বাদুড় কেন উল্টোভাবে ঝোলে
বাদুড় সবসময় উল্টোভাবে ঝুলে থাকে। ছবি: গেটি ইমেজ
বাদুড়কে কখনো উল্টোভাবে ঝুলে থাকতে দেখেছ? আচ্ছা এই প্রশ্ন করার আগে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি কখনো বাদুড় প্রাণীটা নিজ চোখে দেখেছ? ভিডিও বা মুভিতে নয় কিন্তু, বাস্তবে। বাদুড় দেখা একটু মুশকিল। কারণ এরা রাতের বেলায় ওড়ে। দিনে ওরা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তুমি যখন ঘুম থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করো, বাদুড় তখন নিজের কাজ শেষ করে ঘুমাতে যায়। এই যে ঘুমানো, তা কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের মতো নয়। এরা দুই পা দিয়ে কোনো ডাল বা কিছু আকরে ধরে নিচের দিকে মাথা দিয়ে ঘুমাও। বিশ্রামও নেয় এভাবে। কিন্তু কেন ওরা উল্টোভাবে ঝুলে থাকে?
আসলে ইচ্ছা করে ওরা উল্টোভাবে ঝুলে থাকে না। এই প্রশ্নের ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে তোমাদের একটা কথা জানিয়ে রাখি। বাদুড় কিন্তু দেখতে পাখির মতো হলেও এরা পাখি নয়। এরা আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণী। স্তন্যপায়ী প্রাণী মানে যারা বাচ্চা দেয় এবং বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়। যেমন গরু, বিড়াল বা সিংহ। কখনো কোনো গরু বা সিংকে উড়তে দেখেছ? মুভিতে অবশ্য দেখতে পারো। যাহোক, পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী বাদুড় যারা উড়তে পারে। পাখিও উড়তে পারে, কিন্তু পাখিদের ওড়ার জন্য শরীর সেভাবে গঠিত হয়েছে। বাদুড়ের বেলায় কিন্তু তা হয়নি। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের এত ওজন, যে পায়ে ভর দিয়ে বেশি ওপরে উঠতে পারে না। আবার কিছুটা লাফিয়ে উঠতে পারলেও বেশিক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকতে পারে না। সব ওই ওজনের কারণে। কিন্তু বাদুড় এসব সমস্যার অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। যদিও শতভাগ সফল হয়নি।
বাদুড় ওড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু মাটিতে ভর দিয়ে পাখির মতো ওপরে উঠতে পারে না। বিষয়টা আরেকটু বুঝিয়ে বলা দরকার। সেজন্য একটুখানি বিজ্ঞানের সাহায্যও লাগবে। তোমরা হয়তো আইজ্যাক নিউটনের নাম শুনেছ। ওই যে যার মাথায় আপেল পড়ার কাহিনি প্রচলিত আছে, সেই বিজ্ঞানী। নিউটনের তিনটা বিখ্যাত সূত্র আছে। বড় হলে তোমরা সে ব্যাপারে জানতে পারবে। এরমধ্যে তৃতীয় সূত্রটা আমাদের আজ কাজে লাগবে। এই সূত্রটা বলে, ‘প্রতিটি বস্তুরই সমান ও বিপরীতমুখী ক্রিয়া রয়েছে’। সূত্রটা একটু বুঝিয়ে বলি।
তুমি যদি একটা দেয়ালে হালকা ধাক্কা দাও, দেয়ালটাও তোমাকে উল্টোদিকে হালকা ধাক্কা দেবে। এতে অবশ্য তুমি টের পাবে না। তাই তোমাকে একটু জোরে ধাক্কা দিতে হবে। তাহলে দেয়ালও তোমাকে জোরে ধাক্কা দেবে। বেশি জোরে ধাক্কা দিলে কিন্তু পেছন দিকে পড়ে যাবে। তুমি কেন পেছনে পড়ে যাবে? কারণ তুমি যে বেগে দেয়ালকে ধাক্কা দিচ্ছ, দেয়ালও তোমাকে সেই বেগে উল্টোদিকে ধাক্কা দেয়। তাই উল্টোদিকে পড়ে যাও। এটাই নিউটনের তৃতীয় সূত্র।
