ব্রিকস। শব্দটা বেশ খটোমটো শোনাতে পারে। তবে গত মাসে এ শব্দ বেশ আলোচনায় ছিল। শব্দটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও বিদেশি গণমাধ্যমগুলো অনেক খবর প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে একটি খবর বেশ গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশে। সেটা হলো, বাংলাদেশ কি ব্রিকসের সদস্য হতে পারবে? বাংলাদেশ শিগগিরই এর সদস্য হতে পারছে না, এটা ইতিমধ্যেই জানা গেছে। এখন প্রশ্ন, ব্রিকসের ভবিষ্যৎ কী?
ব্রিকস জোটের নাম, কিন্তু তা রাজনৈতিক দলের কোনো জোট নয়। কয়েকটি দেশ মিলে জোট করা হয়েছে, যার নাম ‘ব্রিকস’। আগস্ট মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে হলো জোটের সম্মেলন। এ সম্মেলনকে ঘিরে ব্রিকস নিয়ে আলোচনা জোরালো হয়।
ইংরেজি অক্ষর বি, আর, আই, সি এবং এস। এই অক্ষরগুলো পাশাপাশি বসিয়ে ‘ব্রিকস’ শব্দটির উৎপত্তি। এই অক্ষরগুলো নেওয়া হয়েছে জোটের দেশগুলোর নাম থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে, দেশের নামের প্রথম অক্ষর। ব্রাজিলের বি, রাশিয়ার আর, ইন্ডিয়ার আই, চীনের সি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এস। এখন পর্যন্ত এ জোটের, মানে ব্রিকসের সদস্যদেশ পাঁচটি।
জোটের চিন্তা আসে ২০০১ সালে। তখন এর নাম ছিল ব্রিক। সদস্য ছিল চারটি দেশ—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন। এই দেশগুলোর প্রথম বৈঠক হয়েছিল ২০০৯ সালে। এরপর ২০১০ সালে তাদের যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার এস অক্ষর ব্রিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন নাম হয় ব্রিকস।
এ তো গেল নামকরণের গল্প। শুধু নামে তো আর জোট হয় না। জোট হয় কোনো একটা উদ্দেশ্য থেকে। এ জোট গঠনেরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটা জানার আগে কার মাথা থেকে এ জোটের বুদ্ধি এসেছিল, সেটা জানা যেতে পারে।
যুক্তরাজ্যের একজন অর্থনীতিবিদের নাম জিম ও’নেইল। একসময় দেশটির অর্থমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাকস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান তিনি। তাঁর মাথা থেকেই এ জোট গঠনের বুদ্ধি এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, বিকাশমান অর্থনীতির এই দেশগুলো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে ২০৫০ সাল নাগাদ। এই নেতৃত্ব বলতে অর্থনৈতিক খাতের নেতৃত্বকে বুঝিয়েছিলেন তিনি।
কেন এই দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ
গুরুত্বের হিসাব করলে প্রথমেই আসে জনসংখ্যার হিসাব। বলা হচ্ছে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশই এই পাঁচ দেশে। জোটের সদস্য ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। চীনের সংখ্যাও প্রায় একই। এ ছাড়া ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটি, রাশিয়ার ১৪ কোটি, দক্ষিণ আফ্রিকার ৬ কোটি। জনসংখ্যার বিবেচনায় এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জোট।
অর্থনীতির হিসাবেও তা–ই। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ বাদ দিলে নানা পণ্য উৎপাদনে তারা এগিয়ে। অর্থনীতির আকারও বড়। এটা অবশ্য জনসংখ্যার কারণেই। যে দেশের জনসংখ্যা যত বেশি, সেখানে উৎপাদনের সুযোগ বেশি। আবার বিদেশ থেকে পণ্য আনা কিংবা দেশের বাইরে পণ্য বিক্রি করাতেও এই দেশগুলো বেশ ভালো অবস্থানে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় এ দেশগুলো আলাদা গুরুত্ব বহন করে। সব মিলিয়ে দেশগুলোকে বিকাশমান অর্থনীতির দেশ বলা হচ্ছে।
পেছনের রাজনীতি
রাজনীতি বিবেচনায় নিলে একটি স্পষ্ট বিভাজন চোখে পড়বে। আমরা পশ্চিমা বিশ্বের কথা বলি। এই পশ্চিমা বিশ্ব বলতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ডকে বোঝানো হয়। এই দেশগুলোর আরেক বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সব কটি দেশই মোটামুটি ধনী।
অপর দিকে গত কয়েক দশকের রাজনীতির দিকে তাকানো যাক। এতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিকসের দেশগুলোর সম্পর্ক আসলে ভালো নয়। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ খারাপ। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তো রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়াযুদ্ধ চলছে। এদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্ক যে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, সেটা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের আহ্বানের পরও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্রাজিলের বিষয়টি আবার একটু ভিন্ন। দেশটিতে জইর বলসোনারো যখন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ উষ্ণ ছিল। আবার লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়েছে ব্রাজিলের।
