কিশোর আলোর বর্ষপূর্তির আসরে একবার অর্ণব এসেছিলেন। তাঁর গান শোনার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করে মঞ্চের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম আমি। সঙ্গে আমার এক বন্ধুও ছিল। অর্ণব ‘হোক কলরব...’ গাইছেন, তা স্মার্টফোনে ভিডিও করছিল আমার বন্ধু। কিন্তু হুট করে দেখা দিল বিপত্তি। আমরা তাই গানের কথা বদলে নিতে বাধ্য হলাম, ‘অসম্ভবে কখন কবে মোবাইলটা বন্ধ হলো ক্যান’!
আমার তখন আক্ষেপের শেষ নেই। এত সুন্দর সব দৃশ্য তৈরি হচ্ছে, অথচ স্মৃতি থাকবে না; এর কোনো মানে হয়! ঠিক তখনই মনে পড়ল অর্ণবই তো গেয়েছেন, ‘কতটা পথ এসেছি বাধা ঠেলে, বাকিটা পথ আর কিছু না তবে...’। সংকোচ সরিয়ে রেখে বের করলাম আমার নোকিয়া বাটন ফোন। চালু হলো তার ছোট্ট ক্যামেরা। আমার পাশের জন বোধ হয় এ রকম কিছুরই অপেক্ষায় ছিলেন। একই মুঠোফোন বের করলেন তিনিও। হাসিমুখ বিনিময় করে সবাই ডুব দিলাম অর্ণবের অনবদ্যতায়।
আধখানা ভাঙা সুরে গাওয়া গায়ক
বৃষ্টিবিলাস, ভালোবাসা বা স্মৃতিকাতরতা—অর্ণব গান বেঁধেছেন অসংখ্য উপলক্ষে। তাঁর গানের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারেন প্রত্যেকেই। দেখা যায়, কেউ হয়তো ফুরফুরে মেজাজে আছেন, অর্ণবের ‘ভবঘুরে’ হয়ে উঠেছে তাঁর সঙ্গী। যাপিত জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাওয়া মানুষেরাও শুনছেন তাঁর আহ্বান, ‘হারিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই...’। আবার যাঁরা অন্য সবার চেয়ে আলাদা, একটু ব্যতিক্রম, অনুপ্রেরণা খুঁজে নিচ্ছেন তাঁরাও, ‘নিজের সাম্রাজ্য নিজেই গড়ুক...’। এমনকি, ‘টলছে আকাশ, পুড়ছি আমি/ জ্বলছে শরীর জ্বরে...’, অসুস্থতার সময়েও যেন প্রাসঙ্গিক অর্ণবের গান।
এসব সম্ভব হওয়ার ক্ষেত্রে গানের কথার গুরুত্ব অনেক। সাহানা বাজপেয়ী, রাজীব আশরাফ, তৌফিক রিয়াজদের লিরিক্স অন্য সংগীতশিল্পীদের চেয়ে অর্ণবকে এগিয়ে রেখেছে। তিনি নিজেও বেশ কয়েকবার দেখা দিয়েছেন গীতিকারের ভূমিকায়। সুর করেছেন ছড়া-কবিতাতেও। ‘ঢাকা রাতে...’ তার উদাহরণ। আনিসুল হকের লেখার কল্যাণে অর্ণব শোনান এক শহরের গল্প; যেখানে পিয়ন ভুল ঘরে পৌঁছে দেয় চাঁদের চিঠি।
এখন পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাতটি একক অ্যালবাম। ‘চাই না ভাবিস’, ‘হোক কলরব’, ‘ডুব’ সেসবের মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি অ্যালবামের সুর, সংগীত আয়োজন করেছেন তিনি নিজেই।
অর্ণব কিন্তু দারুণ আঁকেনও। এর প্রমাণ মেলে তাঁর অ্যালবামগুলোর সাজসজ্জায়। সুন্দর সব অলংকরণ আর ডিজাইনে সেগুলো হয়ে ওঠে ভীষণ নান্দনিক। এই যেমন, ‘রোদ বলেছে হবে’ অ্যালবামটির সিডি সংস্করণে আবার তাঁর লেখা একটা গল্পও আছে। সেটা তিনি প্রকাশ করেছিলেন অনেকটা গ্রাফিক নভেলের আদলে। এই লিংক থেকে ওটার ডিজিটাল প্রতিলিপি দেখা যাবে।
‘রোদ বলেছে হবে’র গানগুলোও কিন্তু চমৎকার। ‘মাথা নিচু...’, ‘আমি যদি...’, ‘একটা মেয়ে...’ এবং টাইটেল ট্র্যাকটা যে কতবার শুনেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
একক অ্যালবাম ছাড়াও অর্ণব গেয়েছেন চলচ্চিত্র এবং মিক্সড অ্যালবামে। সিঙ্গেল হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গান। ছিলেন বাংলা, প্রেয়ার হলের মতো দুর্দান্ত দুটি ব্যান্ডের সদস্য।
তাঁর রবীন্দ্রযাপন
বিভিন্ন আয়োজনে বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন অর্ণব। প্রবীণ থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরাও গলা মেলান তাঁর প্রতিটি গানে। বিশাল ময়দানে হাজারো শ্রোতা একসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন—এই অভাবনীয় দৃশ্যের দেখা মেলে অর্ণবের কনসার্টে।
নতুন একটা প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথের গান আপন করে নিতে তিনিই তো উদ্বুদ্ধ করেছেন। শুধু কি তাঁর দরদ মেশানো কণ্ঠই এ ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে? একদম নয়। ভূমিকা আছে তাঁর সংগীতায়োজনেরও। ‘আধেক ঘুমে’র কথাই ধরা যাক। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া এই অ্যালবামে ছিল ১২টি রবীন্দ্রসংগীত। গানগুলোর মিউজিক নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্ণব হাঁটলেন ভিন্ন পথে। এ ক্ষেত্রে বলতে হয় জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। তিনি রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই। ভালোবাসতেন পিয়ানো বাজাতে। ভারতীয় এবং পশ্চিমা স্কেলের সমন্বয়ে তৈরি করেছিলেন বেশ কিছু পিয়ানো কর্ড। গান লেখার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে সেগুলো প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু সব কটি কর্ডের লিখিত বা রেকর্ডেড সংস্করণ সেভাবে সংরক্ষিত ছিল না।
শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার দিনগুলোতে অর্ণব উত্তরায়ণে পিয়ানো শিখতেন। একদিন ঘটল চমকপ্রদ ঘটনা। অর্ণব আবিষ্কার করলেন, জ্যোতিন্দ্রনাথের সেই পিয়ানো কর্ডগুলো অনুধাবন করতে পারছেন তিনি! গান লেখার ক্ষেত্রে ঠিক কোন প্যাটার্নগুলো রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল, তা তাঁর কাছে ধরা দিচ্ছে!