এবার নিজেই সূত্রটা পরীক্ষা করে দেখতে পারো। এজন্য তোমাকে শুধু বসা অবস্থা থেকে দাড়াতে হবে। খেয়াল করবে, তুমি যখন চেয়ার থেকে দাড়াতে যাও, তখন হয় হাটু কিংবা অন্য কোনো বস্তুতে হাত দিয়ে একটু বল প্রয়োগ করো। বেশিরভাগ সময় আমরা দুই হাটুর ওপর দুই হাত দিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াই। ভর না দিয়েও দাঁড়ানো যাবে, তবে একটু কষ্ট হয়। এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমরা দুই হাটুর ওপর হাত দিয়ে ভর দেই? আসলে আমরা দুই হাত দিয়ে হাটুতে নিচের দিকে ধাক্কা দেই। ফলে হাটুও আমাদের ধাক্কা দেয় ওপরের দিকে। তখন আমরা দাঁড়িয়ে যাই অনায়েসে। এই যে সহজ প্রক্রিয়াটা আমরা করলাম, বাদুড় তা পারে না। মানে বাদুড়ের পায়ে এত জোর নেই যে ধাক্কা দিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাবে।
আচ্ছা, তুমি চাইলেও কি চার হাত-পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ওপরে উঠতে পারবে? কোনোভাবেই পারবে না। কারণ তোমার শরীরের ওজন অনেক বেশি। কিন্তু মনে করো, তুমি একবার ওপরে উঠতে পারলে উড়ে থাকতে পারো। তোমার এই বিশেষ ক্ষমতা আছে। কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হবে? তুমি ওপরেই যদি না উঠতে পারো, উড়বে কীভাবে?
এক্ষেত্রে অবশ্য একটা কাজ করা যায়। কাউকে ১০ তলা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে ছেড়ে দিলে নিচে পড়তে পড়তে উড়ে যেতে পারবে না। তাহলে কিন্তু আর তাকে মাটি থেকে ধাক্কা দিয়ে ওপরে উঠতে হবে না। ঠিক একই কাজ করে বাদুড়। ওরা আসলে ওপরে উঠতে পারে না, কিন্তু উড়তে পারে। শুরুতেই বলেছিলাম, পাখির সব বৈশিষ্ট্য বাদুড় অর্জন করতে পারেনি। সেটা হলো এই ওপরে উঠতে না পারার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উড়তে যেহেতু পারে, তাই ওরা সবসময় নিচের দিকে ঝুলে থাকে। ওড়ার প্রয়োজন হলে ডাল ছেড়ে দিয়ে নিচের দিকে পড়তে থাকে, আর সে অবস্থায় উড়তে শুরু করে।
এ কারণেই তুমি কখনো বাদুড়কে পাখির মতো বসে বা শুয়ে থাকতে দেখতে না। ওরা সবসময় উল্টোভাবে ঝুলে থাকে যাতে সহজেই উড়ে যেতে পারে।
ভাবতে পারো এভাবে ঝুলে থাকতে বাদুড়ের কষ্ট হয় না? আসলে কষ্ট তেমন হয় না। কারণ, ওদের শরীরে একটা বিশেষ ব্যবস্থা আছে। যখন বাদুড় তার নখ দিয়ে শক্ত কিছু ধরে রাখে, তখন তাদের পায়ের পেশিগুলো এমনভাবে লক হয়ে যায় যে তারা কোনো শক্তি খরচ না করেই ঝুলে থাকতে পারে। একদম ম্যাজিকের মতো!
শেষ করার আগে বলি, বাদুড় কিন্তু আমাদের পরিবেশের জন্য খুব উপকারী। ওরা রাতে উড়ে উড়ে পোকামাকড় খায়, ফলে ফসলের ক্ষতি হয় কম। আবার কিছু বাদুড় ফল খায়, আর সেই ফলের বীজ ছড়িয়ে নতুন গাছ গজাতে সাহায্য করে। তাছাড়া খাদ্যশৃঙ্খলে রয়েছে এদের বড় ভূমিকা।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি