কেমন মজা আইনের লাইনে?

শিরোনাম দেখে শুরুতেই হয়তো অনেকেই ভ্রু কুঁচকে ফেলেছ। কেউ কেউ হয়তো ভাবছ ‘আইনে আবার মজা কিসের? আইন মানেই তো যত সব কঠিন কঠিন ব্যাপার, মোটা মোটা বইপত্র আর কী সব প্যাঁচালো ধারাটারা। এসবে আবার মজা আসবে কী করে?’ মানলাম তোমাদের কথা। তবে আইন বিষয়টা পড়তে আসলেই মজা কি না, সেটা নিয়ে দু–এক লাইন গবেষণা যদি করে দেখি, তাহলে ক্ষতি কী?

আচ্ছা, আইন বলতে কী বোঝো তুমি? উঁহু! কঠিন কিছু ভাবতে হবে না। সহজভাবে ভাবো। আইন হচ্ছে কতগুলো নিয়মকানুন, যা আমাদের মেনে চলতে হয়। না মানলে আবার শাস্তির বিধানও আছে কপালে। আমরা যত বড় হতে থাকি, আইনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় তত বাড়তে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই আইনবিষয়ক পড়াশোনা ও পেশাকে সম্মান ও ঐতিহ্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে আমাদের সমাজে। এখন কথা হচ্ছে আইনে পড়ার অনুভূতি কেমন?

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মনেই একটা ভুল ধারণা আছে, তা হলো আইন মানে তো শুধু মুখস্থ আর মুখস্থ। ভারী ভারী বই থেকে পাতার পর পাতা মুখস্থ করাই আইন পড়া। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, আইন কখনোই মুখস্থের বিষয় নয়। বলতে গেলে মুখস্থ করার জন্য একটা লাইনও নেই। আইনের ধারা জানা মানেই কিন্তু আইন জানা নয়। আইন হচ্ছে, যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করে বুঝে পড়ার বিষয়। আইন পড়ার প্রথম ধাপ হলো একটা বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে পারা। গভীর চিন্তাশক্তি এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি। তোমার যদি ভাবতে ভালো লাগে কিংবা কোনো জিনিস নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে ভালো লাগে, তাহলে আইন নিয়ে পড়তে তোমার ভালো লাগবে। আইনের বেশির ভাগ কোর্সই বেশ মজার। একজন অপরাধীর চিন্তাধারা কীভাবে কাজ করে, তা যেমন জানতে পারবে ক্রিমিনোলজি পড়ার মাধ্যমে আবার পেনাল কোড পড়ার সময় জানতে পারবে কোন বিষয়টা আইনের চোখে চুরি আর কোনটা ডাকাতি। কন্ট্রাক্ট ল আর টর্ট ল-এর কিছু কিছু মামলার ঘটনা পড়লে দেখবে আইন বিষয়টা পড়তে দিন দিন ভালোই লাগছে।

এখন তোমার মাথায় আসতেই পারে, আইনে পড়তে হলে তো অনেক অনেক পড়াশোনা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও কি এমন স্কুল–কলেজের মতো বাঁধাধরা জীবনই কাটাব? মোটেও না। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন মানেই তো অনেক বড় হয়ে যাওয়া। সেখানে আনন্দ যেমন বেশি, নিজের প্রতি দায়িত্বটাও কিন্তু বেশি। তবে অন্য অনেক বিষয়ের তুলনায় আইন পড়াশোনার পরিধিটা একটু বেশি। কারণ, আইন হচ্ছে বড় একটা বটগাছের মতো। যার অসংখ্য শাখা–প্রশাখা হিসেবে সাহিত্য, বাণিজ্য, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে মেডিকেল সায়েন্স কিংবা নিউক্লিয়ার সায়েন্সও জড়িত। তাই পড়তেও হবে একটু বেশি। তুমি যদি নিয়মিত পড়াশোনা না করো, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে যে বিষয়ই নাও না কেন, হুট করে অনেকটা পড়া আসলেই জমে যাবে। এখন তুমি একসঙ্গে অনেকটা পড়া জমিয়ে, পরীক্ষার আগের রাতে হতাশায় ভুগতে চাও নাকি একটু নিয়মমাফিক পড়াশোনা করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে চাও, সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার।

তুমি হয়তো ভাবছ, ‘আমি তো সায়েন্স/বিজনেস স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করছি। আমি কি আইনে পড়াশোনা করতে পারব? আইন তো শুনেছি মানবিক বিভাগের জন্য তুলনামূলক সহজ।’ আইন যদি তুমি পড়তেই চাও, তাহলে এখন তুমি বিজ্ঞান/মানবিক কিংবা ব্যবসায় শিক্ষা—যে বিভাগেই পড়ো না কেন, সমস্যা হবে না। কারণ, আইনে যা পড়ানো হয়, তা ভর্তি হওয়া প্রত্যেক ছাত্রের জন্যই কিন্তু একদম নতুন বিষয়। সেটা মুসলিম আইন হোক বা দেওয়ানি/ ফৌজদারি আইন হোক। সবার জন্যই একদম নতুন। তবে কিছু কিছু বিষয়ের তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি ফরেনসিক ল/এনার্জি ল পড়ার সময়ও কিন্তু একজন বিজ্ঞানপড়ুয়া শিক্ষার্থী কিছুটা সুবিধা পাবে। আবার বিজনেস ল/কন্ট্রাক্ট ল পড়তে গেলে দেখবে যারা আগে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়াশোনা করেছে, তারা কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে। তবে এসব বড় কোনো ব্যাপার না। মোটকথা, দিন শেষে সূক্ষ্মভাবে ভাবতে গেলে আইন পড়াশোনায় বিজ্ঞান/বাণিজ্য/মানবিক এসব বিভাগ উচ্চশিক্ষা অর্জনে আহামরি কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না।

প্রশ্ন আসতেই পারে আইন পেশা আসলে কেমন? সিনেমা-ওয়েব সিরিজে যেমন দেখায় তেমনি রোমাঞ্চকর? নাকি বেশি বেশি দেখায়? সত্যি বলতে, সিনেমা-ওয়েব সিরিজে সবকিছুই একটু বেশি বেশি দেখায়। তবে তুমি যদি চাও তোমার নিজের জীবনটাকে নিজেই রোমাঞ্চকর করে তুলতে, সেটা আইন পেশার মাধ্যমে করা সম্ভব। অনেকের পরিবারই হয়তো চায় তুমি মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করো, সে ক্ষেত্রে আইনে পড়াশোনা করে তুমি কিন্তু আইনগত নানান পরামর্শ কিংবা বিচারকের আসনে বসে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থেকে মানবসেবা করতে পারবে।

দেশে ৫০টির অধিক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া তোমার যদি ব্যারিস্টার হতে ইচ্ছা করে, তাহলেও কিন্তু দেশেই আছে সেই সুযোগ। আইনে অনার্স আর বার অ্যাট ল-এর মধ্যে পার্থক্য কী, তা এখানে বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক অনেক কথা বাদ পড়ে যাবে। সেটা না হয় একটু গুগল করে নিয়ো? তবে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে জুলভার্ন, কার্ল মার্ক্স, লিও তলস্তয়, মার্কেস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ প্রভৃতি নাম তুমি দেখতে পাবে। তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আইনের ছাত্র ছিলেন। তা ছাড়া বিশ্বখ্যাত রাজনীতিবিদদের মধ্যে অধিকাংশই আইনের ছাত্র বা আইনজীবী ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, এ কে ফজলুল হক, ফিদেল কাস্ত্রো, জওহরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা আরও কত কত নাম!

জীবনে তো অনেক অনেক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছ, কিন্তু আইন বিভাগে ভর্তি হলে তুমি ভিন্ন একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। তা হলো মুটকোর্ট প্রতিযোগিতা। মুটকোর্টে অংশগ্রহণ মানেই তুমি নিজেই একজন উকিলের মতো একটা মামলায় অংশ নেবে। সেসব প্রতিযোগিতায় আবার বিচারক হিসেবে দেশের সম্মানিত বিচারপতিরাও উপস্থিত থাকেন একটা পর্যায়ে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই তুমি বাঘা-বাঘা সব বিচারপতি কিংবা আইন বিশেষজ্ঞর সামনে নিজের যুক্তিতর্ক তুলে ধরতে পারবে। মুটকোর্ট ছাড়াও মক ট্রায়াল ও ল ক্লিনিকের মাধ্যমে হাতে–কলমে আইন শেখার বাস্তব অভিজ্ঞতার অনেকটাই অনুভব করতে পারবে তুমি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে আমাদের সবারই একটা বড় চিন্তা থাকে ক্যারিয়ার–ভাবনা নিয়ে। কী নিয়ে পড়াশোনা করলে সুন্দর-ছিমছাম একটা ক্যারিয়ার হবে, এই ভাবনাটা সবারই থাকে। তবে ‘আইনে পড়ে কী হওয়া যাবে,’ এই চিন্তার আগে তোমরা যদি ‘আইনে পড়ে কী না হওয়া যাবে’ চিন্তা করে থাকো, তাহলেই মনে হয় আমার বলতে সুবিধা হবে। আইনের ক্যারিয়ার বলতে সবার আগেই আমাদের মাথায় কালো কোট-সাদা শার্ট-কালো টাই পরা একজন আইনজীবীর চেহারাই ভেসে ওঠে। আইন পেশা একটি স্বতন্ত্র পেশা। অর্থ-প্রভাব-সম্মান-মানবসেবা কেউ যদি এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে ক্যারিয়ার তৈরি করতে চায়, তাহলে আইনজীবী হওয়া একটা আদর্শ উদাহরণ। আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন দূতাবাস, বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিওতে আইন কর্মকর্তা বা প্যানেল আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ। অর্থাৎ যদি তোমার ইচ্ছা থাকে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা ইউনিসেফ/ইউএনএইচসিআরের মতো প্রতিষ্ঠানে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে, নিঃসন্দেহে আইনে পড়াশোনা করে তুমি তোমার স্বপ্নপূরণে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবে। একজন আইনের শিক্ষার্থী কিন্তু কমিশন্ড অফিসারের পদমর্যাদায় সেনা, নৌ কিংবা বিমানবাহিনীতে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ‘জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল’ হিসেবেও যোগ দিতে পারে। তখন তাদের ব্যস্ত থাকতে হবে সামরিক আইন-আদালত ও সামরিক বিচার নিয়ে।

