আমাদের চারপাশে রাশি রাশি গাছপালা লতাগুল্ম। এদের আবার নানান রকমফের। অর্থাৎ একই গাছ একেক মৌসুমে একেক রকম। কখনো পাতা থাকে না, কখনো আবার নতুন কচি পাতার উচ্ছ্বাস, কখনো বাহারি ফুল, কখনো উপাদেয় ফল। মূলত এসব বিচিত্রতাই আমাদের বৃক্ষজগৎ সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। তখন আমরা একটি কচি পাতা, মনোলোভা ফুল বা ফলের লোভে গাছের কাছে যাই। এভাবেই গাছের সঙ্গে আমাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আমাদের সঙ্গে বৃক্ষ বা প্রকৃতির এই যে যোগাযোগ তার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে কবিতা বা গল্প-উপন্যাস। যখন আমরা সরাসরি একটি ফুলের কাছে যেতে পারি না তখন কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের সেখানে নিয়ে যান।
তবে আমাদের দেশে যেসব ফুল দেখা যায়, তার সবগুলো নিয়েই কবিরা কবিতা লিখেছেন এমন নয়। এ ক্ষেত্রেও তাঁরা রূপ-গুণের বাছ-বিচার করেছেন। অর্থাৎ দেখতে খুব সুন্দর বা সুবাস আছে এমন ফুল নিয়েই বেশি কবিতা রচিত হয়েছে। আবার ফুলগুলোও বেশ চালাক, যাদের রূপ নেই তারা সুবাস দিয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, আর যাদের সুবাস নেই, তারা রূপ দিয়ে সবার মন জয় করতে চায়। এভাবেই আমাদের শিল্প-সাহিত্যের একটি বড় অংশ দখল করে আছে চারপাশের বৃক্ষজগৎ।
এখানে আরেকটি কথাও বলে রাখি, গাছপালা নিয়ে কিন্তু খুব বেশি কবি-সাহিত্যিক লেখেননি। মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন এ বিষয়ে চমৎকারভাবে লিখেছেন। সবার আগে কবি কালিদাসের কথা বলতে হয়। তারপর অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তিনি আমাদের বারবার প্রকৃতির কাছে নিয়ে গেছেন। তাঁর হাত ধরেই আমরা প্রকৃতির বর্ণিল জগতে প্রবেশ করি। আর আছেন জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন এবং বন্দে আলী মিয়ার মতো বিখ্যাত কবিরা। তাঁদের জীবন্ত বর্ণনায় প্রকৃতি আমাদের চোখের সামনে একেবারে তরতাজা হয়ে ভেসে ওঠে। তাঁরা কবিতায় যেসব ফুলের ছবি এঁকেছেন, তার কয়েকটি সম্পর্কে জানা যাক।
গুলাচি
রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে শুরু। তিনি লিখেছেন, ‘ফুলগুলি যেন কথা/ পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার/ পুঞ্জিত নীরবতা’। গুলাচি গাছের ফুল-পাতা ও গড়নের সঙ্গে এই কবিতার অনেক মিল আছে। চৈত্র মাসেও কোনো পাতা থাকে না গাছে। তখন ন্যাড়া গাছটা দেখতে অনেকটা কঙ্কালের মতো। টুকরা টুকরা ডাল কেউ যেন ইচ্ছে করেই জোড়া লাগিয়ে রেখেছে। গরমের শুরুতে একটু বৃষ্টি হলেই দু-একটি করে ফুল ফুটতে শুরু করে। এ ফুলের আরও অনেক নাম কাঠচম্পা, গোলকচাঁপা, গৌরচম্পা, গুলঞ্চ, চালতা গোলাপ, গড়ুরচাঁপা ইত্যাদি। এরা নামের মতো গড়ন এবং রঙের দিক থেকেও বিচিত্র। প্রায় শরৎ-হেমন্ত পর্যন্ত ফুল ফুটতে দেখা যায়।
শেফালি
এবার শিউলি ফুলের কথা। শিউলি ফুল নিয়ে কথা বললেই শরৎকালের কথা চলে আসে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যখন শরৎ কাঁপে শিউলি ফুলের হরষে’। তিনি এভাবে ১৫-২০ বার শিউলি ফুলের কথা বলেছেন। আবার কবি নজরুল শিউলি ফুল নিয়ে গান বেঁধেছেন, ‘তোমারি অশ্রু জলে শিউলিতলে সিক্ত শরতে’। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘যখন হলুদ বোঁটা শেফালির কোনো এক নরম শরতে/ ঝরিবে ঘাসের ’পরে...’। এ ফুলের আরেক নাম শেফালি। ফুল ফুটতে শুরু করে সন্ধ্যার পরপরই। আবার সূর্য ওঠার আগেই ঝরে পড়ে গাছতলায়। যেন সূর্যের সঙ্গেই তার আড়ি। ভোরে গাছতলায় শিশিরভেজা সাদা পাপড়ির ফুলগুলো ছড়িয়ে থাকে। শিশুরা সেসব ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে।
জুঁই
যূথি, জুঁই, যূথিকা একই ফুল। আমাদের জানামতে রবীন্দ্রনাথ যূথি বা যূথিকা নিয়ে ১৮টি পঙ্ক্তি রচনা করেছেন আর জুঁই নিয়ে করেছেন অন্তত চারটি। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন মালতী, যূথি, জাঁতি/কৌতূহলে উঠেছিল মাতি’। আবার ‘চলিলে সাথে, হাসিলে অনুকূল/তুলিনু যূথি, তুলিনু জাঁতি, তুলিনু/ চাঁপাফুল’।
