নিউইয়র্কের সারাগোটা স্প্রিংয়ের মুন লেক লজ। ওখানকার অভিজাত রেস্টুরেন্ট। ডিনারে এসেছেন এক অতিথি। এক থালা ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের ফরমাশ দিলেন তিনি। রেস্টুরেন্টের রসুইঘর থেকে ফ্রেঞ্চফ্রাই তৈরি করে পাঠানো হলো। কিন্তু এ কী! ফ্রেঞ্চফ্রাই তো মনমতো হলো না। তিনি যতটা আশা করেছিলেন, ফ্রেঞ্চফ্রাইটা হয়েছে তার চেয়ে বেশি পুরু। এত পুরু ফ্রেঞ্চফ্রাই খাওয়া যায়? শুধু তা-ই নয়, ফ্রেঞ্চফ্রাইটা বেশ নরম হয়ে গেছে। ওটা পুরুত্বের জন্য হয়েছে। এমন ফ্রেঞ্চফ্রাই চিবোতেও ইচ্ছে করে না। হাত দিয়েও ধরলেন না অতিথি। দেখেই তো তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি ফ্রেঞ্চফ্রাই ফেরত পাঠালেন।
অভিজাত ওই রেস্টুরেন্টে তখন রান্নার কাজ তদারক করছিলেন ৩১ বছর বয়সী এক তরুণ। নাম তাঁর জর্জ ক্রাম। সময়টা ছিল ১৮৫৩ সালের গ্রীষ্মকাল। অতিথির ফেরত পাঠানো ফ্রেঞ্চফ্রাই আর অভিযোগ শুনে মেজাজ খিঁচড়ে গেল তরুণ ক্রামের। ইচ্ছে করলে ফেরত আসা ফ্রেঞ্চফ্রাইকেই ঠিকঠাক করে আবার অতিথির টেবিলে পরিবেশনের জন্য পাঠাতে পারতেন ক্রাম। কিন্তু সেদিন তাঁর মাথায় ভূত চেপেছিল। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, অতিথিকে জব্দ করবেন।
আবার নতুন করে আলু কাটতে বসলেন ক্রাম। আর এবার আলুগুলো কাটলেন খুব পাতলা করে। একেবারে কাগজের মতো। এতটা পাতলা আলুর ফ্রেঞ্চফ্রাই এর আগে কেউ কখনো খেয়েছে বলে জানা নেই।
যাহোক, পাতলা করে আলু কেটে, অনেক সময় নিয়ে সেগুলো ভাজলেন। একেবারে শক্ত আর মচমচে না হওয়া পর্যন্ত। ভাজা শেষ করে সেগুলোর ওপর খানিকটা লবণ ছিটিয়ে দিলেন। আর মনে মনে বললেন ক্রাম, শক্ত ফ্রেঞ্চফ্রাই খেতে চেয়েছ তো! এবার খাও দেখি বাছাধন।
অতিথির সামনে পরিবেশন করা হলো অদ্ভুত ফ্রেঞ্চফ্রাই। একটা মুখে নিয়ে আমোদে চোখ বুজে ফেললেন অতিথি। তারপর একটা একটা করে সেই অদ্ভুত ফ্রেঞ্চফ্রাই খেতে শুরু করলেন পরম তৃপ্তি নিয়ে। এক নিমেষে সবটা শেষ করলেন। আর ডেকে পাঠালেন নতুন ধরনের এই ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের পাচককে।
পাচকের পিঠে অভিনন্দনের চাপড় দিয়ে নিজের তৃপ্তির কথা জানালেন অতিথি। কিছু বকশিশও দিতে ভুললেন না।
পাচক ক্রাম তো অবাক। কোথায় অতিথিকে শায়েস্তা করতে চাইলেন, কিন্তু বিনিময়ে পেলেন অভিনন্দন আর বকশিশ। তাহলে কি নতুন রেসিপিটা সত্যিই মজাদার!
রসুইঘরে গিয়ে নতুন করে আবার তৈরি করলেন অদ্ভুত সেই ফ্রেঞ্চফ্রাই। নিজে মুখে নিলেন কয়েকটা। হুম। সত্যিই দারুণ মজার। কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার একটা শব্দ হয়। সেটাও শুনতে দারুণ লাগে। তারপর তাঁর সহকর্মীদেরও খাওয়ালেন। সবাই বেশ প্রশংসা করলেন ক্রামের এই নতুন উদ্ভাবিত অদ্ভুত ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের। আর সেদিনই জন্ম নিল দুনিয়ার ইতিহাসে নতুন এক হালকা খাবারের। দুনিয়াজোড়া যার খ্যাতি। যেটাকে এখন আমরা পটেটো চিপস হিসেবে চিনি। তবে প্রথম দিকে এর নাম ছিল উদ্ভাবন স্থানের নামে ‘সারাগোটা চিপস’। পরে হয় ‘পটেটো ক্রাঞ্চিস’। ওই রেস্টুরেন্টের অন্যান্য টেবিল থেকেও সারাগোটা চিপসের জন্য অনুরোধ আসতে থাকে। আর ধীরে ধীরে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
আবার আসা যাক ক্রামের কথায়। ক্রামের বাবা ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান আর মা ছিলেন আমেরিকান আদিবাসী। ক্রামের জন্ম ১৮২২ সালে নিউইয়র্কের সারাগোটা লেক নামের জায়গায়। মূলত তিনি ছিলেন শিকারি। এ ছাড়া গাইড হিসেবেও কাজ করতেন। রান্নার প্রতি ছিল তাঁর অপার কৌতূহল। ওই কৌতূহল থেকেই গরমের সময় ঢুকে পড়তেন রেস্টুরেন্টের রসুইঘরে।
১৮৬০ সালে সারাগোটা লেকের ধারেকাছেই মাল্টা অ্যাভিনিউয়ে নিজেই একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসলেন। তাঁর রেস্টুরেন্টের প্রতিটি টেবিলে এক ঝুড়ি করে পটেটো চিপস রাখতেন। ক্রাম তাঁর উদ্ভাবিত খাবারের জন্য পেটেন্ট করেননি। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে অনেকে। তখন অনেকেই ক্রামের উদ্ভাবিত চিপস বানিয়ে আশপাশের মুদি দোকানগুলোয় বিক্রি শুরু করে। ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত ওহিওর ক্লিভল্যান্ডে চিপস তৈরি ও বাজারজাত করতেন উইলিয়াম ট্যাপেনডন। ১৯২০ সালের দিকে দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রে গাড়িতে করে চিপস বিক্রি করতেন হারমান লে। ১৯২৬ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চিপস তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার মনাটেরি পার্কে ওই কারখানা স্থাপন করেন লরা স্কাডার। উৎপাদিত চিপস সতেজ ও মুড়মুড়ে রাখার জন্য মোম-কাগজের চিপস ব্যাগও উদ্ভাবন করেন লরা। ফলে যত দূরেই পাঠানো হোক না কেন, চিপসের স্বাদ ও মজার ঘাটতি আর রইল না। আরও জনপ্রিয়তা পেল চিপস। একসময় চিপসের জনপ্রিয়তা যুক্তরাষ্ট্র ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াব্যাপী।
এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারই নয়, দুনিয়ার জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় প্রথম সারিতেই আছে পটেটো চিপস।