যেভাবে হারিয়ে গেল অ্যাম্বার চেম্বার

অ্যাম্বার চেম্বার দেখতে যেমন ছিল।ছবি: সংগৃহীত

২২ জুন ১৯৪১। চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অ্যাডলফ হিটলার শুরু করেছে ‘অপারেশন বারবারোসা’। এ অপারেশনে ৩০ লাখ জার্মান সৈন্য পাঠানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়া নামে পরিচিত)। এই সৈন্যদের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন সম্পদ লুট করা। কারণ, হিটলারের নাৎসি বাহিনী বিশ্বাস করত, এসব সম্পদ জার্মানদের তৈরি। ফলে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যেতে হবে জার্মানে।

এই ৩০ লাখ সৈন্যের মাত্র সাতজন প্রবেশ করেছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্যাথরিন প্যালেসে। ছয়জন নিচু পদের সেনা ও একজন কমান্ডার। সম্পূর্ণ প্রাসাদটি ছিল স্বর্ণালংকারে ভরা। এক হাজারের বেশি রুম ছিল ওই প্রাসাদে। এর একটি রুমে গিয়ে একজন সৈন্যের মনে হলো, এই প্রাসাদে কোনো ঘাপলা আছে। কী যেন একটা মিসিং, মিলছে না। ডাকলেন কমান্ডারকে। মনের সন্দেহের কথা বুঝিয়ে বললেন। কমান্ডার ভালোভাবে ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখলেন। আসলেই এটা অন্য রুমগুলো থেকে আলাদা, পুরোনো। কাপড় দিয়ে পর্দার মতো মোড়ানো। কিন্তু সে কাপড়ের নকশা অন্যগুলোর সঙ্গে মিলছে না। যেন এই কাপড়ের দরকার ছিল না এ রুমে। ঠিক একই সন্দেহ করেছেন নিচু পদের সৈন্যও। কমান্ডার আদেশ করলেন কাপড় ছিঁড়ে ফেলতে। একটা ধারালো ছুরির সাহায্যে কাপড় কাটতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। উন্মুক্ত হলো গোটা একটা রুম। এই রুমের নামই অ্যাম্বার চেম্বার। শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে শেষ সময়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেও শেষ রক্ষা হলো না।

আরও পড়ুন

তারপর কী ঘটেছিল অ্যাম্বার চেম্বারের ভাগ্যে? এটি তৈরিই-বা হয়েছিল কীভাবে। কারা তৈরি করেছিল এই মহামূল্যবান চেম্বার?

গোড়া থেকে শুরু করি। যেতে হবে অনেক পেছনে। ১৭০১ সাল। প্রুশিয়া নামের এক দেশের রাজা ছিলেন প্রথম ফ্রেডরিখ। এখন অবশ্য প্রুশিয়া জার্মানের একটা স্টেট। ফ্রেডরিখ সিদ্ধান্ত নিলেন, স্ত্রীর জন্য জার্মানির বার্লিনে একটা প্রাসাদ তৈরি করবেন। তবে সে প্রাসাদ সাধারণ কোনো প্রাসাদ হবে না। তৈরি হবে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ দিয়ে। সেই সম্পদ হিসেবে বেছে নিলেন ‘অ্যাম্বার’। বাকি কাহিনি বলার আগে অ্যাম্বারের কাহিনি বলা দরকার, কেন ফ্রেডরিখ স্বর্ণ বা হীরা বাদ দিয়ে অ্যাম্বার দিয়ে প্রাসাদ সাজানোর কথা ভেবেছিলেন?

রাশিয়ার হাল ধরেন পিটারেরে মেয়ে এলিজাবেথ। তিনি সেন্ট পিটারর্সবার্গে অ্যাম্বার চেম্বার স্থাপনের কাজ শুরু করেন। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয় ১৭৪৩ সালে। এরপরও বিভিন্ন সময় এর পুনঃসংস্করণের কাজ করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে নকশা। তবে প্রুশিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডরিখের বানানো সেই নকশায় কিন্তু কেউ হাত দেননি।

তোমরা নিশ্চয়ই গাছের কষ চেনো। কাঁঠালগাছের কথাই ধরা যাক। কাঁঠালগাছের ছাল বা বাকল উঠিয়ে ফেললে কিংবা গাছে দা বা ছুরি দিয়ে সামান্য কাটলেও দেখবে কষ বের হচ্ছে। সাদা আঠালো কষ। অ্যাম্বারও তেমনি কষ। অ্যাম্বারগাছ থেকে এই কষ বের হয়। অনেক বছর এই কষ জমে জমে পরিণত হয় ফসিলে। পৃথিবীতে প্রায় ৬ কোটি বছরের পুরোনো অ্যাম্বারও পাওয়া গেছে। জুরাসিক পার্ক সিনেমার নাম মনে আছে? একটু অ্যাম্বারের মধ্যে আটকে ছিল একটা মশা। সেই মশার পেটে ছিল ডাইনোসরের রক্ত। বিজ্ঞানীরা সেই রক্ত থেকে আবিষ্কার করলেন ডাইনোসর। সিনেমায় দেখানো সেই অ্যাম্বারই আমাদের আজকের আলোচনার অ্যাম্বার। এমন পুরোনো অ্যাম্বারের দাম পৃথিবীর যেকোনো অলংকারের চেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। যা-ই হোক, আবার ইতিহাসে ফেরা যাক।

