প্রিয় বন্ধুরা, তোমরা কি বলতে পারো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শিল্প কোনটি? বলতে পারছ না? উত্তর হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল শিপিং’ বা ‘আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্য’। তোমাদের অবশ্য দোষ দেব না। বিরাট এই শিল্পের বেশির ভাগ কাজকর্ম লোকচক্ষুর আড়ালে হয়—সমস্যা আসলে সেখানে। এ জন্য কেউ কেউ এই শিল্পকে একটি ‘অদৃশ্য শিল্প’ হিসেবেও বলে থাকেন।
এ শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বড় বড় জাহাজ। সমুদ্রজুড়ে কিলবিল করতে থাকা এসব জাহাজের কোনোটা ঢালাই পণ্য, কোনোটা হিমায়িত পণ্য, কোনোটা তেল-গ্যাস, কোনোটা কনটেইনারে করে মালামাল বহন করে। আকারভেদে এসব জাহাজ বিশ-পঞ্চাশ হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। (এক টন সমান এক হাজার কেজি)। একটি বড় আকারের কনটেইনার জাহাজ বিশ-পঁচিশ হাজার কনটেইনার, একটি বড় আকারের যাত্রীবাহী জাহাজ চার-পাঁচ হাজার যাত্রী এবং একটি বড় আকারের ইউএলসিসি (আলট্রা লার্জ ক্রুড কেরিয়ার) একসঙ্গে পাঁচ লাখ টন জ্বালানি তেল বহন করতে পারে।
তোমরা বড় হয়ে এসব বড় জাহাজে কাজ করা বা মেরিনার হওয়ার কথা কখনো ভেবেছ কি? কখনো ইচ্ছে হয়েছে নীল সমুদ্রে বিশাল জাহাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে? তাহলে চলো, এ বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
একটি জাহাজ চালাতে ডেক ও ইঞ্জিন ক্রুদের (কর্মচারী) পাশাপাশি প্রধানত দুই ধরনের অফিসার প্রয়োজন হয়—ইঞ্জিনিয়ার অফিসার ও ডেক অফিসার। ডেক অফিসাররা জাহাজ চালানো (নেভিগেশন), মালামাল দেখাশোনা এবং জাহাজের প্রশাসন ইত্যাদির দেখাশোনা করেন। তাঁদের লেখাপড়ার বিষয় নটিক্যাল সায়েন্স। ইঞ্জিনিয়ার অফিসারদের কাজ জাহাজের ইঞ্জিন, জেনারেটর, হিমাগারসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি চালিয়ে রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা। তাঁরা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেন।
জাতিসংঘের সমুদ্রসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নাম আইএমও (ইন্টারন্যশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন)। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রণীত রূপরেখার আলোকে বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু কলেজ-ইউনিভার্সিটি, ইনস্টিটিউট ও একাডেমিতে উল্লেখিত কোর্স দুটি পড়ানো হয়। চট্টগ্রামের বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি সে রকম একটি প্রতিষ্ঠান। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান ছাড়া আরও দু-একটি বেসরকারি একাডেমি চালু আছে।
এসব একাডেমিতে লেখাপড়া করার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষা ও রেজিমেন্টেড একটি জীবনব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করানো হয়। নামান্তরে এই কোর্সকে ‘প্রাক্সমুদ্র প্রশিক্ষণ’ কোর্সও বলা হয়। এখানে দুই বছরের কোর্স শেষে ছাত্রছাত্রীরা সমুদ্রগামী জাহাজে উঠে, এক বছরের হাতে-কলমে কাজ বা ইন্টার্নশিপ শেষে, বছরখানেক সময়ের জন্য আবার ফিরে আসে একাডেমিতে। এবার ফিরে আসার উদ্দেশ্য ‘বিএসএমআরএমইউ’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি) থেকে চার বছরের অনার্স ডিগ্রি এবং পাশাপাশি ‘বাণিজ্যিক নৌপরিবহন অধিদপ্তর’ থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডেক অফিসারের সিওসি (সার্টিফিকেট অব কম্পিটেন্সি) বা যোগ্যতা সনদ গ্রহণ করা (বেসরকারি মেরিন একাডেমির নিয়ম কিছুটা ভিন্ন। আপাতত তারা বিএসএমআরএমইউ থেকে প্রণীত ডিগ্রি প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারছে না, কিন্তু যোগ্যতা সনদ নিতে পারে)। জাহাজে জুনিয়র অফিসার পদে কাজ করার জন্য এটিই প্রথম সনদ। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য অনেক দেশ থেকেও এই যোগ্যতা সনদ গ্রহণ করা যায়। মূলত প্রথম সনদ গ্রহণ করার পর থেকেই বিদেশগামী দেশি-বিদেশি জাহাজগুলোতে ভালো বেতনে মেরিনারদের চাকরিজীবন শুরু হয়।
তারপর নির্দিষ্ট সময় পার করে ধাপে ধাপে পরীক্ষা, পাস করে ওপরের দিকে ওঠা। ইন্টার্নশিপ থেকে শুরু করে, পাঁচ-ছয় ধাপ ওপরে উঠে, ডেক অফিসারদের সর্বশেষ ধাপ ক্যাপ্টেন এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের সর্বশেষ ধাপ চিফ ইঞ্জিনিয়ার। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হলে, ‘প্রাক্সমুদ্র প্রশিক্ষণ’ থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন বা চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পরীক্ষা পর্যন্ত ১০-১২ বছরের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সর্বশেষ পরীক্ষায় পাস করে কেউ চাইলে সুইডেনে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড মেরিটিয়াম ইউনিভার্সিটি বা অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব বিষয়ের ওপর উচ্চতর লেখাপড়া করতে পারে।
মেরিনারদের লেখাপড়া, পদ-পদবির কথা শোনার পরে এখন নিশ্চয়ই সমুদ্রে ঝড়ঝঞ্ঝার কথা ভাবছ? এটা আসলে কোনো সমস্যা নয়। ঝড়, বাতাস, ঢেউ ইত্যাদি কেটে কেটে জাহাজ চলে। সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী করে এসব জাহাজ বানানো হয়।
এখন ভাবছ ‘দশ-বারো ঘণ্টার লঞ্চভ্রমণ করেই হাঁপিয়ে উঠি, বছরের পর বছর জাহাজে থাকব কী করে?’ এ ব্যাপারটাও কিন্তু সে রকম না। একজন যাত্রী হিসেবে জাহাজে ভ্রমণ করা আর জাহাজের একজন কর্মকর্তা হিসেবে জাহাজে থাকা এক কথা নয়। জাহাজে কাজ করার সময় জাহাজকেই তোমাদের ঘরবাড়ি মনে হবে। তবে জাহাজে থাকা-খাওয়া, ঝড়ঝঞ্ঝা ইত্যাদি ব্যাপার যে একদমই ‘ছেলের হাতের মোয়া’ তা ভাবা ঠিক হবে না। কাজটায় অ্যাডভেঞ্চার যেমন আছে, তেমনি আছে চ্যালেঞ্জও।
[সমুদ্র, জাহাজ আর মেরিনারদের জীবন নিয়ে আরো বিস্তারিত জানা যাবে প্রথমা প্রকাশন থেকে লেখকের প্রকাশিত নুনকি একটি তারার নাম বইটিতে]