খুদে মননের বড় চাল

মনন রেজা

দাবার বোর্ডে যখন মগ্ন থাকে মনন রেজা, বাইরে অস্থির পায়চারি করেন মা মৌমন রেজা। আইনের ছাত্রী ছিলেন মৌমন রেজা। কিন্তু আইন পেশায় যাননি। স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। কিন্তু ছেলেকে গ্র্যান্ডমাস্টার বানাবেন বলে সবকিছু ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে ছুটে বেড়ান শহর থেকে শহরে। কখনো ঢাকা, কখনো চট্টগ্রাম। দাবার টুর্নামেন্ট যেখানে, সেখানেই ছেলেকে খেলানোর সুযোগ করে দেন মৌমন রেজা।

মননের বয়স ১৩ বছর। পড়াশোনা করছে নারায়ণগঞ্জের ফিলোসোফিয়া ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণিতে। ছয় বছর বয়সে বাবা নাজিম রেজার হাতে দাবার হাতেখড়ি মননের। বাবা অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপে দাবা খেলতেন। তখন পাশে বসে খেলা দেখত মনন। একদিন ক্রিকেট ব্যাট কিনবে বলে বায়না ধরলে স্পোর্টস মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাসায় ফেরা হয় দাবার বোর্ড নিয়ে। গল্পটা শোনালেন মা মৌমন রেজা, ‘ওর সব খেলার প্রতিই আগ্রহ। আগে ক্রিকেট ও ফুটবল বেশি পছন্দ করত। একদিন ক্রিকেট ব্যাট কিনতে গিয়ে মার্কেটে দাবা বোর্ড দেখে সেটা কিনে বাসায় ফেরে। এর পর থেকে দাবাটাই বেশি খেলে।’

ক্যান্ডিডেট মাস্টার মননের বর্তমান ফিদে রেটিং ২২৫১। আর মাত্র ১৫ রেটিং যোগ করলেই পাবে ফিদে মাস্টার খেতাব। গত ডিসেম্বরে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে বড় অঘটন ঘটিয়েছে মনন। হারিয়েছে দুজন গ্র্যান্ডমাস্টারকে। এদের একজন এনামুল হোসেন রাজীব, আরেকজন রিফাত বিন সাত্তার। দাবাড়ুদের শীর্ষ প্রতিযোগিতায় সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু মনন গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দেয় ঘরোয়া দাবায়। শুধু তা–ই নয়, এবারের জাতীয় দাবায় মনন হারিয়েছে জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন সুব্রত বিশ্বাসকে। ড্র করেছে আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমানের সঙ্গে।

গত বছর অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান যুব দাবায় অনূর্ধ্ব-১২ ক্যাটাগরির স্ট্যান্ডার্ড বিভাগে মনন জিতেছিল রুপা। এ ছাড়া কমনওয়েলথ জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ওয়েস্টার্ন এশিয়া ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জ আছে মননের।

মনন জাতীয় দাবায় প্রথমবার খেলেছিল ২০১৯ সালে। সাধারণত বাছাইপর্ব পেরিয়ে তবেই চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিতে হয় দাবাড়ুদের। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে সেবার মনন খেলে জাতীয় দাবায়। তখন মননের বয়স মাত্র ৯ বছর! জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে ষষ্ঠ হয়ে এ সুযোগ পায় মনন। সেখানে মনন হারিয়ে দিয়েছিল দুবারের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ফিদে মাস্টার রেজাউল হক ও সাবেক জাতীয় দলের ফিদে মাস্টার সাইফউদ্দিন লাভলুকে। যেন সম্ভাবনার খনি মনন। এর আগে এত কম বয়সে জাতীয় দাবার চূড়ান্ত পর্বে সুযোগ পায়নি আর কেউ। এর আগে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ সবচেয়ে কম বয়সে জাতীয় দাবায় খেলেছিলেন। তখন নিয়াজের বয়স ছিল ১০। সেই হিসাবে নিয়াজকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে মনন।

অন্য সব কিশোরের মতোই প্রতিদিনের জীবনযাপন মননের। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে টেবিলে কলম খেলা, জুতোর ফিতে ধরে টানাটানি। ফুটবল দেখলে দৌড়ে গিয়ে লাথি মারা, ক্রিকেট ব্যাট হাতে গেলে আগে ব্যাটিং করার বায়না। কিন্তু এই ছেলেটিই দাবার বোর্ডে বসলে হয়ে ওঠে বিশাল জ্ঞানী। যেন কিস্তি মাত করাই তখন একমাত্র কাজ তার।

ভবিষ্যতে কী হতে চাও, গ্র্যান্ডমাস্টার না সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার? মনন হতে চায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কার্লসেনের মতো, ‘আমি কার্লসেনের (ম্যাগনাস ওয়েন কার্লসেন) মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। ইউটিউবে তাঁর খেলা দেখি। বাংলাদেশের রাজীব স্যারের মতোও হতে চাই।’

এলিগ্যান্টস চেস একাডেমিতে অনুশীলন করে মনন। সেখানে তার কোচ ছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন। অথচ তাকেই হারিয়ে দিচ্ছে দাবার বোর্ডে! ছাত্রকে বড় সার্টিফিকেট দিয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার রাজীব, ‘ওর ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। এই বয়সের দাবাড়ুদের মধ্যে আমরা যেই আক্রমণাত্মক বিষয়টা দেখতে চাই, তা ওর মধ্যে আছে। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে ওকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখা যায়।’

গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের (ডানে) সঙ্গে দাবার লড়াইয়ে মনন রেজা (বাঁয়ে)

ভারতের অভিমন্যু মিশ্র যেদিন সবচেয়ে কম বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার রেকর্ড গড়ল, সেদিন অভিমানে আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমানের চোখে জল এসেছিল কি না, জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশের এই দাবাড়ুর এখনো গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব না পাওয়া নিয়ে তাঁর বাবা নজরুল ইসলামের আক্ষেপের কমতি নেই।

বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ। ১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন নিয়াজ। তখন গোটা এশিয়ায়ই গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন মাত্র চারজন। এরপর গত ৩৪ বছরে মাত্র চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন জিয়াউর রহমান। ২০০৬ সালে রিফাত বিন সাত্তার, ২০০৭ সালে আবদুল্লাহ আল রাকিব। সর্বশেষ গ্র্যান্ডমাস্টার ২০০৮ সালে পেয়েছে বাংলাদেশ, সেবার এই খেতাব পান এনামুল হোসেন রাজীব। অথচ পাশের দেশ ভারতে বর্তমানে গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা ৭৮!

২০২২ সালের ১ জুলাই বুদাপেস্টে একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে যখন গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পূরণ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের কিশোর অভিমন্যু, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর ৪ মাস ২৫ দিন! সেই বয়সটা মনন পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তার সামনে এখনো ফিদে মাস্টার খেতাবও পূরণ হয়নি। বেশি বেশি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে না খেললে রেটিং বাড়ানো বা খেতাব পাওয়া অসম্ভব।

মৌমন রেজার আক্ষেপ, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই সুযোগ পাচ্ছে না মনন, ‘ছোটবেলা থেকেই দাবার প্রতি ওর প্রচণ্ড টান। দাবার বোর্ডে মগ্ন থাকলে অনেক সময় পড়াশোনাও ভুলে যায় সে। ওর বর্তমান যে রেটিং তাতে দ্রুতই হয়তো ফিদে মাস্টার হতে পারবে। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন আরও বেশি টুর্নামেন্টে খেলা। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সুযোগ করে দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই। এ জন্য যদি কেউ তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করত, তাহলে আমার ছেলে অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো ফিদে মাস্টার হতে পারত।’

গত বছর অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ায় খেলতে গিয়েছিল মনন। কিন্তু বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন কোনো সহযোগিতা করেনি। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে খেলে জমানো টাকা ভেঙে তবেই খেলতে যায়।

ছেলেকে নিয়ে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন মৌমন রেজা। দুপুরে খেলা শুরু হয় মননের। কিন্তু সকাল থেকেই চলে মায়ের প্রস্তুতি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া মননের ছোট ভাই মাদল রেজাকে একা রেখে আসেন মা। বাসায় ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায় দুজনের। মৌমন রেজার প্রতিদিন যানজট ঠেলে এভাবে ঢাকায় আসা শুধুই মননের জন্য, ‘অনেক বাবা–মা চায় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হবে। কিন্তু আমি চাই আমার ছেলে হবে গ্র্যান্ডমাস্টার।’ প্রতিদিনের লড়াই আর সংগ্রাম শেষে মনন পাবে গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব, সেই স্বপ্নটা পুষে রেখেই মায়ের এই পথচলা।

সাদা–কালো বোর্ডের রঙিন স্বপ্নটা ছুঁতে মননকে যে যেতে হবে বহুদূরে।