এ ফুলের আদি আবাস ভারত। এরা ইংরেজিতে জেসমিন নামে পরিচিত। আর বাংলায় বেলি বা জুঁই-জাতীয় ফুল। শক্ত লতার গাছ। বহুবর্ষজীবী। ফুল সাদা, সুগন্ধি, আকারে ছোট এবং বেলির তুলনায় পাপড়িসংখ্যা খুবই কম। বসন্ত থেকে শুরু করে শীতের আগ অবধি অনেকবার ছোট ছোট থোকায় ফোটে।
কামিনী
কামিনী ফুল নিয়ে কবিগুরুর কয়েকটি লাইন মনে রাখার মতো, ‘তরুশাখে হেলাফেলা/ কামিনী ফুলের মেলা,/ থেকে থেকে সারাবেলা/ পড়ে খসে খসে’। এভাবে তিনি আরও পাঁচ থেকে ছয়টি কবিতায় কামিনী ফুলের কথা বলেছেন।
একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই কামিনী ফুলের একটি মজার কাণ্ড চোখে পড়বে। যখন একটি কামিনীগাছে ফুল আসে, তখন একই সঙ্গে দেশের সবগুলো গাছেই ফুল ফোটে। এক গাছের সঙ্গে অন্য গাছের কেমন অদ্ভুত যোগাযোগ। তখন পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত কামিনীগাছ অসংখ্য ফুলের ভারে নুয়ে পড়ে। সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশেই কামিনীগাছ দেখা যায়। বাগানে কামিনী থাকলে দল বেঁধে বুলবুলি পাখিরা আসে।
নাগেশ্বর
রবীন্দ্রনাথ নাগেশ্বর নিয়ে লিখেছেন, ‘মাঘের শেষে নাগকেশরের ফুলে/ আকাশে বয় মন-হারানো হাওয়া’। আবার প্রাচীন লোকগাথায়ও নাগেশ্বরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গাছটি চেনা খুবই সহজ। যদি পথের পাশে বা কোনো পার্কে এমন একটি গাছ চোখে পড়ে, যে গাছটির গড়ন অনেকটা পিরামিডের মতো, অর্থাৎ গোড়ার দিকে একটু ছড়ানো, গোলগাল; ওপরের দিকে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে উঠেছে, তখন ধরে নিতে হবে এটাই নাগেশ্বর। এই গাছ আরেকটি মজার কাণ্ড ঘটায়, প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন ডালপালায় উজ্জ্বল তামাটে রঙের কচি পাতা গজাতে থাকে। এসব পাতা দূর থেকে দেখতে ছোপ ছোপ লালের মতো। আর পাতাগুলো কিছুটা সরু ও লম্বা ধরনের। ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম বসন্ত। এক বৃন্তে দুটি ফুল থাকে, ইঞ্চি দুয়েক চওড়া। পাপড়ি পাঁচটি, একটু ছড়ানো ও সাদা রঙের, মাঝখানে আছে এক থোকা সোনালি কেশর, অপূর্ব সুগন্ধি।
কদম
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কদম নিয়ে একটি চমৎকার গান লিখেছেন, ‘চামেলি কদম যূথী মুঠি মুঠি ছড়ায়ে/উতল পবন দে অঞ্চল উড়ায়ে’। মেঘে ঢাকা বাদলা দিনে ছায়াঘন বনের গাছে গাছে কদম ফোটে। তখন ভেজা বাতাসে কদমের সুবাস ভেসে বেড়ায়। কদম্ব এবং নীপ কদমের ভিন্ন দুটি নাম। কদমের শোভা অপূর্ব। এই কারণে কবিগুরুও ফুলটির প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান’। কদম বড়সড় ধরনের গাছ। পাতা বিরাট, উজ্জ্বল সবুজ এবং তেলচকচকে। ফুল দেখতে ছোটখাটো সোনার বলের মতো ঝলমলে, তাতে অসংখ্য সরু সরু সাদা ফুল, চমৎকার একটা কুণ্ডল যেন।
হিজল
কবি জীবনানন্দ দাশ হিজলকে হৃদয়ের ফুল বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে’। আর পল্লীকবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন, ‘কলমি ফুলের নোলক দেব/ হিজল ফুলের দিব মালা,/ মেঠো বাঁশি বাজিয়ে তোমায়/ ঘুম পাড়াব গাঁয়ের বালা।’ হিজল আমাদের খুব চেনা গাছ। যদি বর্ষার জলটইটম্বুর মাঠে গলাসমান পানিতে কোনো ঝাঁকড়া গাছকে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে গাছটি হিজল ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই গাছ ফুল, পাতা ও গড়নে ভারি সুন্দর। ঝুলে থাকা মঞ্জরির চারপাশে লালচে রঙের অসংখ্য ফুল ফোটে গ্রীষ্মে। রাতে ফোটা ফুলগুলো বেলা ওঠার আগেই ঝরে পড়ে গাছতলায়।
বকুল
বকুল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয় ফুল। তিনি তাঁর সমগ্র লেখায় বকুল ফুলের কথাই বলেছেন সবচেয়ে বেশি। তিনি বকুল নিয়ে অন্তত ৪৩টি পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল/আঁচল আকাশে হতেছে আকুল’। বকুল আমাদের চেনাজানা একটি ফুল। কারণ বকুলগাছ দেখার সুযোগ না হলেও বকুল ফুলের মালা পাওয়া যায় পথেঘাটে। তাই এ ফুল চিনতে খুব একটা অসুবিধা নেই। আবার এই ফুলের বাড়তি সুবিধা হলো ফুল শুকিয়ে গেলেও সুবাস থাকে অনেক দিন। তাই কেউ কেউ শুকনো ফুল বই বা খাতার ভেতর রেখে দেয়। এই ফুল শিশুদের খুবই প্রিয়। গাছতলার ফুল কুড়িয়ে ওরাই মালা গাঁথে।