৭০ বছর আগের এক রাতে মারা যান জেমস ম্যাকার্টি নামের এক ভদ্রলোক। তবে তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা জানতে পারি ২৬ বছর আগের এক সকালে এবং এরপর ২৬ বছর ধরে বিষয়টা মানুষকে ভাবিয়ে তোলে—যিনি মারা গেছেন তিনি নন, যেভাবে মৃত্যু তার কাছে এসেছিল—সেটা।
বস্তুত জেমস ম্যাকার্টি স্রেফ একটা ছদ্মনাম। ভদ্রলোকের আসল নাম আমাদের জানা নেই। কেবল জানা আছে, তিনি বিশাল ধনী ছিলেন। জানা আছে, তিনি বিলাসী ছিলেন। প্রচুর ধূমপান করতেন, মদ্যপান তো অবশ্যই, রেড মিট খেতেন অপরিমিত। এই বেহিসাবি জীবনযাপনের দাম এক সন্ধ্যায় তাঁকে হাতেনাতে দিতে হয়—বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে তিনি হাসপাতালে আসেন, দ্রুত ইসিজি করে দেখা যায়, ভদ্রলোকের হৃৎপিণ্ডের একটা অংশ নষ্ট হয়ে গেছে—হার্ট অ্যাটাকের প্রথম লক্ষণ। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করা হয়।
সেই রাতে কেবিনের দায়িত্বে ছিলেন মেডিকেলের এক তরুণ শিক্ষার্থী। নাম শেরউইন নুল্যান্ড। ২২ বছর বয়সী এই তরুণ তখন সবে তৃতীয় বর্ষে উঠেছেন। প্রথমবারের মতো সরাসরি রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। ফলে তাঁর আগ্রহের শেষ নেই। জেমস ম্যাকার্টিকে কেবিনে আনার পর তিনি তুমুল উৎসাহে কেবিনের দরজা বন্ধ করে দেন—যেন কোনো সিনিয়র ডাক্তার এসে ‘তাঁর রোগী’-কে নিয়ে নিতে না পারে!
দুর্ভাগ্য, রোগীকে দেখার সুযোগ নুল্যান্ড নিজেও পাননি। তিনি দরজা বন্ধ করে আসামাত্র ম্যাকার্টি হঠাৎ ছটফট করে ওঠেন, হাত মুঠো করে দুম দুম শব্দে নিজের বুকে মারতে থাকেন, তাঁর মুখ দ্রুত বেগুনি রং ধারণ করে, চোখ ফেটে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয় এবং একটা গভীর নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে তিনি মারা যান।
হতভম্ব হয়ে পড়েন নুল্যান্ড। রোগীর গলায় হাত দিয়ে দেখেন, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, অর্থাৎ তাঁর হৃৎপিণ্ড আর কাজ করছে না। সেই রাতে সবাই ব্যস্ত হাসপাতালের অন্য প্রান্তে, এক মুমূর্ষু পোলিও রোগী নিয়ে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবেন না। দৌড়ে কাউকে ডেকে আনতে যে কটা মূল্যবান মুহূর্ত নষ্ট হবে, তারপর আর রোগীকে বাঁচানোও যাবে না। এর চেয়ে নিজে চেষ্টা করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বর্তমানে কেউ জেমস ম্যাকার্টির অবস্থায় পড়লে রোগীকে বাঁচানোর শেষ যে চেষ্টা চিকিৎসকেরা করেন, তার নাম সিপিআর। এ প্রক্রিয়ায় বুকের ওপর ছন্দে ছন্দে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়, রোগীর ভাগ্য যদি ভালো হয়, তার হৃৎপিণ্ড আবার চালু হয়ে যায়।
সমস্যা হলো, ৭০ বছর আগে সিপিআর উদ্ভাবিত হয়নি। তখন হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলে একটা কাজই করার ছিল—তৎক্ষণাৎ অপারেশন করে আক্ষরিক অর্থেই রোগীর হৃৎপিণ্ডটা বের করে আনা, এরপর হাত দিয়ে সেটাকে পাম্প করে রক্ত চলাচল চালু রাখা। যতক্ষণ না বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র এনে হৃৎপিণ্ড আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে, ততক্ষণ হাত দিয়ে পাম্পের কাজটা করে যেতে হতো। হাসপাতালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঘরে সব সময় অপারেশনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হতো, জেমস ম্যাকার্টির কেবিনেও ছিল।