এখানে শুধু ব্যতিক্রম ভারত। কারণ, ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ভালো। আবার ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও ভালো। এটাও ইউক্রেন যুদ্ধে বোঝা যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব যখন রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তখন দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও ভালো হয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে বিভিন্ন প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ভারত। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও নতুন নতুন চুক্তি করছে ভারত।
ভারতের এমন অবস্থানের কারণে জোটের পরিস্থিতিটা বেশ জটিল। ব্রিকস জোটের গুরুত্বপূর্ণ আরেক সদস্য চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ খারাপ। দেশটির সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এর জেরে ২০২০ সালে একরকম সীমান্তযুদ্ধই হয়েছে বলা চলে। প্রাণঘাতী ওই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য ও ৪ চীনা সৈন্য নিহত হন।
তবে মোটাদাগে ভারতকে বাদ দিলে ব্রিকসের দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। বিশ্লেষকেরাও ব্রিকসকে পশ্চিমাবিরোধী জোট হিসেবেই দেখছেন।
বৃক্ষ ফলে পরিচয় দিচ্ছে
ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো বলছে, এর পেছনে পশ্চিমাবিরোধী কোনো রাজনীতি নেই। এর লক্ষ্য কথিত তৃতীয় বিশ্ব, ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর উন্নয়ন।
কিন্তু কাজে আসলে তার মিল পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন ব্যাংকের কথা বলা যেতে পারে। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) নামের নতুন একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক খুলেছে ব্রিকস। জোটের সদস্যদের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও অবকাঠামো খাত ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। মূলত পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এত দিন ঋণ দিয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। এখন ব্রিকস সেই পথে হাঁটছে। তারা চাইছে, পশ্চিমাদের ঋণনির্ভরতা কমে যাক।
এ ঋণের বাইরে আলাদা মুদ্রা প্রচলনের ভাবনাও চলছে। গত মাসের শেষে জোহানেসবার্গে ব্রিকসের সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য নিজস্ব মুদ্রা চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ডলারের বিনিময় হার সব সময়ই ওঠানামা করে, তাই ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো একটি নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করতে পারে।
এটা যে একটি রাজনৈতিক চিন্তা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, ব্রিকস যদি নতুন মুদ্রা নিয়ে আসে, তবে মার্কিন ডলার কিংবা ইউরো স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব হারাবে। যদিও লুলার এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে জোহানেসবার্গের সম্মেলন থেকে নতুন সদস্য নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এ জোটে যোগ দেবে আরও ছয়টি দেশ—আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এখানেও রয়েছে রাজনীতি। রাশিয়া ছাড়া পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় যে দেশটি বিপর্যস্ত, সেই ইরানকে এ জোটের সদস্য করা হচ্ছে।
আবার মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই সম্প্রতি চীনের প্রভাব বেড়েছে। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক উন্নয়নে চীন কূটনীতি জোরদার করছে। মিসর ও ইথিওপিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো চীনের। এই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোকে ব্রিকসে টেনে নেওয়া হচ্ছে।
ব্রিকসের ভবিষ্যৎ কী
তবে এ জোট সফল হবে কি না, সেটা বেশ খানিকটা নির্ভর করবে ভারতের ওপর। এ জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আমাদের এই প্রতিবেশী দেশ। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৈরী হওয়ার কারণে বেশ সতর্ক অবস্থানে তারা। ভারত মনে করে, চীন তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত সম্প্রতি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলো মূলত চীনকে লক্ষ্য করেই নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য খর্ব করা।
দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ভালো হলে জোট যে এগিয়ে যায়, তার বড় প্রমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। খুব বড় কোনো দ্বন্দ্ব নেই এ জোটে। ফলে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এগিয়েছে। ভারত–চীন সম্পর্ক যদি এমন থাকে এবং জোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি তা প্রভাব ফেলে, তবে ব্রিকস কত বড় হবে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। তাই ব্রিকসের সফলতা দেখতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।