মিটিং চলছে। চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনছ। হঠাৎ টের পেলে, ঘুমে তোমার চোখ বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে; কিন্তু ঘুমানোর উপায় নেই। আবার মনোযোগ দিয়ে মিটিংয়ে অন্যদের কথা শুনছ। কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেলে, তোমার মাথাটা একটু নিচু হয়েই আবার যথাস্থানে চলে এসেছে। মানে তোমার ঝিমুনি এসেছে। হঠাৎ খুব মনোযোগী হয়ে ভাবছ, না আর ঘুমানো যাবে না। মনের মধ্যে এই যখন চিন্তাভাবনা চলছে, তখনই টের পেলে তোমার মাথাটা আবার নিচে নেমে গেছে। তাড়াতাড়ি এদিক–ওদিক তাকিয়ে দেখলে, কেউ তোমাকে ঘুমাতে দেখে ফেলল না তো? মিটিং ছাড়াও প্রায়ই আমাদের এমন ঘুম চলে আসে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মাইক্রোস্লিপ। মানে সংক্ষিপ্ত ঘুম। এক প্রজাতির পেঙ্গুইনের এই মাইক্রোস্লিপ একটু বেশিই হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার বার। ভাবছ তাহলে এরা কাজ বা খাওয়াদাওয়া করে কখন? তা–ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই করে।
পেঙ্গুইন কিন্তু বেশ পরিশ্রমী প্রাণী। ওদের বাসস্থান থেকে অনেক দূরে, কখনো কখনো সেটা ১৫ কিলোমিটার হতে পারে, খাবার সংগ্রহ করতে যায়। নিজের খাবার খেয়ে বাচ্চার জন্য খাবার বয়ে আনে; কিন্তু এই পরিশ্রমী প্রাণীটির একটি প্রজাতি খুব ঘুমপ্রিয়। তা না হলে কি আর দিনে ১০ হাজার বার ঘুমায়! এই প্রজাতির নাম চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন। তবে এগুলোর বেশির ভাগের ঘুমের স্থায়িত্বকাল মাত্র চার সেকেন্ড। এর মধ্যেই আবার ঘুম ভেঙে যায়। তবে ১০ হাজার বার ঘুমে সব মিলিয়ে প্রায় ১১ ঘণ্টা ঘুমানো হয়। তবে মাত্র চার সেকেন্ড করে ঘুমালেও ওদের কোনো ক্ষতি হয় না। মানুষের জন্য বিষয়টা ক্ষতিকর হলেও এসব প্রাণী চার সেকেন্ডে দিব্যি একবার ঘুমিয়ে নেয়।
কোরিয়ার ইনচিয়নের দ্য কোরিয়া পোলার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ওন ইয়ং লি ১৪টি চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের ওপর নজর রাখেন। প্রাণীগুলো কখন কী করে, কতক্ষণ ঘুমায়, কতবার ঘুমায়—সবকিছু লিখে রাখেন। ওসব পেঙ্গুইনের পিঠে স্লিপ ট্র্যাকার লাগিয়ে রেখছিলেন লি। পাশাপাশি অস্ত্রোপচার করে পাখিগুলোর মস্তিষ্কেও ট্র্যাকার বসিয়েছিলেন। অর্থাৎ ১ সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেও যেন তিনি জানতে পারেন।
সব পেঙ্গুইন কিন্তু এ রকম অল্প সময় এবং এত বেশিবার ঘুমায় না। শুধু চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের মধ্যেই এমন ঘুম লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তিনি দেখলেন, ১ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৬০০ বার ঘুমিয়ে পরে এই পেঙ্গুইনগুলো। প্রতিবার গড়ে ৪ সেকেন্ডের ঘুম। তবে মজার ব্যাপার হলো, মাঝেমধ্যে এদের মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ ঘুমায় এবং অর্ধেক অংশ জেগে থাকে। ওদের বাচ্চাদের চুরি করতে চাইলে বা আক্রমণ করলে মস্তিষ্কের বাকি অংশ সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীদের মতে, এসব পেঙ্গুইন বেশির ভাগ সময় আতঙ্কে থাকে যে বাচ্চাগুলোর ওপর অন্য প্রাণী আক্রমণ করবে। তাই এমন অল্প সময় ঘুমায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ, পেঙ্গুইনরা যেখানে থাকে, সেই স্থান সব সময় কোলাহলপূর্ণ থাকে। চারদিকে শুধু কিচিরমিচির শব্দ। এতে ওরা বেশি সময় ঘুমাতে পারে না। তাই এমন মাইক্রোস্লিপের ব্যবস্থা।
তবে সব পেঙ্গুইন কিন্তু এ রকম অল্প সময় এবং এত বেশিবার ঘুমায় না। শুধু চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের মধ্যেই এমন ঘুম লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে ঘুম নিয়ে অন্যান্য প্রাণীর আরও মজার তথ্য আছে। যেমন কিলার হোয়েল বা ডলফিনের বাচ্চা হওয়ার পর প্রায় এক মাস ওরা না ঘুমিয়ে থাকে। এতে শরীরে কোনো প্রভাব পড়ে না। আবার এলিফ্যান্ট সি দিনে মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুমায়। ডলফিনও ঘুমের সময় মস্তিষ্কের অর্ধেক ঘুম পাড়িয়ে বাকি অর্ধেক জাগিয়ে রাখতে পারে। তখন ডলফিনের এক চোখ খোলা থাকে এবং এক চোখ থাকে বন্ধ। এ অবস্থায় প্রায় ১৫ দিন ঘুমাতে পারে ডলফিন। আবার কিছু পাখি উড়তে উড়তে খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পারে।
ফলে পৃথিবীতে বিচিত্র ধরনের প্রাণী আছে। নিজেদের প্রয়োজনে এসব প্রাণী অভ্যাস পরিবর্তন করে নেয়। যেভাবে বেঁচে থাকতে সুবিধা হয়, সেভাবেই বাঁচে। চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের এই গুণটাও তেমনই।
সূত্র: স্মিথসোনিয়ানম্যাগ ও সায়েন্স নিউজ এক্সপ্লোরস ডট কম