কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
‘কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস, আমি বলি আমার সর্বনাশ।
কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস, আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস’—প্রখ্যাত গীতিকবি জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাঁর গানে এভাবেই এঁকেছেন বাংলা বর্ষপঞ্জির শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুনকে।
ফাল্গুন আর চৈত্র—এই দুই মাস নিয়ে বসন্তকাল।
ফাল্গুন যেমন প্রেমের মাস, তেমনি বিরহের মাসও। পলাশ ফুল আর মাতাল বাতাস যদি হয় প্রেম বা রোমান্টিকতার ইঙ্গিতবাহী, তেমনি ‘সর্বনাশ’ আর ‘দীর্ঘশ্বাস’ শব্দ দুটি বিরহের বার্তাই বহন করে।
মূলত প্রতিটি বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্র থেকে। বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে প্রথম মাসের নামকরণ করা হয়েছে বৈশাখ। তেমনি উত্তর ফাল্গুনী ও পূর্ব ফাল্গুনী দুটি নক্ষত্রের নাম থেকে নেওয়া হয়েছে ফাল্গুন মাসের নাম। চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে এসেছে চৈত্র মাসের নাম।
পৌষ, মাঘ মাস নিয়ে শীত ঋতু। আর শীতের পরই আসে বসন্ত। শীতে গাছের পাতারা ঘুমিয়ে থাকে, একটা সময় ঝরতে থাকে পাতা। কোনো কোনো গাছ একেবারেই পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। আর ফাল্গুন যেন গাছ ও পাতাদের জেগে ওঠার সময়। গাছে গাছে কুঁড়ি আসে, ফুল ফোটে। প্রকৃতির সংসারে ফাল্গুন-কন্যা যেন হাজির হয় রঙিন শাড়ি পরে!
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছেন ফাল্গুনে মাতাল বাতাস প্রবাহিত হয়। ঠিক যেন তা-ই। এ সময়ে বায়ু নানা দিক থেকে প্রবাহিত হয়, কোনো নির্দিষ্ট দিকে স্থির থাকে না। যেমন শীতে উত্তুরে তথা উত্তর-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দেখা যায়। আর গ্রীষ্মে দক্ষিণা অথবা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই দুইয়ের ক্রান্তিকাল হলো ফাল্গুন মাস। এ সময়ে বায়ুপ্রবাহের দুরন্তপনা শুরু হয়, যাকে বলা হচ্ছে মাতাল বাতাস।
সার্বিকভাবে বসন্তের আবহাওয়া থাকে মনোরম। আকাশে কিছু কিছু মেঘ থাকলেও আবহাওয়া নির্মলই বলা চলে।
গত বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গিয়েছিল অস্বাভাবিকভাবে। মানুষের ঠোঁট-মুখ ফেটে প্রায় চৌচির হওয়ার দশা হয়েছিল, যা সাধারণত শীতকালে হয়। ফাল্গুনের শেষ দিকে কখনো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে বজ্রপাত, ঝড়বৃষ্টি হয়ে থাকে। মাসটি বেড়ানোর সময়। পর্যটকেরা দলে দলে বেরিয়ে পড়েন পাহাড়ে-সাগরে। তা ছাড়া এ সময় ভোরে ও সন্ধ্যাবেলায় হাঁটাহাঁটি করতেও একধরনের আনন্দ লাগে।
একটা সময় ছিল ফাল্গুন মাসে কখনো কখনো কলেরা, বসন্তের মতো মারাত্মক ব্যাধি হাজির হতো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রোগশোকের এতটা প্রকট রূপ দেখা যায় না। অবশ্য ডেঙ্গু এখন সারা বছরই প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ফাগুন লেগেছে বনে বনে
‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’, বিপ্লব ও দ্রোহের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফাল্গুনে ফুল ফোটা নিয়ে কিছুটা সন্দেহের মধ্যে থাকলেও আদতে এই মাসে ফুলের কোনো অভাব দেখা যায় না। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে-/ ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে’।
ফাল্গুনের অন্যতম ফুল পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়া। পত্রশূন্য শাখা যেমন থোকা থোকা রক্ত পলাশের ফুলে ভরে ওঠে, তেমনি সেসব ঝরা ফুলে ভরে থাকে গাছের তলা। আমরা আমাদের কিশোর বয়সে গাছতলায় পলাশ ফুল পড়ে থাকতে ঢের দেখেছি, সেগুলো কুড়িয়েও বিস্তর আনন্দ লাভ করেছি। একইভাবে দেখেছি রক্তলাল শিমুলভরা গাছ কীভাবে গ্রামীণ বনে ফাগুনের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কেবল শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া নয়, ফাল্গুনকে রাঙাতে এ দেশের প্রকৃতি রাজ্যে আরও হাজির হয় জুঁই, বকুল, মাধবীলতা, মধুমঞ্জরি বা মাধুরীলতা, কাঁঠালিচাঁপা, করবী, কনকলতা, মুচকুন্দ, কনকচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, নাগকেশর, দেবকাঞ্চন, পারিজাত, টগর, ভাঁটি ফুলের মতো কত ফুল।
এই ফাল্গুনেই গাছের অন্তরালে থেকে কোকিল গায় বিরহের গান। বিরহী মন তাই গেয়ে ওঠে, ‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেল গো মরার কোকিলে, আমার দেওয়ানা বানাইল গো মরার কোকিলে।’
এ সময়ে আমগাছ মুকুলে শোভিত হয়। মৌমাছি মনের আনন্দে গুঞ্জন করতে করতে সুগন্ধি ফুল ও আমের মুকুলের মধুপানে মত্ত হয়। দেখতে বড় ভালো লাগে দৃশ্যটি।
এ মাসে ব্যস্ত সময় পার করেন আমাদের কৃষক ভাইয়েরা। হেমন্তে ধান কাটার পর শীতকালে রবি ফসল তোলেন তাঁরা। এরপর বোরো ধান লাগানোর আয়োজন শুরু হয়। এ মাসে বোরো ধানে থোড় চলে আসে। সেচ দিতে হয়। সার প্রয়োগের আগে পরিষ্কার করতে হয় আগাছা।
গম পাকা শুরু হয়ে যায় এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহেই। পাটবীজ বপনের উপযুক্ত সময় ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত। এ সময় পুকুর-জলাশয় শুকিয়ে যায়। মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন।
তরমুজ, আনারস, বেল, কাঁচা আম, বরই ঢের মেলে এই ফাল্গুনেই।