আবার এসব বাদে যদি তুমি সরকারি চাকরির চিন্তাভাবনাও করে থাকো, তবে জানিয়ে রাখলাম যে বিসিএস ছাড়াও শুধু আইনের স্নাতকদের জন্যই আলাদাভাবে আছে ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস’ অর্থাৎ সহকারী জজ ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ‘ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার’ হওয়ার সুযোগ। এই পেশায় একজন বিসিএস ক্যাডারের তুলনায় প্রতিযোগিতা যেমন কম, তেমনি বেতনটাও বেশি। আর হ্যাঁ, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কিন্তু মানুষ তোমাকে জজ সাহেব বলে সম্বোধন করবে। তা ছাড়া তুমি যদি এসব কিছু বাদ দিয়ে, গবেষণায় কিংবা শিক্ষকতায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাও, সেই সুযোগ তো আছেই। আমি তো মাত্র কয়েকটা ক্যারিয়ার অপশনের কথা বললাম। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখবে আইনসংশ্লিষ্ট ক্যারিয়ারের সুযোগ অন্তত গোটা বিশেক। এখন নামের আগে যদি তুমি বিচারপতি, ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট প্রভৃতি উপাধি শুনতে চাও, তবে আইন নিয়ে তো একটু পড়াশোনাও করতে হবে, তাই না? যদিও আইন জানা আমাদের সবার জন্যই জরুরি।

আর তোমার যদি তা–ও মনে হয়, নাহ্‌! একটা ক্যারিয়ার অপশনও ভালো লাগল না, তাহলে তুমি হালের বিশ্বখ্যাত লিগ্যাল-থ্রিলার লেখক জন গ্রিশামের মতো জীবন বেছে নিতে পারো। সেটাও ভালো না লাগলে অভিনেতা সিয়াম আহমেদের মতো অভিনয়জীবনকেও বেছে নিতে পারো। হ্যাঁ, সিয়াম আহমেদ কিন্তু একজন ব্যারিস্টারও বটে!

আমাদের দেশে আইন নিয়ে মানুষের মনে একধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। প্রায়ই শুনে থাকবে ‘লইয়ার মানেই লায়ার’ কিংবা ‘আইনের মানুষ মাত্রই ধূর্ত ও ঝগড়াটে’। এ ধরনের কথাবার্তা যারা বলে, ধরে নেবে তারা আইন বোঝেও না এবং অন্যকেও বুঝতে দিতে চায় না। কারণ, তারা যে জানে না, এই ব্যাপারটাই কিন্তু তারা জানে না।

আইনে পড়াশোনা একদিকে যেমন পরিশ্রমসাধ্য, অন্যদিকে সেই পরিশ্রমের ফলও বেশ বড় করেই পাওয়া যায়। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে তুমি আইন পড়াটাকে উপভোগই করবে। আর যদি একবার আইনের মজা পেয়ে যাও, তবে অন্য কোনো দিকে তোমাকে টানা কঠিন কাজই হবে বলা যায়। অনেক অনেক কথা বললাম, শেষ করছি ১৯৯২ সালের আমেরিকান কমেডি ফিল্ম মাই কাজিন ভিনির কথা বলে। একজন উকিলের জীবনযাত্রাকে হাসতে হাসতে দেখতে চাইলে দেখে নিয়ো এই চলচ্চিত্রটি। যারা একটু দুষ্টু আর ফাঁকিবাজ, তারাও দেখো কিন্তু। কেন দেখতে বললাম দেখা শেষেই বুঝতে পারবে।