ঢাকায় ১৫ লিটার ওয়াসার পানির দাম এক টাকা। কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণে বাগেরহাটের রামপালে এক লিটার মিঠাপানির দাম এক টাকা। ঢাকার ১৫ লিটারের সমান। নদী-খাল-বিল পুকুরের পানি লবণাক্ত। আবার উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাওয়ার পানির সংকট বাড়ছে। এমন এলাকা থেকে ঢাকায় প্রথমবারের মতো ঘুরে দেখতে এসেছে ৪০ জন শিক্ষার্থী। ‘অবাক কুতূহলে’ আয়োজনে ঢাকায় দুই দিন থেকে ঘুরেফিরে দেখেছে তারা। ঘোরার তালিকায় ছিল সংসদ ভবন, নভোথিয়েটার, বিজ্ঞান জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু জায়গা। সবাই সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সবার গায়ে ছিল কমলা রঙের টি-শার্ট। বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে বাসে চেপে ঢাকায় আসার সময় জল্পনাকল্পনা ছিল। বলা হয়েছিল, জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে তাদের দেখা হবে।
ছয় স্কুলের শিক্ষার্থীরা বাসে বসে আসার পথে নিজেদের মধ্যে পরিচিত হয়েছে। সেদিন ছিল ৭ মার্চ। ছেলেমেয়েরা মেন্টরদের সহযোগিতায় বেশ কিছু জায়গা ও প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছে। ঢাকায় ‘অবাক কুতূহলে’তে ওদের নিয়ে আসার কারণ, উপকূলীয় জলবায়ু আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ঢাকায় ওদের ভ্রমণের জায়গাগুলো সেভাবেই সাজিয়েছেন আয়োজকেরা। ৮ মার্চ নারী দিবসে যাত্রা শুরু হয়েছে সংসদ ভবনের সামনে থেকে। এরপর নভোথিয়েটারে গিয়ে জেনেছে মহাকাশের বিপুল বিস্ময়। এখান থেকে বেরিয়ে বাস চলেছে আইটি প্রতিষ্ঠান ওলিওতে। আইটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করে, ঘুরে ঘুরে দেখেছে ওরা। ওলিও থেকে আরেক আইটি প্রতিষ্ঠান ব্রেন স্টেশনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
নারী দিবসের সন্ধ্যায় সত্যি সত্যি ওদের সামনে হাজির হয়েছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ছিলেন অধ্যাপক লাফিফা জামাল, কৃষিবিদ কাশফিয়া আহমেদ ও গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। প্রিয় লেখক, শিক্ষক ও গবেষককে সামনে পেয়ে ওদের অভিজ্ঞতা, অনুভূতির কথা বলেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ওরা প্রশ্ন করেছে, লেখক হওয়ার উপায় নিয়ে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, ‘আমার জন্ম হয়েছে বইয়ের মধ্যে, বেড়েও উঠেছি বইয়ের মধ্যে। আমার বাবার অনেক বই ছিল। সেগুলো পড়তে পড়তেই আমাদের বেড়ে ওঠা।’ জাফর ইকবালের ভক্ত এই আয়োজনে অংশ নেওয়া অথরা চৌধুরী। অথরা বলেছে, ‘আমি জাফর স্যারের বই পড়ি। কখনো কল্পনা করিনি স্যারকে সামনাসামনি দেখতে পাব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল ওদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ওদের জিজ্ঞেস করেছেন, ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ অনেকে বলেছে, বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চায়। ছিলেন কৃষিবিদ কাশফিয়া আহমেদ। তিনি প্রযুক্তি ও কৃষির সমন্বয় করেছেন শুনে ছেলেমেয়েরা জানতে চায়, প্রযুক্তির সঙ্গে কীভাবে কৃষিকে যুক্ত করা হয়? তিনি বলেন, বুয়েটের গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে মুঠোফোনে দেশব্যাপী কৃষকদের ফোনে ফোনে সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা চালুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ধারণা ছিল, কৃষি মানেই মাঠের কাজ। কিন্তু কৃষিতে প্রযুক্তির প্রয়োগ দেখে ওরা চমৎকৃত হয়েছে।
এই আয়োজনে মোংলার পেড়িখালী মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসেছে মিলন হাওলাদার। মিলন জানায়, ‘উপকূলীয় এলাকায় মাঝেমধ্যে আমাদের অঞ্চলে ঝড়, বন্যা আঘাত হানে। তখন মিঠাপানির পুকুরে লোনাপানি ঢুকে যায়। লবণের কারণে তেমন কোনো ফসল ফলানো যায় না। যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো নয়। ঝড়-বৃষ্টিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎ চলে যায়।’ বাগেরহাটের উদ্দীপন বদর সামছু বিদ্যানিকেতন থেকে এসেছে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুন নেছা। সে বলে, ‘ঢাকায় আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে বিজ্ঞান জাদুঘর। ওখানে পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো এক্সপেরিমেন্ট আছে। আমি বায়োলজি পছন্দ করি। তবে চোখের সামনে বিজ্ঞানের সূত্রের প্রয়োগ দেখে ভালো লেগেছে।’
দ্বিতীয় দিন শিক্ষার্থীদের মেট্রোরেলে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে। এরপর প্রথম আলো, কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তার কার্যালয় ঘুরে দেখেছে ওরা। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও লেখক আনিসুল হকের সঙ্গে ছবি তুলতে পেরে খুব খুশি হয়েছে।
উপকূলীয় অঞ্চলের ছয়টি স্কুলে মেয়েদের নিয়ে একটি প্রকল্প চলছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, গণিত ও রোবোটিকস শেখানোর জন্য কর্মশালা, ক্যাম্প, প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে বছরজুড়ে। প্রকল্পের এই পর্যায়ে স্কুলগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা গণিত, রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে। এই প্রকল্পভুক্ত স্কুল থেকে মেয়েরা অংশ নিয়েছে এবারের আয়োজনে। মালালা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে আয়োজিত হয়েছে ‘অবাক কুতূহলে’। বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন। আয়োজন সহযোগী বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক।