কেন খাব শাকসবজি
চিকেন-টিক্কা-মাসালা কোন দেশি খাবার?আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম, তখন কিন্তু সবজি খেতে আমার একদমই ভালো লাগত না। খেতাম ঠিকই, তবে বাধ্য হয়ে খাওয়া যাকে বলে আর কি! শাকও খেতাম অল্পস্বল্প। পৃথিবীতে এত এত সুস্বাদু খাবার থাকতে শাকসবজিই কেন খেতে হবে রোজ? মজার ব্যাপার হলো, এখন আমার পাতে ভাতের চেয়ে সবজিই থাকে বেশি! সবজির সঙ্গে প্রায়ই থাকে কোনো না কোনো শাক। কেন আমি এমনভাবে বদলে গেলাম, সেই গল্প নিশ্চয়ই বলব।
শাকসবজিতে এমন কিছু পুষ্টি উপাদানের প্রাচুর্য থাকে, যা অন্য কোনো খাবার থেকে অতটা সহজে পাওয়া যায় না। তোমরা নিশ্চয়ই ফলিক অ্যাসিড নামের একটা পুষ্টি উপাদানের কথা শুনেছ। এর অভাবে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এই উপাদানের প্রধান উৎসই হলো শাকপাতা। এ ছাড়া অন্যান্য মিনারেল (খনিজ উপাদান) আর অনেক রকম ভিটামিন থাকে শাকসবজিতে। সুস্থতার জন্য এসব উপাদান অপরিহার্য। তা ছাড়া শাক এবং খোসাসহ খাওয়া হয়, এমন সবজিতে থাকে প্রচুর আঁশ। এই আঁশও ভীষণ দরকারি। শাকসবজি খাওয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারগুলো সম্পর্কে বলছিলেন ঢাকার আজিমপুরে অবস্থিত গভ. কলেজ অব হিউম্যান সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক শম্পা শারমিন খান।
এসব উপাদান কিন্তু সব বয়সেই দরকার। কৈশোরে কেন এগুলোর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি, সেটাও তো জানতে হবে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, বেড়ে ওঠার এ সময়ে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। অনেকেরই ত্বকের কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কারও কারও চুল পড়ে খুব। ত্বক ও চুলের নানান সমস্যা মোকাবিলায় শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস কিন্তু বেশ কাজে দেয়। তা ছাড়া কৈশোরের এই সু–অভ্যাস ভবিষ্যতেও ধরে রাখা সহজ হয়, যখন কিছু শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। সেসব রোগ প্রতিরোধেও কাজে দেয় শাকসবজির পুষ্টি উপাদান।
ভিটামিন ও মিনারেল
কোনো কোনো সময় দেখবে, কারও ঠোঁটের কোণে বা জিবে ঘা হচ্ছে কিংবা দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়ছে। কেউ ভুগছে রক্তশূন্যতায়। অনেকের ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো পুষ্টি উপাদানের অভাবে এমনটা হয়। এমন সমস্যা এড়াতে, অর্থাৎ এই পুষ্টি উপাদানগুলো ঠিকঠাকভাবে পেতে রোজ খেতে হবে শাকসবজি। একটি শাক বা সবজিতে বেশ কয়েকটি উপাদানই থাকে। এর সব তো আর মুখস্থ রেখে খাবারের মেনু ঠিক করা সম্ভব নয়, তা–ই না? তার আসলে দরকারও নেই। কেবল এটুকু নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রোজ কয়েকটি শাকসবজি খাওয়া হয়। মৌসুমি শাকসবজি খেতে হবে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে। উদাহরণ হিসেবে শীত মৌসুমের কথা ধরা যাক। এ সময় এক দিন হয়তো ফুলকপি আর শিম খাচ্ছ, তো পরদিন বাঁধাকপি আর মটরশুঁটি। কোনো দিন খেতে হবে পালংশাক, যা অ্যানিমেশন কার্টুন চরিত্র পাপাই দ্য সেইলরম্যানকেও খেতে দেখা যায়। পালংশাক কিন্তু সত্যিকার অর্থেই শক্তি জোগায়। পুঁইশাক আর লালশাকে পাবে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। কচু ও কচুশাকে থাকে আয়রন, যা লেবু দিয়ে খাওয়া হলে শরীরে ভালোভাবে কাজে লাগে। অঙ্কুরিত ছোলা, পালংশাক, ঢেঁকিশাক আর লেটুসপাতায় আছে ভিটামিন বি। লেটুসপাতা ও ধনেপাতায় আছে ভিটামিন কে। হলুদ, লাল আর কমলা রঙের শাকসবজি থেকে পাবে ভিটামিন এ।
পেটের জন্য উপকার
অনেকেই কোষ্টকাঠিন্যে ভোগে। শাকসবজিতে থাকা আঁশ এই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, বেগুন, শিম, গাজর প্রভৃতিতে প্রচুর আঁশ থাকে। পটোলের খোসা বেশি পুরু করে কাটা না হলে পটোল থেকেও আঁশ পাওয়া যায়। আর পেঁপেতে রয়েছে প্যাপেইন নামের এনজাইম, যা হজমসহায়ক।
ভুল খাবারে নির্ভরশীলতা কমবে
সকালে হয়তো হালকা নাশতা দিয়ে দিন শুরু হয় তোমার। বেলা গড়িয়ে দুপুর হওয়ার আগেই ক্ষুধা পেয়ে যায়। তখন হয়তো বাইরের কেক, নুডলস, শিঙাড়া, সমুচা, স্যান্ডউইচ, বার্গারই ভরসা। রোজ এসব খাবার খাওয়া কিন্তু স্বাস্থ্যকর নয়। অথচ তুমি যদি সকালে বেশ খানিকটা সবজি (শুধু আলু নয়) দিয়ে রুটি খেতে, তাহলে তোমার এত কম সময়ে ক্ষুধা পেত না। দুপুরের আগে হালকা ক্ষুধা পেলেও কেবল একটা ফল খেয়েই ক্ষুধা মিটিয়ে নিতে পারো।
পানির চাহিদা পূরণ
দেহের কোষগুলোর স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে এবং প্রস্রাবে সংক্রমণ এড়াতেও রোজ পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন। বাইরে গেলে সঠিকভাবে পানি খাওয়া হয় না অনেকেরই। যেসব সবজির ভেতরটা সাদা (যেমন লাউ, চালকুমড়া), সেগুলো খেলে পানির চাহিদাও মেটে অনেকটা। তা ছাড়া বাইরের জুস, শরবতের চেয়ে স্বাস্থ্যকরও বটে।
সহজ রান্না, বাহারি খাবার
কেবল নিরামিষ তরকারিই নয়, আমিষের সঙ্গে মিলিয়েও সবজির পদ হতে পারে। সবজির কাটলেট বা সবজি দেওয়া স্যান্ডউইচ খেতে পারো। আলুর দম কিংবা এ রকম একটু ভিন্ন ধারার খাবার খেতে পারো মাঝেমধ্যে। তাহলে সবজি খেতে আগ্রহ পাবে। শিম বা বরবটির মতো কিছু সবজি ভর্তা করেও খেতে পারো। লাউ বা কুমড়ার খোসা দিয়েও মজার পদ করা যায়। কাঁচা খাওয়া যায়, এমন সবজির সালাদও খেতে হবে রোজ। কারণ, ভিটামিন বি রান্নার সময় বাষ্পের সঙ্গে মিশে উড়ে যায় আর ভিটামিন সি চুলার তাপে নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রান্না করা হলে অবশ্য খানিকটা ভিটামিন বি বাঁচানো যায়। নানান রকম মসলা আর বাহারি ড্রেসিং দিয়ে কাঁচা সবজির সালাদ কিন্তু বেশ সুস্বাদু। মজাদার সবজির আইডিয়া পেতে পারো ইউটিউবের মতো ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম থেকে। বাড়িতে বড়দের সহযোগিতা নিয়ে নিজেরাও তৈরি করতে পারো সহজ কোনো পদ। কিংবা বাড়িতে যিনি রান্না করেন, তাঁকে বলতে পারো কীভাবে কোন সবজিটা খেতে চাও।
স্বপ্ন বেঁচে থাকুক
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ কিংবা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। এসব রোগের যেকোনো একটি থাকলেই নানান শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। যেমন ধরো, ডায়াবেটিস থাকলে একপর্যায়ে কারও কারও কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়, কারও দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্ট্রোকের কারণে চলাফেরার শক্তি হারিয়ে মাসের পর মাস বিছানায় পড়ে থাকাটাও ভীষণ কষ্টদায়ক। ভেবে দেখো, এই পৃথিবীতে সুস্থভাবে চলাফেরা করে ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারাটা আসলে কী বিশাল ব্যাপার! সুস্থ থাকতে হলে কিছু নিয়ম তো মানতেই হবে। খেয়ালখুশির খাওয়াদাওয়া হতেই পারে মাসে দু–একবার। কিন্তু স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে রোজই।
আমার বয়সটা হয়তো তোমাদের বয়সের দ্বিগুণ। তবে আমি কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। এমনকি তোমাদের বয়সে দেখা কোনো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আজও আমি আকুল হয়ে থাকি। আমাদের ও তোমাদের এমন সব স্বপ্নকে সত্যি করতে হলে সুস্থ তো থাকতেই হবে। আজ থেকে ভালো থাকার জন্য বেশি বেশি শাকসবজি খাবে তো?