ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশে চলে আসে। অলস এই সাপ কচুরিপানায় ভেসে ভেসে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চলে যায়।

১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরুর উপায় কী

সাপ কামড় দেওয়ার পর কমপক্ষে এক ঘণ্টার মধ্যে যেখানে সাপে কাটার চিকিৎসা আছে, সেখানে পৌঁছাতে হবে, যেন পরবর্তী ৪০ মিনিটের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করা যায়।

সময়মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছানোটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঝিনাইদহের আবদুল্লাহ মারুফ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজ উদ্যোগে এগিয়ে এসে সারা দেশে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুণ্ডুসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় মারুফ এতটাই জনপ্রিয় যে কাউকে সাপে কাটলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে ফোন আসে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার অনেকের কাছেই তাঁর মুঠোফোন নম্বর আছে। খবর পাওয়ামাত্র মোটরসাইকেলে ছুটে আসেন মারুফ। রোগীর বাড়ি গিয়ে মারুফ শুরুতেই রোগীকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাপড় দিয়ে আক্রান্ত স্থানটি বাঁধা, কোন হাসপাতালে গেলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে, তা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেন। কোন হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে এবং কোথায় চিকিৎসক প্রস্তুত আছেন, তারও খোঁজ নেন তিনি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সাপে কাটা মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন তিনি।

আমাদের তরুণসমাজ থেকে হাজার হাজার মারুফ বেরিয়ে আসতে পারেন। উদ্যোগ নিতে পারেন মানুষকে বাঁচানোর।

সাপ কামড়ালে যা করা উচিৎ এবং যা করা উচিৎ না

১. ওঝার কাছে যাবে না।
২. হাতে ঘড়ি বা চুড়ি, বালা থাকলে খুলতে হবে।
৩. কামড়ের স্থানে ঠান্ডা, গরম, বরফজল বা কেমিক্যাল দেবে না। কেটে বিষ বের করা যাবে না।
৪. কাছাকাছি হাসপাতাল যেখানে সাপের কামড়ের চিকিৎসার ওষুধ অ্যান্টিভেনম সিরাম, অ্যাট্রপিন নিওস্টিগামিন, অ্যাড্রেনালিন পাওয়া যায় সেখানে যেতে হবে।
৫. রোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে। অযথা আতঙ্কিত হওয়া যাবে না।
৬. রোগীকে নড়াচড়া করানো যাবে না।
৭. ১০০ মিনিটে ১০টি অ্যান্টিভেনম নিতে হবে, তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। সাপ কামড়ানোর চিকিৎসায় প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৮. হাসপাতালে গিয়ে দালাল নয়, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলো।
৯. কামড়ানো স্থানটিতে কোনো বাঁধন না দেওয়াই ভালো।
১০. গ্রামাঞ্চলে দ্রুত রোগী পরিবহনের জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহার করা যেতে পারে। মোটরসাইকেলের চালক, মধ্যে রোগী ও পেছনে একজন রোগীকে ধরে বসবেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসপাতালে যাবেন।
১১. কামড়ের স্থানে কোনো ফাস্ট এইড ব্যবহার না করাই ভালো।
১২. হাসপাতালে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। ১৩. ডাক্তার রোগীকে রেফার করলে রোগীকে কোন হাসপাতালে রেফার করলেন, তা ভালো করে জেনে তারপর যেতে হবে।

নিয়মিতভাবে ওষুধের প্রাপ্যতা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দাবি করে, সারা দেশের ৮০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়েছে। একটা গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া উচিত, কোন হাসপাতালে কত ওষুধ মজুত আছে। হাসপাতালগুলোর সামনে একটা চিহ্ন দিয়েও জানিয়ে দেওয়া যায় ওষুধের প্রাপ্যতার কথা।

বাংলাদেশে ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশি সাপের বিষে অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা চলছে। এই কাজ বেগবান করতে হবে।

ওষুধের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত জনশক্তির দিকেও নজর দিতে হবে। দেশের বেসরকারি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয় না। তাঁদেরকেও এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

আরও পড়ুন