নুল্যান্ড অতীতে এ অপারেশন করা তো দূরের কথা, দেখার সুযোগ পর্যন্ত পাননি। তবু কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেই মুহূর্তে তিনি শান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর এমন একটা অনুভূতি হয় যে কী করতে হবে, সেটা তাঁর জানা আছে। অপারেশনের কিট খুলে তিনি স্কালপেল বের করেন। এরপর বই পড়া জ্ঞান ব্যবহার করে, ম্যাকার্টির বুকের বাঁ দিকে যেখানে হৃৎপিণ্ড থাকার কথা, সে বরাবর কেটে ফেলেন। বুকের গহ্বর পর্যন্ত কেটে নুল্যান্ড লক্ষ করেন, এত গভীরভাবে কাটার পরও কোনো রক্তপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে না, রক্ত কেবল জমাট বেঁধে গাঢ় হয়ে আছে; হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর সুনিশ্চিত প্রমাণ।
হাত জীবাণুমুক্ত করার সময় যেহেতু নেই, নুল্যান্ড সেই অবস্থাতেই ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেন, এরপর ম্যাকার্টির হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে পাম্প করতে শুরু করেন। অনভ্যস্ত হাতে পাম্প করতে করতেও তিনি টের পান, হৃৎপিণ্ডটা ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে; যার অর্থ, সেখানে আর রক্ত আসছে না। তবু নাছোড়বান্দার মতো তিনি চেষ্টা করতে থাকেন এবং তখন অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটে যায়—কয়েক মিনিট আগে মারা যাওয়া ম্যাকার্টি মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে পেছনের দিকে হেলে পড়েন, শূন্য চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে একটা নারকীয় চিৎকার করে চুপ হয়ে যান।
পরমুহূর্তে কেবিনের দরজা খুলে একজন ইন্টার্ন ডাক্তার প্রবেশ করেন। নুল্যান্ডের শান্ত ভঙ্গি ততক্ষণে উবে গেছে, তিনি থরথর করে কাঁপছেন, ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে আছেন এবং দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচাচ্ছেন। ইন্টার্ন ডাক্তার মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেন। শান্ত ভঙ্গিতে নুল্যান্ডকে বলেন, ‘ঠিক আছে, তুমি অন্তত চেষ্টা করেছ মানুষটাকে বাঁচানোর।’ সেই ডাক্তার আর কী কী বলেছিলেন, নুল্যান্ড স্পষ্ট মনে করতে পারেন না। কেবল তাঁর মনে পড়ে, সেই সময় ম্যাকার্টির চোখের পাতা খোলা ছিল এবং সেই খোলা চোখে যেই মণি দেখা যাচ্ছিল সেটা অনেক প্রসারিত ছিল—মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর যেমনটা ঘটে থাকে।
একটা মৃত মানুষ কি চিৎকার করতে পারে?
সেই রাতে যা ঘটেছিল, তার ব্যাখ্যা নুল্যান্ড অনেক পরে উপলব্ধি করেছেন। সদ্য মৃত ম্যাকার্টির রক্তে অম্লতা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল, ফলে তাঁর গলার পেশিতে একধরনের খিঁচুনি শুরু হয়। খুব সম্ভবত এই খিঁচুনির প্রভাবেই স্বরযন্ত্র দিয়ে আপনাআপনি শব্দ বেরিয়ে আসে।
নুল্যান্ড কেবল ডাক্তার নন, দৃশ্যমান ঘটনার ব্যাখ্যা তিনি দর্শনগত দিক থেকেও দেওয়ার চেষ্টা করেন। তরুণ বয়সের এ ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, মৃত ম্যাকার্টির চিৎকারটা বস্তুত নুল্যান্ডের উদ্দেশে একটা বার্তা ছিল—অনেক হয়েছে, এবার ক্ষান্তি দাও, আমি শান্তিতে মরি।