‘গাজা থেকে বলছি, আমি কোনো সংখ্যা নই, আমার গল্পটা মনে রেখো’

গাজার অধিবাসী সাংবাদিক ও শিক্ষক রুওয়াইদা আমির লিখেছেন চিরদিনের জন্য বদলে যাওয়া তাঁর জীবনের গল্প। আল-জাজিরার জন্য লেখাটি এমন এক সময়ে লেখা হয়েছে, যখন প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি সেনারা গাজায় বোমাবর্ষণ করছে। আমির বোমাবর্ষণের ভয়কে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে শিখছেন। প্রতিবার বিস্ফোরণের শব্দে তিনি ভাবেন, এখন কী হবে?

ছবির ডান দিকে হিজাব পরা রুওয়াইদা আমির সেলফি তুলছেন চারজন শিশু-কিশোরের সঙ্গে। ছবিটি ২০২২ সালে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে তোলা। এখন এই চারটি ছেলেই আছে মিসরে। যুদ্ধের কারণে এদের পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।ছবি: রুওয়াইদা আমির

ভাবছি একটা উইল লিখে রাখব। কারণ, কখনো ভাবিনি মৃত্যুকে এতটা কাছ থেকে অনুভব করতে হবে। আমি ভাবতাম, মৃত্যু বুঝি হঠাৎ করে আসে, আমরা টের পাই না। কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের সবকিছু অনুভব করতে বাধ্য করছে।

এখন কিছু হওয়ার আগেই আমরা কষ্ট পাই। যেমন এখনই বোধ হয়, আমাদের বাড়িটা ধ্বংস হয়ে যাবে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখনো হয়তো আমাদের বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই ভয়, বুকের ভেতরের কাঁপুনি থামছে না। এই ভয় আমার ভেতরটাকে এমনভাবে শেষ করে দিয়েছে, এখন মনে হয়, আর কিছু সহ্য করতে পারব না।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি যেন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের এত কাছে চলে এসেছে, প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটে। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, যখন তাদের ট্যাংকগুলো নেতজারিম অঞ্চল দিয়ে গাজায় ঢুকেছিল, আমি তখনই হতবাক হয়ে বন্ধুদের মেসেজ করেছিলাম, ‘ওরা গাজায় ঢুকল কী করে? আমি কি স্বপ্ন দেখছি!’

আমি অপেক্ষা করছিলাম, ওরা গাজা ছেড়ে যাবে। শহরটা আবার মুক্ত হবে। এ রকমই আমরা সারা জীবন জেনে এসেছি। কিন্তু এখন ওরা এত কাছে…। ওরা এখন আল-ফুখারি এলাকায়, খান ইউনিসের পূর্বে, রাফার উত্তরে। এখানেই খান ইউনিস শেষ হয়ে রাফা শুরু হয়েছে। ওরা এত কাছে চলে এসেছে যে আমাদের প্রতি মুহূর্তে ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে হয়। কখনো এই শব্দ থামে না। এই শব্দ আমাদের স্নায়ুকে চিরতরে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে।

আমার গল্পটা মনে রেখো

‘আমি শুধু সংখ্যা হতে চাই না। আমি কোনো সংখ্যা নই। মনে রেখো, আমি গাজা থেকে উঠে এসেছি। আমি বাস্তবের চরিত্র। আমার গল্পটা মনে রেখো। আমি একটি সংখ্যা হতে চাই না।’

কথাগুলো বারবার আমার মাথায় ঘুরছে। কারণ, শহীদদের ‘অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করতে দেখেছি। দেখেছি, গণকবরে তাঁদের শুইয়ে রাখা হয়েছে। অনেকের শরীর ছেঁড়াখোঁড়া, দেখে চেনার উপায় নেই। আমার কপালেও কি এমনটা লেখা আছে? কাফনে শুধু লেখা থাকবে, ‘কালো বা নীল ব্লাউজ পরা এক তরুণী’? আমি কি মারা যাব একজন ‘অজ্ঞাত ব্যক্তি’ হিসেবে? হব শুধু একটি সংখ্যা? আমি চাই আমার চারপাশের সবাই যেন আমার গল্পটা মনে রাখে। আমি কোনো সংখ্যা নই।

আমি সেই মেয়ে, যে কঠিন অবরোধের মধ্যেও মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছি। বাবাকে সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করেছি কাজ খুঁজে পেতে। আমার বাবা অবরোধের চাপে বারবার চাকরি হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

