সায়েন্স ফিকশনের যে প্রযুক্তি বাস্তবে ব্যবহৃত হচ্ছে

স্পেসস্টেশন

তোমাকে ৫০ বছর আগে ফিরে যেতে বললে কী ভাববে? আমার মনে হয়, অবশ্যই তোমার কল্পনায় টাইম মেশিন আসবে। টাইম মেশিন এমন এক যন্ত্র, যেটায় চড়ে আগের যেকোনো সময়ে ফিরে যাওয়া যায়। কেউ কেউ ভবিষ্যতে যাওয়ার কথাও বলেন। বাস্তবে টাইম মেশিনের অস্তিত্ব নেই। এখন পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেননি। অতীতে বা ভবিষ্যতে যাওয়া এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবু তোমাকে কেউ যদি বলে, ৫০ বছর আগে ফিরে যাও। তবে তুমি কল্পনা করতেই পারো।

৫০ বছর আগে ঢাকার ধানমন্ডির কোনো এক রাস্তার ধারে তুমি দাঁড়িয়ে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস না থাকলে আনমনে হাঁটতে পারো। এমন সময় তোমার ফোনে একটি ফোনকল এল। তোমার বন্ধু, নাম দেওয়া যাক ইকরি, কল করেছে। তুমি কল রিসিভ করে বললে, হ্যালো! এরপর হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলতে থাকলে। ফোনটা থাকবে তোমার পকেটে, কানে ইয়ারবাড। ইয়ারবাডে আলতো স্পর্শ করে তুমি কলটা রিসিভ করেছ। কানের ভেতরে ছোট্ট ইয়ারবাড থাকায় কথা বলতে বা শুনতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। কিন্তু একটু ভাবো, ৫০ বছর আগের মানুষেরা তোমাকে দেখবে। তারা দেখতে পাবে, একটা ছেলে বা মেয়ে অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলছে। খুব সম্ভাবনা আছে লোকে তোমাকে পাগল ভাববে। ছোট ছেলেমেয়েরা তোমার পিছু নিতেও পারে।

ধরো, একদল দুষ্টু ছেলে তোমার পিছু নিল। তুমি খুব বিরক্ত হলে। ভাবলে, ধুর ছাই! এখানে থাকব না। টাইম মেশিনের বোতাম চেপে চলে যাও ১০০ বছর আগে।

১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলে। সে সময় ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি। ধরা যাক, কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ নিজ বাড়িতে আরামকেদারায় বসে দোল খাচ্ছেন। তুমি গিয়ে বললে, ‘গুরুদেব, আগামীকাল একটা জুম মিটিং আছে। কিশোর আলোর বন্ধুরা আপনার একটা সাক্ষাৎকার নেবে। আপনি আপনার এই চেয়ারে বসেই সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন। মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা সবাই আপনাকে একই স্ক্রিনে দেখতে পাবে। এমনকি মিটিংয়ের আলোচনা লাইভ সম্প্রচারও করা হবে। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আলোচনা দেখা যাবে। আপনার একটি ইন্টারনেট-সংযোগসহ ফোন আমি দিয়ে যাচ্ছি। মহাশূন্য থেকে একজন নভোচারী কিশোর আলোর দলের সঙ্গে মহাকাশ থেকে আলোচনায় যুক্ত হবেন। তিনি আছেন শূন্যে ঝুলে থাকা এক মহাকাশ স্টেশনে। যেখানে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই। ভেসে ভেসে তিনি তাঁর প্রতিদিনের কাজ করছেন। এসব শুনে ১০০ বছর আগের রবিবাবুর চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার কথা। তিনি ভাঙা গলায় গেয়েও উঠতে পারেন, আমার এ দেহখানি তুলে ধরো…

থ্রিডি হলোগ্রাম

এখনকার অবস্থা ভিন্ন। রাস্তায় অনেককেই দেখা যায়, নিজ মনে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, তাঁর কানে ছোট্ট একটা ইয়ারবাড আছে। এটি ব্লুটুথের মাধ্যমে যুক্ত আছে তাঁর ফোনে। ফোনের ওপাশে কারও সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। কোভিডকালে আমরা জুম কলে পড়াশোনা করার অভ্যাস করে ফেলেছি। তো কানের ইয়ারবাডের কথা বলছিলাম। এমন ইয়ারফোনের ধারণা পাওয়া যায় ফারেনহাইট ৪৫১ নামের এক উপন্যাসে। প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৩ সালে। বাস্তবে ওই সময়েও ইয়ারফোন ছিল। কিন্তু ওজন ছিল কয়েক টন। দেখতে খুবই বিদঘুটে। এই উপন্যাসে বলা হয়েছিল ভবিষ্যৎ পৃথিবীর এক সময়ের কথা। যেখানে বই নিষিদ্ধ। মানুষ কানের মধ্যে ঝিনুকের মতো বস্তু নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যার মাধ্যমে তৈরি হয় শব্দের বৈদ্যুতিক মহাসাগর। পৃথিবীর সব শব্দ শোনা যায়। মিল পাওয়া যাচ্ছে?