বলাবাহুল্য, ‘আধেক ঘুমে’র সংগীত নির্মাণ করা হয়েছিল সেসবকে ভিত্তি করেই। মেলোডি, স্কেল, রিদমিক প্যাটার্নের ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য তিনি চালিয়েছিলেন আরও গভীর অনুসন্ধান। অ্যালবাম প্রকাশের আগে দুই বছর ধরে শিখেছিলেন ওয়েস্টার্ন নোটেশনের আদ্যোপান্ত। পুরো যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন পিয়ানিস্ট আইভিন্ড লডএমেল। ‘আধেক ঘুমে’ অ্যালবামটি তাই একই সঙ্গে আধুনিক এবং শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন। এর গানগুলোও দারুণ। বিশেষ করে ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়...’, ‘আধেক ঘুমে...’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব...’, ‘পুরোনো সেই দিনের কথা...’।
অর্ণবের সংগীতায়োজনে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন আরও অনেকে।
মানুষের পাশে
মানবতার জয়গান অর্ণব সব সময়ই গেয়েছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সময় প্রকাশ করেছিলেন ‘মন খারাপের বৃষ্টি...’। গানটি শোনার বিনিময়ে শ্রোতারা যে অর্থ দিয়েছিলেন, তা যুক্ত হয়েছিল অনুদানের খাতায়। আরেকবার এগিয়ে এসেছিলেন পাহাড়ি শিশুদের স্কুল পুনর্নির্মাণের কাজে। বান্দরবানে বুনো হাতিদের আক্রমণে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেখানে নিজের ষষ্ঠ অ্যালবাম ‘খুব ডুব’ বিক্রি করে পাওয়া অর্থের একটা বড় অংশ যুক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, ওখানকার শিশুদের সঙ্গে ঝরনায় দাপাদাপি, ছবি আঁকার সেই দিনগুলো তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত।
হারিয়ে যাওয়া এবং প্রত্যাবর্তন
নিজের গানের কথামতো অর্ণবও প্রায়ই হারিয়ে যান। সে সময় অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র বা শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে তাঁর গন্তব্য। ব্যাপারটা অবশ্য তিনি ‘চাই না ভাবিস..’, এই গেয়ে রেখেছেন অনেক আগেই। গাছের পাতা, ঘাসফুল ও তারাদের কথোপকথন শুনতে পেয়ে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ‘চাই না আমি গান শোনাতে কাউকে তোদের/ আমি এখন শুনব বসে গল্প ওদের...’।
বিরতির পর অর্ণব ফিরে আসেন আবার। কাজে নেমে পড়েন নব-উদ্যমে। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটল ২০১৭ সালে। সেবার ‘অন্ধ শহর’ মুক্তি দিয়ে তিনি জানালেন, ‘এটাই আমার শেষ অ্যালবাম।’ গান গাওয়া তিনি আর উপভোগ করছেন না। প্রস্থান সে কারণেই। এরপরের সময়টায় ছবি আঁকা, স্টপ মোশন অ্যানিমেশন হয়ে ওঠে তাঁর সঙ্গী। কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করছিল। একাকিত্বের কথা উঠে আসছিল তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। অঘোষিতভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তাঁর গান ‘অনেক দূর..’, ‘তোমায় পেলে নতুন গানের সুরটা পাব...’। অর্ণবের জীবনে সেই সুর নিয়ে এলেন সুনিধি নায়েক।
পরের গল্পটা রূপকথার সমাপ্তির মতোই, ‘এরপর তাঁহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’ আজকাল ভক্তরা মুগ্ধ হয়ে দেখছেন, অর্ণবের সংগীতে সুনিধি গাইছেন। আবার সুনিধির অনুপ্রেরণায় গান বাঁধছেন অর্ণবও।
সব মিলিয়ে তাঁর দিনকাল এখন ভালোই কাটছে। সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলার সংগীত প্রযোজক হিসেবেও দেখা গেছে তাঁকে। সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে দুটি সিজন। শ্রোতারা এখন পরবর্তী সিজনের অপেক্ষায়।
২৭ জানুয়ারি শায়ান চৌধুরী অর্ণবের জন্মদিন। জন্মদিনে খোলাচিঠি লেখা যাক কবীর সুমনের সুরে, ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবি দাওয়া...’; অর্ণব, ‘তুই গান গা ইচ্ছেমতো, বাতাসকে খুশি করে বাঁচ’—এটুকুই আমাদের চাওয়া।
অর্ণবের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল কিআ সাক্ষাৎকার দল। সাক্ষাৎকারটি পড়ো এখানে।