বইয়ের পাতায় মুক্তিযুদ্ধ
সত্যি করে বলো তো, টান টান উত্তেজনার কোনো গোয়েন্দা গল্পের বই পড়তে পড়তে মনে হয় না, আশপাশের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নিজেই একটা দল-টল খুলে ফেললে দারুণ হতো? একবার কোমর বেঁধে নেমে পড়তে পারলে তোমাকে আর পায় কে! হয়তো তদন্ত করতে করতে চলে যেতে গহিন কোনো অরণ্যে কিংবা ধু ধু কোনো মরুভূমিতে মাথা খাটিয়ে পাকড়াও করে ফেলতে দুর্ধর্ষ কোনো ক্রিমিনালকে। ভাবতেই কেমন মন উচাটন হয়ে ওঠে না?
খোকনদেরও তা-ই হতো। তাই তো ছয় বন্ধু মিলে আস্ত একটা বিশ্বভ্রমণের দলই খুলে ফেলেছিল তারা। নাম রেখেছিল ‘ভয়াল ছয়’। দল তৈরি, সদস্যরা প্রস্তুত, বাক্সপেটরা নিয়ে আফ্রিকার উদ্দেশে শুধু বেরিয়ে পড়লেই হয়—ব্যস, এমন সময়ে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। উল্টেপাল্টে গেল ‘ভয়াল ছয়’-এর ছয় সদস্যের দিনকাল।
বলছি, হুমায়ূন আহমেদের সূর্যের দিন উপন্যাসের কথা। পড়তে পড়তে নীলুর দাদু, সাজ্জাদের হারিয়ে যাওয়া দুলাভাই, খোকনের বড় চাচা আর নীলুদের সঙ্গে ২০২৩ থেকে টেলিপোর্ট করে তুমি ঠিক শাঁ করে চলে যাবে একাত্তরের সেই টালমাটাল সময়গুলোতে। বইটি পড়ে বাকিদের মতো কেঁদে ভাসাও না বলে যারা আমার মতো নাক উঁচু করে ঘুরে বেড়াও, দেখবে নাকি একবার বইটা পড়ে?
মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু বিজয়েরই গল্প নয়। এ বিজয়ে মিশে আছে কোল খালি হওয়া মায়েদের অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস আর চাপা কান্নার স্রোত। তাই মুক্তিযুদ্ধের বেশির ভাগ লেখাতেই বারবার ফিরে আসে স্বজন হারানোর বেদনা আর যুদ্ধের নৃশংসতার স্মৃতি।
এই যেমন সত্য ঘটনা অবলম্বনে আনিসুল হকের লেখা মা উপন্যাসটির কথাই ধরো। ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা আজাদ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর লোহার শিকের ওপার থেকে মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। মা পরদিন যত্ন করে ভাত-তরকারি রেঁধে নিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু পুত্রের সঙ্গে আর তাঁর দেখা হলো না। আজাদ ও তার শহীদ সহযোদ্ধাদের এরপর কোনো দিনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছেলেকে খাওয়াতে পারেননি বলে তাঁর মা–ও আর ভাত খাননি কখনো। ছেলে শক্ত মেঝেতে শুয়ে ছিল বলে নিজেও বিছানাহীন শক্ত মেঝেতে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন আজীবন।
এ রকম আরেকজন দুঃখী মা শহীদজননী জাহানারা ইমাম। একাত্তরের মার্চের প্রথম দিনটি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি অবধি তিনি প্রায় প্রতিদিনই ডায়েরি লিখে গেছেন, পরে যা বই হিসেবে বের হয়েছে একাত্তরের দিনগুলি শিরোনামে। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রথমবার চরমপত্র শোনা, এয়ার রেইডের ভয়ে জানালায় কালো কাগজ সেঁটে রাতের বেলা বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে মোমবাতির আলোয় ভয়মেশানো প্রতীক্ষা, ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা হামলা ওরফে ‘বিচ্ছু অ্যাকশন’-এর খবরাখবর পেয়ে উল্লাস—পড়তে পড়তে মুক্তিযুদ্ধের একেকটা দিন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
বইটি পড়লে আমাদের মনে সবচেয়ে বেশি ছাপ রেখে যায় রুমি। শাফী ইমাম রুমি—ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হেলায় সরিয়ে যে মেলাঘর গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। একাত্তরের ২৯ আগস্ট শহীদ আজাদ, জুয়েল, বদি, আলতাফ মাহমুদসহ ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের সঙ্গে ধরা পড়ে রুমিও। তার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায় ছোট ভাই জামী আর বাবা শরীফ ইমামকেও। দিশাহারা মা তখন স্বামী-ছেলের খোঁজে কী করেননি! কখনো পাগলাপীরের কাছে ধরনা দিচ্ছেন, কখনো মার্সি পিটিশন করবেন কি না নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন, কখন প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমার খবর আসবে, সে আশায় বুক বাঁধছেন। শরীরে-মনে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের ক্ষত নিয়ে শরীফ ইমাম আর জামী কিছুদিন বাদে ফিরে এলেও রুমির খোঁজ আর কখনো পাওয়া যায়নি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের বই যারা নিয়মিত পড়ো, তারা নিশ্চয়ই জানো তাঁর লেখায় বারবার ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। তাই মুক্তিযুদ্ধের গল্পের এই আলাপে আলাদা করে তাঁর কোনো বইয়ের নাম বলাটা বেশ শক্ত। তবে এর মধ্যেও আমার বন্ধু রাশেদ, গ্রামের নাম কাঁকনডুবি আর কিছুদিন আগে প্রকাশিত ফেরা—এই বই তিনটির কথা না বললেই নয়। দারুণ তিনটি বই–ই লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কে কেন্দ্র করে। এত দিনে নিশ্চয়ই অনেকে বই তিনটি পড়ে ফেলেছ। যারা পড়োনি, কী যে মিস করে গেলে, নিজেই জানো না! চটপট পড়ে নিয়ে এত সুন্দর বইয়ের খবর দেওয়ার জন্য আমাকে ট্রিট দিয়ে দিয়ো, ঠিক আছে?
ফিকশনের বাইরে মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইটি অবশ্যপাঠ্য। ২২ পাতার ছোট্ট একটি বই, বই না বলে পুস্তিকাও বলা যায়, কিন্তু তার মধ্যেই কী দারুণভাবে সংক্ষেপে উঠে এসেছে আমাদের বাংলার ইতিহাসের নির্যাসটুকু!
তার সঙ্গে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া একাত্তরের চিঠি তো পড়তেই হবে। যুদ্ধের সময় পরিবারের বা সহযোদ্ধাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো চিঠির সংকলন এ বই। মায়ের কাছে যুদ্ধরত সন্তানের চিঠি, অনাগত সন্তানের নাম কী রাখা হবে, তা জানিয়ে বাবার চিঠি—কী নেই সেখানে? একেকটা চিঠি পড়তে পড়তে তোমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে। একাত্তরের ১৬ এপ্রিল আবদুল আজিজ তাঁর স্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন, ‘মিঠু বোধ হয় এখন হাঁটতে শিখেছে তাই না? মিঠুকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু পথ নেই। সান্ত্বনা এইটুকুই যে বেঁচে থাকলে একদিন দেখা হবে।’ রণক্ষেত্রে শহীদ হয়েছিলেন আবদুল আজিজ। আদরের ছোট্ট মিঠুর সঙ্গে তার বাবার আর কখনো দেখা হয়নি।
পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণির ফারুক বাড়িতে চিঠি লিখে গিয়েছিল, ‘বাবা, আমি চলে যাচ্ছি।...আজ যদি আপনার পুত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, আপনি কি দুঃখ পাবেন, বাবা?’ এর কিছুদিন পরই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। শহীদ হন পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। ফারুক ছিল তাদের মধ্যে একজন।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর নিজস্ব ধারার লেখার জন্য বেশি আলোচিত বলেই হয়তো ছোটদের জন্য তাঁর দারুণ মিষ্টি লেখাগুলো সাধারণত একটু আড়ালেই থেকে যায়। তাঁর আব্বুকে মনে পড়ে উপন্যাসটিকে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধধর্মী হয়তো বলা যায় না, কিন্তু বাদও দেওয়া যায় না এই তালিকা থেকে। পিতা-পুত্রের সম্পর্কের কী আদরমাখা আখ্যান লিখে গেছেন লেখক, পড়লেই বুঝতে পারবে।
তোমরা যারা নবম শ্রেণিতে উঠে পড়েছ, এত দিনে নিশ্চয়ই সেলিনা হোসেনের কাকতাড়ুয়া উপন্যাসটির সঙ্গে তোমাদের পরিচয় হয়ে গেছে। সিলেবাসের অংশ হিসেবে নয়, উপন্যাস হিসেবে পড়ে দেখোই না একবার, কেমন লাগে! পড়ে নিতে পারো তাঁর লেখা কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ-ও।
পড়তে পারো মোস্তফা হোসেইন সম্পাদিত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সমগ্র–ও। ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা, যারা কৈশোরের দোরগোড়া না পেরোতেই দেশকে স্বাধীন করতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল হাতে, তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনায় সমৃদ্ধ বইটি। আছে হাসান হাফিজ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প সংকলন। আলোচিত লেখকদের পাশাপাশি আরও অনেক বিখ্যাত লেখকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পের সন্ধান পাবে তাতে। সেই সঙ্গে শাহরিয়ার কবিরের লেখা একাত্তরের যীশু, মাহবুব আলমের গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে, আবুল মোমেনের আরও এক বধ্যভূমি, সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডায়েরি, আনোয়ারা সৈয়দ হকের মুক্তিযোদ্ধার মা, আহসান হাবীবের ৭১-এর রোজনামচা, শওকত ওসমানের মুজিবনগরের সাবু—আমাদের দারুণ সব লেখক পরম মমতায় শিশু-কিশোরদের জন্য লিখে গেছেন চমৎকার সব লেখা।
পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা সবাই পড়ি। কোন অঞ্চল কোন সেক্টরে ছিল, কজন মুক্তিযোদ্ধা কোন খেতাব পেয়েছেন কিংবা কত সালের কত তারিখে কী ঘটেছিল—এসব খটমট তথ্য মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসতে হয় সবাইকেই। কিন্তু সত্যিকারের যুদ্ধটা আসলে কেমন ছিল, সেটাকে ঠিক ঠিক অনুভব করতে হলে এই বইগুলো পড়তেই হবে। অনেক তো স্পাইডারম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা আর ডক্টর স্ট্রেঞ্জের কমিকস-সিনেমা দেখা হলো। এবার নাহয় যাঁরা আমাদের সত্যিকারের সুপারহিরো, সেসব মুক্তিযোদ্ধার গল্পগুলো জেনে নাও!