প্রযুক্তি বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা এমন অনেক কল্পকাহিনি পরে সত্য হয়েছে। যেগুলো আমাদের জীবনে ব্যবহার করা প্রযুক্তির সঙ্গে খুব মিল পাওয়া যায়। যত রকম গল্প হয়, তার মধ্যে সায়েন্স ফিকশন ভবিষ্যৎ কল্পনায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এটি সায়েন্স ফিকশন লেখকদের সৃজনশীলতার প্রমাণ। এমন আরও কিছু সায়েন্স ফিকশনের কল্পনার কথা বলি, যেগুলো পরে সত্য হয়েছে।

১৯৪৫ সালে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখক আর্থার সি ক্লার্ক লেখেন দ্য স্পেস স্টেশন: ইটস রেডিও অ্যাপ্লিকেশন। তিনি প্রস্তাব করেন, স্পেস স্টেশনগুলোকে টেলিভিশন সংকেত সম্প্রচার করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বিবৃতি যখন প্রচার করেন, তখনো টেলিভিশন বাণিজ্যিক সম্প্রচার শুরু করেনি। ১৭ বছর পর ১৯৬২ সালে টেলিস্টার ১ যোগাযোগ উপগ্রহ ইতিহাসে প্রথম ট্রান্সআটলান্টিক টেলিভিশন সংকেত প্রচার করে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী ৩০.৬ মিলিয়ন দর্শক লাইভ দেখেন। এই ভাইরাল অনুষ্ঠানকে সায়েন্স ফিকশন টিভি শো দ্য টোয়াইলাইট জোন–এর সঙ্গে তুলনা করা হয়।

ক্রেডিট কার্ড এল যেখান থেকে

১৯৬৮ সালের সিনেমা ২০০১: আ স্পেস ওডিসি-তে দেখা যায়, একটি মহাকাশযানে একটি বিশেষ কম্পিউটার আছে। যেটি ব্যবহার করে মহাকাশযানে থাকা একজন লোক পৃথিবীতে থাকা তাঁর মেয়েকে ভিডিও কলে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। সিনেমা তৈরি হওয়ার ৫০ বছর পরের পৃথিবীতে ভিডিও কল করা হয়ে গেছে একদম স্বাভাবিক। পৃথিবী তো বটেই, মহাশূন্য থেকে নভোচারীরা ভিডিও কলে যুক্ত হচ্ছেন। আবার কোভিড এসে যোগাযোগের ধরন একদম বদলে দিয়েছে। নতুন স্বাভাবিকে ভিডিও কলের চর্চা ও গুরুত্ব বেড়েছে। বাসায় বসে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যে কারও সঙ্গে যুক্ত হওয়া এখন খুব স্বাভাবিক। স্কুলছাত্র থেকে রাষ্ট্রপ্রধান—সবাই এভাবেই কাজ করছেন। রবীন্দ্রনাথের সময় ভিডিও কল না থাকলেও এখন তা হয়ে গেছে ডালভাত।

২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাস্তবে শুধু হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিদিন ৩৪০ মিলিয়ন মিনিটের বেশি ভিডিও কল করা হয়। কোভিড-১৯ মহামারিতে এই কল করার হার বহুগুণ বেড়েছে। অন্যান্য জনপ্রিয় ভিডিও কলিং সফটওয়্যার, যেমন জুম, স্কাইপে, গুগল হ্যাংআউটস, ফেসটাইম ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে কলের সুবিধা ব্যবহার করা ছাড়া আমাদের প্রতিদিনের কাজ শেষ করা অসম্ভব মনে হয়। আমাদের এই প্রজন্ম সম্ভবত প্রথম কোনো প্রজন্ম হবে, যারা ভয়েস কলের চেয়ে বেশি ভিডিও কল করবে।

স্টার ট্রেক-এর ইউনিভার্সেল ট্রান্সলেটর

টাকাপয়সার ব্যাপারটা এখন দেখাশোনা করে ব্যাংক। বহুকাল আগ থেকে ব্যাংকের ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে টাকা তোলার ব্যাপারটি বা এটিএমের ব্যবহার চালু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। ক্রেডিট কার্ডের ধারণা এসেছে আরও পরে। ১৮৮৮ সালে এডওয়ার্ড বেলামির বই লুকিং ব্যাকওয়ার্ড থেকে ক্রেডিট কার্ডের ধারণা পাওয়া যায়। বইটিতে আছে আমাদের সময়, মানে বর্তমানের কথা। তখনকার হিসাবে ভবিষ্যতে একটি কার্ড মানুষকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্রেডিটে টাকা ধার করার অনুমতি দিত। কাগজের মুদ্রার প্রয়োজন পড়ত না। শুনে মনে হবে, এ তো আমরা নিয়মিতই ব্যবহার করি। বাস্তবে প্রথম জনপ্রিয় ক্রেডিট কার্ডটি ১৯৫০ সালে ডাইনার্স ক্লাব প্রথম ব্যবহার করার জন্য উন্মুক্ত করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে দুই বিলিয়নের বেশি সক্রিয় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে। কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে এই কার্ডগুলো। একটি আমেরিকান পরিবার গড়ে প্রতি মাসে ছয়টি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার অফার পায়।