আমি আমাদের পরিবারের বড় মেয়ে। চেয়েছিলাম বাবাকে সাহায্য করতে। চেয়েছিলাম আমরা যেন একটা ভালো বাড়িতে থাকতে পারি। আসলে আমি কিছুই ভুলতে চাই না। আমি একজন শরণার্থী। আমার দাদা-দাদিও ছিলেন সেই শরণার্থীদের মধ্যে, যাঁরা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদারের কারণে নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হন। তাঁরা গাজা উপত্যকায় এসে শহরের পশ্চিম দিকে খান ইউনুস শরণার্থী ক্যাম্পে থাকতে শুরু করেন।

ইসরায়েলি বাহিনী ঈদের আগের রাতে আমাদের বাড়িটা গুঁড়িয়ে দিল। আমরা ঈদের দিন সকালে সেখানে গিয়েছিলাম। মনে আছে, আমি আমার নতুন ঈদপোশাক পরে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ঈদ উদ্‌যাপন করেছিলাম।

আমার জন্ম সেই ক্যাম্পেই। কিন্তু ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাকে সেখানে থাকতে দেয়নি। ২০০০ সালে তারা আমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। এরপর দুই বছর আমরা আশ্রয়হীন ছিলাম। এক বাসা থেকে আরেক বাসায় ঘুরেছি। সব কটি জায়গাই ছিল বসবাসের অযোগ্য। শেষমেশ ২০০৩ সালে ইউএনআরডব্লিউএ আল-ফুখারিতে আমাদের একটা নতুন ঘর দেয়। এলাকাটা ছিল খুব সুন্দর। চারপাশে ছিল খেতখামার। পাশেই ইউরোপিয়ান হাসপাতাল। হাসপাতালের নামে এলাকার নাম ‘ইউরোপিয়ান হাউজিং’।

পাঁচজনের জন্য বাসাটা ছিল ছোট। আমাদের একটা ঘর, একটা বসার ঘরের দরকার ছিল। রান্নাঘরটা মেরামতের দরকার ছিল।

তবু আমরা সেখানে প্রায় ১২ বছর ছিলাম। ২০১৫ সালের দিকে আমি কাজ শুরু করি বাবাকে সাহায্য করার জন্য।

আরও পড়ুন

বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, যেন আমাদের বাড়িটা ঠিকঠাক করতে পারি। আমরা চেষ্টা করে বাসাটা ঠিক করেছিলাম। প্রায় ১০ বছর ধরে অল্প অল্প করে টাকা যা ছিল, তা–ই দিয়ে বাড়িটা বানিয়েছি। যুদ্ধ শুরুর মাত্র তিন মাস আগে বাড়ির কাজ শেষ হয়েছিল।

যখন যুদ্ধ এল, অবরোধ, দারিদ্র্য আর সংগ্রামের ক্লান্তিতে আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। যুদ্ধ সবকিছু গ্রাস করে নিল। আমার হৃদয় ভেঙে দিল, আমার মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেল।

ভীষণ তাড়া নিয়ে জেগে উঠি

যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা কিছু না কিছু নিয়ে লড়াই করেছি। বেঁচে থাকার জন্য লড়তে হচ্ছে। না–খেয়ে না–পান করে মরে না যাওয়ার জন্য লড়ছি। চারপাশের ভয়াবহতা দেখে পাগল না হয়ে যাওয়ার জন্যও লড়তে হচ্ছে।

আমরা যেভাবে পারি বাঁচার চেষ্টা করি। বারবার বাড়িঘর হারিয়েছি। পুরো জীবনে আমি চারটি বাড়িতে থেকেছি। প্রতিটি বাড়ির আশপাশে ইসরায়েলি বোমা পড়েছে। থাকার মতো নিরাপদ জায়গা আমাদের নেই। যুদ্ধবিরতির আগে পুরো ৫০০ দিন ধরে ভয়ানক আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি।

যুদ্ধের সময় আমি যেটা করতে পারিনি, সেটা হলো কান্না করা। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। দুঃখ আর ক্ষোভ নিজের ভেতরে চেপে রেখেছি। এতে আমার ভেতরটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আরও দুর্বল হয়ে গেছি।

আশপাশের সবাইকে সাহায্য করেছি, সাহস দিয়েছি। বলেছি, ‘উত্তর থেকে লোকজন আবার ফিরে আসবে। সেনারা নেতজারিম থেকে সরে যাবে।’ সবাইকে সাহস দিতে চেয়েছি, যদিও আমি ভেতরে ভেতরে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তবে এটা আমি কাউকে দেখাতে চাইনি। আমার মনে হতো, যদি আমি আমার দুর্বলতা দেখাই, এই ভয়াবহ যুদ্ধে আমি হারিয়ে যাব।