অ্যাম্বার চেম্বারের রেপ্লিকা
ছবি: উইকিপিডিয়া

১৭০১ সালে রাজা প্রথম ফ্রেডরিখ অ্যাম্বার রুমের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৭১৩ সালে তিনি মারা যান। তাঁর ছেলে ফ্রেডরিখ ভিলহেম বসেন রাজার আসনে। অ্যাম্বার চেম্বার নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ না থাকায় তিনি কাজ বন্ধ করে দেন। ফলে তাঁর বাবা যে পরিকল্পনা করে অ্যাম্বার চেম্বার বানাচ্ছিলেন, তা আর কোনো দিন বাস্তবে পূরণ হয়নি।

আরও পড়ুন

প্রুশিয়ায় নতুন রাজা পিটার ভিলহেম। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন রাশিয়ার রাজা পিটার দ্য গ্রেট (প্রথম পিটার)। তিনি তিন দিন প্রুশিয়ায় ছিলেন। এ সময় ফ্রেডরিখ জানতে পারেন, অ্যাম্বারের প্রতি পিটারের প্রচণ্ড আকর্ষণ রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেন, এই অ্যাম্বার রুম পিটারকে উপহার দেবেন। বিনিময়ে তিনি পাবেন রাজনৈতিক সহযোগিতা। যেই ভাবা সেই কাজ। অ্যাম্বার চেম্বারের কাজ যেটুকু হয়েছিল, তা আবার ভেঙে বাক্সবন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাশিয়ায়। ১৭২১ সালে মারা যান পিটার দ্য গ্রেট। অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি অ্যাম্বার চেম্বার স্থাপন করে যেতে পারেননি।

ক্যাথরিন প্যালেস, সেন্ট পিটার্সবাগ, রাশিয়া
ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার হাল ধরেন পিটারেরে মেয়ে এলিজাবেথ। তিনি সেন্ট পিটারর্সবার্গে অ্যাম্বার চেম্বার স্থাপনের কাজ শুরু করেন। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয় ১৭৪৩ সালে। এরপরও বিভিন্ন সময় এর পুনঃসংস্করণের কাজ করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে নকশা। তবে প্রুশিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডরিখের বানানো সেই নকশায় কিন্তু কেউ হাত দেননি। সেটা ঠিক রেখে নিজেদের মতো করে স্বর্ণালংকার দিয়ে অ্যাম্বার চেম্বার সাজানো হয়েছে। আঠারো শতকে রুমটি ছিল ১৮০ বর্গফুটের। সেখানে প্রায় ৬ টন বা ৬ হাজার কেজি অ্যাম্বার ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, তখন ঘরটির বাজারমূল্য ছিল ১৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ফ্রেডরিখ থেকে পিটার, পিটার থেকে এলিজাবেথ, এভাবে নানান হাত বদল হয়েছে অ্যাম্বার চেম্বারের। তবে শেষ পর্যন্ত ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নাৎসি বাহিনী রাশিয়াজুড়ে লুটপাট শুরু করে এবং খুঁজে পায় অ্যাম্বার চেম্বার। খুঁজে পাওয়ার সেই ঘটনা শুরুতেই বলেছি। এবার পরের ইতিহাস বলি। নাৎসিরা কী করেছিল অ্যাম্বার চেম্বারের?

ওই সাত সৈন্য টানা তিন দিন ছিল সেই প্রাসাদে। যেখানে একসময় বাস করতেন রানি এলিজাবেথ বা এলিজাবেথ অব রাশিয়া। তিন দিনে তারা অ্যাম্বার চেম্বারকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে। তারপর ২৭টি বাক্সবন্দী করে অ্যাম্বার রুম নিয়ে যাওয়া হয় জার্মানির কনিসবার্গে। বর্তমানে এই স্থানের নাম কালিনিনগ্রাদ। সেখানে একটা প্রাসাদে আবার স্থাপন করা হয় অ্যাম্বার চেম্বার। অনেকটা জাদুঘরের আদলে বানিয়েছিলেন হিটলার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মিত্রবাহিনীর একটা বোমা এসে পড়ে ওই দুর্গে। চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে যায় অ্যাম্বার চেম্বার, যা রাজা ফ্রেডরিখ বানিয়েছিলেন ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। মোগল সম্রাট শাহজাহান যেমনটা তৈরি করেছেন তাঁর স্ত্রী মমতাজের জন্য, তাজমহল।

