আল-নাকবা ফিলিস্তিনিদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
প্রতিবছর ১৫ মে সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনিরা নিজ মাতৃভূমি হারানোর দিনটিকে স্মরণ করেন। দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘আল-নাকবা’ শব্দটি। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে বুঝতে হলে নাকবা গুরুত্বপূর্ণ।
আরবি শব্দ ‘নাকবা’ মানে বিপর্যয় বা দুর্যোগ। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ক্ষেত্রে, নাকবা বা আল-নাকবা শব্দটি মনে করিয়ে দেয় ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি হারানোর ঘটনা।
ধারণা করা হয়, বর্তমানের ইসরায়েল ভূখণ্ড থেকে প্রায় সাত লাখ মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য হন বা তাঁদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু আজও রাষ্ট্রহীন অবস্থায় জীবন যাপন করছেন।
১৫ মে, ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিবছর ফিলিস্তিনিরা দিনটিকে স্মরণ করেন। প্রতিবছরই ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে ইতিহাসের সেই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এই মিছিলে অনেকে ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করেন। অনেকেই তাঁদের পুরোনো ঘরের চাবি নিয়ে আসেন বা চাবির প্রতীকযুক্ত ব্যানার তুলে ধরেন। এই মিছিলকে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার আশা ও ফিরে যাওয়ার অধিকারের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
‘দেইর ইয়াসিন’ নামের একটি গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা আজও ফিলিস্তিনিদের স্মৃতিতে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। জেরুজালেম ও তেল আবিবের মধ্যবর্তী এই গ্রামে কমপক্ষে ১০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিল।
কখনো কখনো এসব প্রতিবাদ সহিংস সংঘর্ষেও রূপ নিয়েছে। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে, হামাস ও অন্যান্য কিছু সংগঠন দিনটিকে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। বিশেষ করে যেসব সংগঠনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কিছু দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
নাকবা দিবস শব্দটি প্রথম চালু করেন তৎকালীন ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত, ১৯৯৮ সালে। তিনি দিনটিকে ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি হারানোকে স্মরণ করার আনুষ্ঠানিক দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল তুর্কি শাসনের অধীন। এই ভূখণ্ড ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। যুদ্ধের পর এই অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আসে, যা ‘প্যালেস্টাইন ম্যান্ডেট’ নামে পরিচিত। এ সময় ইউরোপে বেড়ে ওঠা ইহুদিবিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক ইহুদি ফিলিস্তিনে চলে আসতে থাকেন, যাকে তাঁরা বলেন পূর্বপুরুষদের ভূমি, ‘এরেতজ ইসরায়েল’ বা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে ইহুদি জনগণের উপস্থিতি ছিল, তবে সংখ্যায় তারা ছিল অনেক কম।
নাৎসি জার্মানিতে ঘটে যাওয়া হলোকাস্টের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে ভাগ করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আরব লীগ এই পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করে। তবে ফিলিস্তিনি ইহুদিদের প্রতিনিধিত্বকারী ‘জুইশ এজেন্সি’ এটিকে গ্রহণ করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই ঘোষণার পর পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে ১৯৪৯ সালে এই যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই দুই থেকে তিন লাখ ফিলিস্তিনি তাঁদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা জোরপূর্বক তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলার সময় আরও তিন থেকে চার লাখ মানুষ বাড়িঘর হারান। সব মিলিয়ে আনুমানিক সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হন।
এই যুদ্ধের সময় চার শতাধিক আরব গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়। যদিও এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে ‘দেইর ইয়াসিন’ নামের একটি গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা আজও ফিলিস্তিনিদের স্মৃতিতে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। জেরুজালেম ও তেল আবিবের মধ্যবর্তী এই গ্রামে কমপক্ষে ১০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিল। এই ঘটনার পর ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
যুদ্ধ শেষে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ৪০ শতাংশের বেশি জমি দখল করে নেয়। এই জমি জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের দুই রাষ্ট্র পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের জন্য নির্ধারিত ছিল।
বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাংক) ও আশপাশের আরব দেশগুলোয় আশ্রয় নেন। খুব অল্পসংখ্যক লোক আরও দূরে, বিদেশে চলে যান।
আজও নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তিনিদের খুব কম অংশই অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার পর নাগরিকত্ব পেয়েছেন। ফলে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করা প্রায় ৬২ লাখ ফিলিস্তিনির বিশাল অংশই তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের শরণার্থী ফিলিস্তিনি নাগরিক। যাঁদের কোনো রাষ্ট্র নেই, এখনো তাঁরা রাষ্ট্রবিহীন।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনর(UNRWA)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অধিকাংশ ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বাস করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো শরণার্থী শহরে পরিণত হয়েছে। এরা মূলত বাস করেন গাজা উপত্যকা, অধিকৃত পশ্চিম তীর, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও পূর্ব জেরুজালেমে।
আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে থাকা ফিলিস্তিনি ভূমি হারানো মানুষের সংখ্যা এখন ৬০ থেকে ৭০ লাখ। এদের মধ্যে অনেকেই তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের শরণার্থী। এ তথ্য সঠিক হলে, বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৩০ লাখের কাছাকাছি। তবে প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের সঠিক সংখ্যা জানার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যভান্ডার নেই।
ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বিশ্বজুড়ে সমর্থন রয়েছে। এর পক্ষে জাতিসংঘের দুটি রেজল্যুশন ও একটি কনভেনশনের কথা বলা যায়। এই তিন সূত্রমতে, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার আছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রেজল্যুশন ১৯৪; ১৯৭৪ সালের রেজল্যুশন ৩২৩৬; ১৯৫১ সালের শরণার্থীদের মর্যাদাবিষয়ক কনভেনশন অনুসারে যাঁদের ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে গণ্য করা হয়, তাঁদের নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার আছে।
তবে ইসরায়েল এই ফিরে যাওয়ার অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁদের মতে, এটি বাস্তবায়িত হলে ইসরায়েলের একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচয় বিলুপ্ত হবে। এ ছাড়া ইসরায়েল দাবি করে যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে প্রায় ৮ লাখ ইহুদি বিভিন্ন আরব দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে বা পালাতে বাধ্য হয়েছে। যেমন মরক্কো, ইরাক, মিসর, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেন থেকে তারা ইসরায়েলে এসেছে। ফিলিস্তিনিদের ফিরে যাওয়ার অধিকার চাইলে সেই বাস্তবতা আলোচনায় আনতে হবে।
গত ৭৭ বছরে এই সংকটের সমাধানে অনেক প্রস্তাব এসেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হচ্ছে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন, দুটি রাষ্ট্র জেরুজালেমকে দুটি রাজধানীতে ভাগ করে নেবে।
তবে উভয় পক্ষেরই এই সমাধানের বাস্তবতা নিয়ে সংশয় আছে। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি সেটেলার বা বসতিগুলোর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই সমন্বিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড গঠনের সম্ভাবনা সরে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে।
দুই রাষ্ট্র সমাধানের বাইরেও অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে আছে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া। সীমিত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অথবা একটি রাষ্ট্রের ভেতর দুই পাসপোর্টের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলায় অন্তত ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং ২৫১ জন মানুষ হামাসের হাতে বন্দী হন। এরপর গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং নারী-শিশুসহ প্রায় ৬৩ হাজার ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের বাস্তব সমাধান ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।