যুদ্ধবিরতি ছিল আমাদের বেঁচে থাকার আশা। বিরতির সময় মনে হয়েছিল, আমি বেঁচে গেছি। যুদ্ধ শেষ। যখন মানুষ জিজ্ঞেস করত, ‘আবার কি যুদ্ধ হবে?’ আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতাম, ‘না, আমার মনে হয় না। যুদ্ধ শেষ।’ কিন্তু যুদ্ধ ফিরে এল। এবার আরও কাছে চলে এল।

সেই আতঙ্ক আমার ভেতরে আবার ফিরে এল, যার শেষ নেই। আতঙ্ক এল একটানা গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে। আমাদের ওপর সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে—রকেট, যুদ্ধবিমান আর ট্যাংক থেকে ছোড়া হয়েছে শেল। ট্যাংক থামেনি, ড্রোন উড়েছে। সবকিছুই ছিল ভয়ংকর।

আরও পড়ুন

আমি এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। কখনো একটু ঘুম এলেও বিস্ফোরণের শব্দে জেগে উঠি। উঠেই ছোটাছুটি করি। জানি না কোথায় যাচ্ছি, তবু ঘরের ভেতরে দৌড়াই। এই টানা আতঙ্কে বুকের ওপর হাত রেখে ভাবি, এই হৃদয়টা আর কতটা সইতে পারবে?

আমার সব বন্ধুর কাছে একটা মেসেজই পাঠাই, আমার গল্পটা ছড়িয়ে দাও, যেন আমি শুধু একটা সংখ্যা হয়ে না যাই।

আমরা এখন অসহ্য এক সময় পার করছি। ইসরায়েলি সেনারা আমার আশপাশের এলাকা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখনো এখানে অনেক পরিবার আছে। তারা যেতে চায় না। কারণ, ভিটেমাটি মানে শুধু ঘর হারানো নয়—শারীরিক, মানসিক আর আর্থিকভাবে ভেঙে পড়া।

প্রথম ঘর হারানোর ঘটনা আমার মনে আছে। সেটা ২০০০ সালের ঘটনা, আমার বয়স তখন প্রায় আট বছর। একদিন ইসরায়েলি বাহিনীর বুলডোজার আমাদের খান ইউনিস ক্যাম্পে ঢুকে আমার চাচা আর দাদুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল। তারপর কোনো এক অজানা কারণে আমাদের বাড়ির সামনে এসে বুলডোজার থামল। ফলে আমরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। তখন রমজান মাস। আব্বা-আম্মা ভাবলেন, পরে ফিরে আসা যাবে। ফিরে গিয়ে দেখলেন, প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা ঘর। এখানে আমরা অস্থায়ীভাবে থাকব বলে ভেবেছিলাম।

আমি বাসা হারানোর দুঃখ মেনে নিতে পারিনি। তাই আমি দৌড়ে দৌড়ে ফিরে যেতাম আমাদের সেই পুরোনো বাড়িতে, যেখানে আছে আমার দাদা-দাদির সঙ্গে কাটানো সুন্দর সময়ের স্মৃতি। সেখান থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আসতাম মায়ের জন্য।

রুওয়াইদা আমির ১০ বছর শিক্ষকতা করেছেন
রুওয়াইদা আমিরের সৌজন্যে আল-জাজিরা থেকে

ইসরায়েলি বাহিনী ঈদের আগের রাতে আমাদের বাড়িটা গুঁড়িয়ে দিল। আমরা ঈদের দিন সকালে সেখানে গিয়েছিলাম। মনে আছে, আমি আমার নতুন ঈদপোশাক পরে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ঈদ উদ্‌যাপন করেছিলাম।

ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের কিছুই নিতে দেয়নি। ওরা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে। আমাদের জন্য ফেলে যায় শুধু দুঃখ আর হতাশা। যদি দুনিয়া আমাদের এই ভয়াবহ বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা না করে, তবে আমি জানি না ভবিষ্যতে আমাদের কপালে কী আছে। আমি জানি না আমার অন্তর এই অবিরাম শব্দ আর আতঙ্ক সহ্য করতে পারবে কি না। তাই আমাকে ভুলে যেয়ো না।

আমি আমার জীবনটা রক্ষার জন্য কঠিন সংগ্রাম করেছি। সাংবাদিকতা করেছি। শিক্ষক হিসেবে ১০ বছর ধরে পরিশ্রম করেছি। নিজেকে উৎসর্গ করেছি এসব কাজে। আমার ছাত্রছাত্রী আছে, যাদের আমি ভালোবাসি। সহকর্মী আছে, যাদের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি।

গাজায় জীবন কখনোই সহজ ছিল না। তবু আমরা গাজাকেই ভালোবাসি। আর কোনো জায়গাকে এতটা ভালোবাসতে পারি না।

আল-জাজিরা ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহমাদ মুদ্দাসসের

আরও পড়ুন