তবে অ্যাম্বার চেম্বারের ইতিহাস যেন ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেকে বিশ্বাস করলেও সবাই সে দলে নেই। কেউ কেউ মনে করেন, ওই গুপ্তধন এখনো রয়েছে কালিনিনগ্রাদে। কারণ, যুদ্ধের সময় এই সম্পদ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মাটির নিচে। অনেকে মনে করেন, যুদ্ধের সময় এ সম্পদ বাঁচাতে জাহাজে তোলা হয়েছিল। কিন্তু রুশরা সে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এখনো বাল্টিক সাগরের নিচে এই সম্পদ লুকিয়ে আছে। তবে ২০০৩ সালে বাল্টিক সাগরের সম্ভাব্য স্থানে একে খুঁজে কিছু পাওয়া যায়নি। তবে তাদের আগেও কেউ সেখানে পৌঁছে যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

আরও পড়ুন

১৯৯৭ সালে জার্মান গোয়েন্দাদের কানে খবর আসে, কেউ একজন অ্যাম্বার চেম্বারের একটা টুকরো বিক্রি করতে এসেছেন। গোপন সূত্রে জানা যায়, যিনি এটা বিক্রি করেছেন, তাঁর বাবা একজন সৈনিক ছিলেন। অর্থাৎ এটা অ্যাম্বার চেম্বারের টুকরো হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কিন্তু হতাশ হন। ওই টুকরো অ্যাম্বার চেম্বারের ছিল না। কিন্তু তিনি যা বিক্রি করেছেন, তা কোথা থেকে এসেছে, সেটাও বলতে পারেননি।

এবার একটু ভয়ের কথা বলি। এই গল্পের আরেকটা অদ্ভুত দিক হলো ‘অ্যাম্বার রুমের অভিশাপ’। অন্তত চারজন মানুষ মারা যাওয়ার পর এই অভিশাপের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রোহদ নামে এক ব্যক্তি কনিসবার্গের অ্যাম্বার রুমের দেখাশোনা করত। সে এবং তাঁর স্ত্রী, দুজনেই গলায় টাই ফাঁস দিয়ে মারা যান। জেনারেল গুসেভ নামে একজন রুশ কর্মকর্তা অ্যাম্বার চেম্বার সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ১৯৮৭ সালে জর্জ স্টেইন নামের এক সৈন্য এই চেম্বারের খোঁজ শুরু করেন। বনের মধ্যে তাঁর রক্তাক্ত শরীর পাওয়া গেছে। তবে আধুনিক যুগে এসে অভিশাপ বিশ্বাস করা কঠিন বটে। তোমাদের মৃতুর খবর বললাম, এখন এটা অভিশাপে মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু, তা তোমাদের বিবেচনা।

ক্যাথরিন প্রাসাদের মিনার
ছবি: সংগৃহীত

শেষ করার আগে তোমাদের আরেকটা কথা জানাই। অ্যাম্বার চেম্বার কিন্তু এখনো সেন্ট পিটার্সবার্গে বহাল তবিয়তে রয়েছে। ইচ্ছা থাকলেই তুমি সেটা দেখতে পারো। তবে আসলটা না, রেপ্লিকা। ইউটিউবে সার্চ করলে এই রেপ্লিকা দেখতে পারবে। ১৯৭৯ সালে অ্যাম্বার চেম্বারের রেপ্লিকার কাজ শুরু হয়। ২৫ বছর লাগে কাজ শেষ হতে। সেন্ট পিটার্সবার্গের ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও জার্মানের চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডার এই অ্যামার চেম্বারের রেপ্লিকা উদ্বোধন করেন।

আরও পড়ুন

তবে আসল অ্যাম্বার চেম্বারের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা কেউ জানে না। আসলেই কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বোমার আঘাতে, নাকি এখনো পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে আছে সেই সম্পদ। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সৃষ্ট সম্পদ ধ্বংস হলো যুদ্ধে। জার্মানিদের সম্পদ জার্মানিরা ফিরিয়ে এনেছিল ঠিকই, কিন্তু রক্ষা করতে পারল কোথায়!

সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগ ডট কম, জিওলোজিক্যাল ইনস্টিটিউট অব আমেরিকা, হিস্ট্রি হিট ডট কম, ব্রিটানিকা ডট কম, দ্য সান ডট কম এবং অল দ্যাটস ইন্টারেস্টিং ডট কম

আরও পড়ুন