ওদিকে আমরা তো এখন প্রতিদিনই ভিডিও কল করি। ১৯১১ সালে ভিডিও কলের ধারণা এসেছে। হুগো জার্নসব্যাকের রালফ ১২৪সি ৪১+ নামের সায়েন্স ফিকশন বইটিতে টেলিফট নামের একটি ভিডিও টেলিফোন ডিভাইসের কথা বলা হয়েছে। ডিভাইসটি গল্পের নায়িকা অ্যালিস ২১২বি৪২৩ ব্যবহার করেন। তুষারপাতের ঝুঁকির মুখে পড়েন তিনি। ডিভাইসটি ব্যবহার করেন ভিডিও কল করে সাহায্যের জন্য। বর্তমান ভিডিও কল প্রযুক্তির পূর্বাভাস তখনই দেওয়া হয়েছে নিখুঁতভাবে। তখন তিনি চার হাজার মাইল দূর থেকে রালফকে এই কল করেন।

ভিন্ন ভাষায় কথা বললে এক দেশের মানুষ আরেক দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। হয় ভাষা শিখতে হয়, অথবা কাউকে অনুবাদ করতে হয়। কিন্তু আধুনিক সময়ে ব্যবহার করা হয় ট্রান্সলেটর। সরাসরি এক ভাষায় কথা বললে অন্য ভাষায় অনুবাদ শোনা যায়। বাস্তবে অনুবাদ বা ট্রান্সলেটর আসার আগে কল্পবিজ্ঞানে পাওয়া যায় ট্রান্সলেটর। এই ধারণা এসেছে স্টার ট্রেক সিনেমা থেকে। টিভি সিরিজও আছে। সিরিজটি বেশ বিখ্যাত। নেটফ্লিক্সে সিরিজটি দেখতে পারো। এই সিরিজের একপর্যায়ে দেখবে, মহাকাশভ্রমণের সময় ক্যাপ্টেন কার্ক ও স্পক এলিয়েনের সঙ্গে কথা বলেন। এলিয়েন একটি অপরিচিত ভাষায় কথা বলে। একটি ইউনিভার্সাল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে এলিয়েনের ভাষাকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হয়। বর্তমানে এলিয়েন খুঁজে পাওয়া না গেলেও যোগাযোগের জন্য ভাষা আর কোনো বাধা নয়। যেকোনো ভাষা থেকে স্কাইপের নতুন অনুবাদপদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে যোগাযোগ করা যায়।

তুমি মাইকেল জ্যাকসনের কথা জানো। এ রকম বিখ্যাত গায়ক পৃথিবীতে তেমন একটা আসেননি। ২০০৯ সালে মারা যান মাইকেল জ্যাকসন। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরের ঘটনা। ২০১৪ সালে বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার সময় মঞ্চে পরিবেশিত হয় মাইকেল জ্যাকসনের ‘স্লেভ টু দ্য রিদম’ গান। দর্শক অবাক হয়ে দেখলেন, স্বয়ং মাইকেল জ্যাকসন মঞ্চে নাচের পারফর্ম করছেন। মঞ্চে সহনর্তক, মুন ওয়াক, জেটস অব ফায়ার—সবই বাস্তব ছিল। শুধু মাইকেল জ্যাকসনের পারফর্মে হলোগ্রাম বা ত্রিমাত্রিক প্রতিলিপি ব্যবহার করা হয়েছে। এই হলোগ্রামের সঙ্গে বাস্তবের খুব একটা ফারাক নেই। হলোগ্রাম মঞ্চে নিয়ে আসায় পৃথিবী এখন নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। মৃত সেলিব্রিটিদের মঞ্চে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। হরহামেশা হলিউড সিনেমায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মৃত অভিনেতাদের অভিনয় সিনেমায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এমনকি কাজ হারানোর ভয়ে অভিনেতারা আন্দোলন শুরু করেছেন। হলোগ্রাম ৪০ বছর আগে স্টার ওয়ার্স ৬ নম্বর পর্বে আ নিউ হোপ সিনেমায় গ্যালাক্সি অভিযানে দেখা যায়। তখন ভাবা হয়েছিল, হলোগ্রাম বুঝি খুব দূরের জিনিস। চট করে পৃথিবীতে হলোগ্রাম চলে আসবে না। কিন্তু চলেই তো এল।

টাইম ট্রাভেল করার জন্য টাইম মেশিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তোমার ভাবতে কষ্ট হয়নি টাইম ট্রাভেল করা নিয়ে। তুমি ৩০ বছর বা শত বছর আগে যদি কল্পনা করতে পারো, শত সায়েন্স ফিকশনে আসা এই ঘটনা একদিন সত্য হতে পারে। কারণ, আগে যা ছিল কল্পনায়, এখন তা বাস্তব। এখন যা আছে কল্পনায়, তা বাস্তব হতে পারে কিছুকাল পরই।