ধরো, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ঘুরতে বেরিয়েছ। পৃথিবীর কসাইখানা বলে পরিচিত এই শহরের যেখানে-সেখানে কিন্তু কসাইদের বাস নেই, বরং কসাইরা আর সব বড় শহরের মতো একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই বাস করে। এই শহর বরং অন্য একটা কারণে বিখ্যাত।
মনে করো, শহরটাতে ঘুরতে ঘুরতে এফ আর ওয়ে নামে একটা রাস্তায় পৌঁছে গেলে। সামনে বিশাল ভবন। কালচে তার গায়ের রং। কিন্তু মুশকিল হলো ভবনের পুরোটা তুমি দেখতে পাচ্ছ না। পারবে কী করে, ভবনটা যে কবিগুরুর ‘তালগাছ’-এর মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব বাড়ি ছাড়িয়ে একেবারে আকাশে উঁকি দিয়েছে। তুমি যদি পণ করে থাকো সেটার মাথাটি দেখবেই, তাহলে তোমাকে হয়তো মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে। কিন্তু ভুলেও ও কাজটি করতে যেয়ো না। এ দেশের মতো ওখানে ছেলেমেয়েরা পাগল দেখে ঢিল হয়তো ছুড়বে না, কিন্তু একচোট হেসে নেবে। তার চেয়ে বরং কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে ঢুঁ মেরে গুগল মামার কাছে জেনে নিতে পারো।
তিনি বলবেন, ভবনটার নাম উইলিস টাওয়ার। কিন্তু সারা বিশ্ব একে সিয়ার্স টাওয়ার নামে চেনে। এটা টাওয়ারের আগের নাম। মালিকানা বদল হওয়ার পর উইলিস হয়েছে এর নাম। ১৯৭০ সালে টাওয়ারটি তৈরি করা হয়। ১১০ তলা এই ভবনের উচ্চতা আধা কিলোমিটারেরও বেশি—৫২৭ মিটার। একটানা ২৫ বছর এর দখলে ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবনের মুকুট। কিন্তু যে জন্য এত প্যাঁচাল, সেটা হলো এই টাওয়ারটার ডিজাইনার ফজলুর রহমান খান। তাঁকে বলা হয় স্থাপত্যবিদ্যার আইনস্টাইন।
ফজলুর রহমান খান ছিলেন আপাদমস্তক বাংলাদেশি। জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল, মাদারীপুরের শিবচরে। ১৯৪৪ সালে ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কিন্তু লেখাপড়ার পাট চুকানোর আগেই লেগে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রাণ নিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন ফজলুর রহমান খান। ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, আজকে সেটার নাম বুয়েট। শিবপুর কলেজে যে পর্যন্ত পড়েছিলেন, ঢাকায় এসে সেখান থেকেই বিশেষ বিবেচনায় বর্তমান বুয়েটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এবং তত্ত্বীয় ও ফলিত মেকানিকসে ডাবল মাস্টার অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরে সেখান থেকেই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আসেন ফজলুর রহমান খান। কিন্তু পরে আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডাক আসে। সেখানেই তাঁর মধ্যে স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ ঘটে। সেই যুগে গগনচুম্বী ভবন নির্মাণ সহজ ছিল না। ভবন যত উঁচু হয়, ভূমিকম্প কিংবা আবহাওয়াজনিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি তত বাড়ে। তাই শততলা ভবন তৈরির ঝুঁকি সে সময় কেউ নিতে পারেনি। ফজলুর রহমান খান স্থাপত্যশিল্পে যোগ করলেন টিউবলার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মূল ভবনের ঠিক মাঝখানে একটা ফাঁপা টিউব রাখা হয়। এতে ভবনের মূল কাঠামোর বাইরের দিকে চাপ ভাগ হয়ে যায়। ভূমিকম্প বা আবহাওয়াজনিত চাপও কমে যায়। কমে যায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।
ফজলুর রহমান খানের টিউবলার পদ্ধতি মেনে শিকাগো শহরেই ১৯৭০ সালে তৈরি হলো ‘জন হ্যানকক সেন্টার’ নামে একটা শততলা ভবন। ১৯৭৩ সালে তাঁরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তৈরি হলো সিয়ার্স টাওয়ার। সিয়ার্স টাওয়ার এখন আর বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ার নয়। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুই ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা এবং কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস-ই-টুইন টাওয়ারও তৈরি হয়েছে ফজলুর রহমান খানের টিউবলার পদ্ধতি ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্যস্ত ছিলেন সিয়ার্স টাওয়ার তৈরিতে। এর ফাঁকেই তিনি গোটা যুক্তরাষ্ট্র চষে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ে।
অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটিকে এফ আর খান নামেই চেনে বিশ্বের লোক। আর আমেরিকানরা তাঁকে ডাকত ফাজ খান নামে। ১৯৮২ সালে তিনি সৌদি আরবের জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন।