‘আমরা কি উঠছি?’
‘না! উল্টো, আমরা নামছি।’
‘তার চেয়ে খারাপ মিস্টার সাইরাস। আমরা পড়ছি।’
এভাবে কয়েকটা সংলাপ দিয়ে শুরু হয় জুল ভার্নের উপন্যাস দ্য মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড বা রহস্যের দ্বীপ। সংলাপগুলো কাদের মধ্যে ঘটছে, বোঝা যায় না, কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। আর বোঝা যায়, কোনো একটা উড়ন্ত বস্তুর মধ্যে আছে জনা পাঁচেক আরোহী। আর বস্তুটা আকাশ থেকে পড়ছে মুক্তভাবে।
আরেকটু এগোলে বোঝা যাবে, আরোহীরা একটা বেলুনে সওয়ার। সেই বেলুন ঝড়ের কবলে পড়েছে। নিচে অন্ধকারে ফুঁসতে থাকা সাগর।
আরোহী কারা? অন্ধকার রাতে কেনই-বা তারা এভাবে বেলুনে পাড়ি দিচ্ছে?
আরেকটু এগোলে আমরা জানতে পারি, পাঁচ আরোহী আমেরিকার গৃহযুদ্ধে অবরুদ্ধ এক শহরের বাসিন্দা। এ বেলুনে চড়েই পালাচ্ছে তারা। এখন সেটা ঝড়ের তাণ্ডবে আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। গল্পটা যেভাবে বলা হচ্ছে, স্পষ্ট মনে হবে যেন সিনেমার এক্সট্রিম ক্লোজ শট থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে জুম আউট করে একটা লং শটে যাওয়া হচ্ছে।
কাহিনির ভেতর থেকে একটা উত্তেজনাকর তুঙ্গ মুহূর্ত বা ক্লাইমেক্স সামনে এনে উপন্যাস শুরু করা, পাঠককে শুরুতেই ‘হুক’ করে ফেলা, তারপর প্রয়োজনমাফিক কাহিনি সামনে-পেছনে নন-লিনিয়ার পথে এগোনো—এসব কৌশল হাল আমলের হলিউডের স্টুডিও সিনেমার বিষয় মনে হলেও দেড় শ বছর আগে এগুলো প্রয়োগ করেছেন জুল ভার্ন। আসলে গল্প বলার এসব অভিনব কৌশলের অনেকগুলো তিনি নিজেই উদ্ভাবন করে নিয়েছেন।
রহস্যের দ্বীপ উপন্যাসের কথাই ধরা যাক। এ উপন্যাসে তিনি আরেক নতুন জিনিসের অবতারণা ঘটিয়েছেন, আজকের জমানায় যেটাকে আমরা বলি ‘স্পিন-অফ’। এটি জুল ভার্নেরই পাঁচ বছর আগের আরেক বিখ্যাত উপন্যাস টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সির (সাগরতলে ২০ সহস্র লিগ) শাখা কাহিনিমাত্র। রহস্যের দ্বীপ উপন্যাসের একেবারে শেষ দিকে এসে হাজির হবেন ক্যাপ্টেন নিমো—‘নটিলাস’ নামের ডুবোজাহাজের ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন নিমোর কাহিনি শেষ হয় চরাচরব্যাপী এক প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবের উল্লেখে। রহস্যের দ্বীপ শুরু হয় ওই একই ঝড় দিয়ে।
রহস্যের দ্বীপ উপন্যাস আসলে ড্যানিয়েল ডিফোর ধ্রুপদি উপন্যাস রবিনসন ক্রুসোর একটা ছায়াপাতমাত্র। এ দিয়ে জুল ভার্ন তাঁর ডিফো-ভক্তির ঋণ চুকিয়েছেন।
অনেকে জুল ভার্নকে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি নামের সাহিত্যধারার জনক বলে মনে করেন। সেটা অনেকটাই সত্য। তবে ওই পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যায় গল্পকথক জুল ভার্নের পরিচয়। তাঁর মতো প্রতিভাধর কাহিনিকার খুব কমই দেখা গেছে সাহিত্যের আকাশে। তিনি কাহিনির এমন এক অফুরান আর সহজাত ভান্ডার ছিলেন, আজকের জমানায় জন্মালে তাঁকে নিয়ে একদিকে যেমন ডিজনি, ওয়ার্নার ব্রাদার্স আর ইউনিভার্সাল টানাটানি করত, তেমনই আরেক দিকে তাঁকে টানত সনি ও নিনতেদোর মতো গেমিং কোম্পানিগুলো। ডিসি ও মার্ভেলকে একাই চালিয়ে নিতে পারতেন জুল ভার্ন। মনে রাখা দরকার, দেড় শ বছর আগে জুল ভার্ন তাঁর কাহিনিগুলোর পটভূমি ও চরিত্রগুলোকে বারবার ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের একটি অভিন্ন ইউনিভার্স বা চরাচর তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। সেটা যেমন দুটি উপন্যাসে ছড়ানো ক্যাপ্টেন নিমোর ক্ষেত্রে ঘটেছে, তেমনি ঘটেছে বাল্টিমোর গান ক্লাব নামের আমেরিকার একটি কাল্পনিক ক্লাবের সদস্যদের নিয়েও। এ ক্লাবের তিন সদস্যের অভিযান নিয়ে তিনি তিনটি উপন্যাস লিখেছেন—ফ্রম আর্থ টু দ্য মুন, রাউন্ড দ্য মুন এবং দ্য পারচেজ অব দ্য নর্থ পোল।
জুল ভার্নকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকার না বলে বরং রোমাঞ্চ অভিযান কাহিনির লেখক বলাই বেশি সংগত হবে। কারণ, তিনি রোমাঞ্চ কাহিনিই বেশি লিখেছেন। আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনিও যা লিখেছেন, তার মধ্যে বিজ্ঞানের চেয়ে অভিযানের উপকরণ বেশি। যেমন ক্যাপ্টেন নিমোর ‘সাগরতলে’ কাহিনিটার কথাই ধরা যাক। সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজের কথা বলেছেন তিনি এখানে। কিন্তু সেটার কারিগরি দিকগুলোর চেয়ে অনেক বড় অংশজুড়ে আছে সাগরের তলদেশে এক খ্যাপাটে প্রতিভার অদ্ভুত অভিযান। সারা পৃথিবীর সাগর-মহাসাগর চষে বেড়িয়েছেন এই বিজ্ঞানী।
জুল ভার্ন নিজে বলতেন, তাঁকে বিজ্ঞানের কাহিনিকার না বলে বরং ভূগোলের কাহিনিকার বলা যেতে পারে। কথাটা সবচেয়ে বেশি খাটে জুল ভার্নের ৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ নামের বিখ্যাত উপন্যাসের ক্ষেত্রে। ফিলিয়াস ফগ নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক মাত্র ৮০ দিনের মধ্যে পুরো পৃথিবী একবার চক্কর দিয়ে আসার বাজি ধরে লন্ডন শহর থেকে রওনা দেয়। সে পূর্বে রওনা দিয়ে কখনো রেলগাড়িতে, কখনো জাহাজে, কখনো হাতির পিঠে চেপে ইউরোপ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর দিয়ে, ইরান পেরিয়ে, ভারত ডিঙিয়ে, দূরপ্রাচ্য ছুঁয়ে, প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা মহাদেশ এফোঁড়-ওফোঁড় করে লন্ডনের দেশে ছুটেছে। সঙ্গে তার ফরাসি ভৃত্য পাসোপার্তু। আর তাদের পিছু নেওয়া এক ডিটেকটিভ পদে পদে বাধা দিতে থাকে।
এ এক শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি। দম ফেলা কঠিন। এখানে জুল ভার্নকে আমরা গল্প বলার এমন সব কৌশল প্রয়োগ করতে দেখি, যা পরবর্তীকালে ঝানু কাহিনিকারদের চর্চায় পরিণত হয়। যেমন ধরা যাক উপন্যাসের মাঝামাঝি একটা স্নায়ুটান অবস্থা বা ক্লিফ হ্যাঙ্গারে গিয়ে গল্পটা দুই ভাগ হয়ে যায়। পরিণতি আড়াল করে ভিন্ন একটা সংকটের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় পাঠককে। এক অধ্যায় পরেই আবার গল্পের আগের সুতায় ফিরে আসা হয়। এ যেন সার্কাসের এক দক্ষ জাগলার, যিনি কয়েকটা বল লোফালুফি করছেন একই সঙ্গে।
জুল ভার্ন অজস্র লিখেছেন। এত বেশি কাহিনি তাঁর সময়ে আর কাউকে লিখতে দেখা যায়নি। আর তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন যে ওই সময়ে ফ্রান্সের সবচেয়ে নামকরা প্রকাশনা সংস্থা ‘হেজেল’কে তিনি প্রায় একাই চালিয়ে নিয়েছিলেন।
তবে মজার ব্যাপার হলো এই সাহিত্যিক জীবন জুল ভার্নের হয়তো পাওয়া হতো না প্রকাশক ও সম্পাদক পিয়েরে-জুল হেজেলের সঙ্গে দেখা ও বন্ধুত্ব না হলে। এ সাক্ষাৎ না ঘটলে জুল ভার্ন হয়তো কয়েকটা ব্যর্থ নাটক আর দু–একটা সাড়াহীন ঐতিহাসিক উপন্যাসের রচয়িতা হয়েই জীবন কাটাতেন। হেজেল আর তাঁর প্রকাশনা সংস্থা জুল ভার্নের জন্ম দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
জুল ভার্নের জন্ম ১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের নানতে নামের এক বন্দর শহরে। তাঁর বাবা আইনজীবী ছিলেন বলে তাঁকে ওই পেশার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। কিন্তু ভার্ন সাহিত্যিক হওয়ার বাসনায় ভিন্ন পথ বেছে নেন।
গোড়া থেকেই কিছুটা বোহেমিয়ান ছিলেন। সে কারণে প্যারিসে একটা থিয়েটার কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে কিছু নাটক লেখার চেষ্টা করেছিলেন। সে যুগে চলচ্চিত্রের জন্ম হয়নি। থিয়েটার কোম্পানিতে চাকরি করা মানে অনেকটা হলিউডের কোনো স্টুডিওতে চাকরি করার মতোই। পরে সেটাও ছেড়ে দিয়ে একটা স্টক ব্রোকার কোম্পানিতে চাকরি নেন এবং বিয়েও করেন তিনি।
এ সময় দুজন লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। একজনের নাম ফেলিক্স তুর্নাচো। তিনি একজন শিল্পী এবং বেলুনে ভ্রমণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তাঁর পাল্লায় পড়ে বেলুন চড়া নিয়ে নানা কিছু জানা হয়ে যায় জুল ভার্নের। আর তখনই তাঁর বেলুনে ভ্রমণ নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার চিন্তা মাথায় ঢোকে। ভার্ন বুঝতে পারছিলেন, তাঁর এ উপন্যাস একেবারেই অন্য রকম কিছু হতে যাচ্ছে। এভাবে বিজ্ঞান আর ভূগোলের বিষয়কে উপজীব্য করে কেউ উপন্যাস লেখেনি তখনো।
এ সময় দ্বিতীয় যে লোকটার সঙ্গে জুলের বন্ধুত্ব হয়, তিনি পিয়েরে হেজেল। প্রতিভা চিনতে তাঁর দেরি হয়নি। হেজেল তাঁর প্রকাশনা থেকে বইটি ছাপতে রাজি হন।
১৮৬৩ সালে ছাপা হয় ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন। জুলের বয়স তখন ৩৫। বইটার বিপুল কাটতি হলো।
হেজেল জুল ভার্নকে প্রস্তাব দিলেন এ রকম অনেকগুলো উপন্যাস লিখে দিতে। এগুলোর একটা অভিন্ন সিরিজ নামও দেওয়া হলো ‘ভেয়েজেস এক্সট্রা অর্ডিনারি’, অর্থাৎ অবাক অভিযান। হেজেল একটা পত্রিকাও বের করতেন। সেই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতো উপন্যাসগুলো। শেষ অধ্যায়টা পত্রিকায় ছাপা হতো না। কেননা, একটা চমক লুকানো থাকত সেখানে। শেষ অধ্যায়সহ পুরো উপন্যাস বছর শেষে বড়দিনের দিন ছাপা হয়ে বের হতো।
এভাবে বছরে দুটি–তিনটি করে বই লিখতে শুরু করলেন জুল ভার্ন। সব বই-ই তুমুল হিট। ইউরোপজুড়ে তখন জুলের পাঠক। ‘অবাক অভিযান’ সিরিজে একের পর এক লেখা হতে থাকল বিজ্ঞান, কল্পনা আর দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি। কখনো মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বেয়ে পাতালে নেমে যাচ্ছেন অভিযাত্রীরা, কখনো কামানের গোলায় চেপে ছুটে যাচ্ছেন চাঁদে, কখনো সাগরের তলে।
প্রায় ২৪ বছর স্থায়ী হয়েছিল প্রকাশক হেজেল আর লেখক জুল ভার্নের এ সম্পর্ক। এই দুই যুগে ভার্ন ৬০টির বেশি উপন্যাস লিখেছেন।
হেজেল শুধু প্রকাশকই ছিলেন না, ছিলেন জুলের পাণ্ডুলিপি সম্পাদকও। শুধু তা–ই নয়, জুলের লেখার একপ্রকার মেন্টর ছিলেন তিনি। দুজনের এই বন্ধুত্ব আর লেনদেন যুগ্ম সৃজনশীলতার ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
এ রকম সৃজনশীল বন্ধুত্বের আরেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তরুণ আইজ্যাক আসিমভ ও অ্যাসটাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন পত্রিকার সম্পাদক জন উড ক্যাম্পবেল জুনিয়রের মধ্যে। তবে জুল আর হেজেলের লেনদেন ছিল আরও অনেক বেশি। অতিসম্প্রতি এই দুজনের আলাপের চিঠিপত্রগুলো আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে এবং আমরা জানতে শুরু করেছি, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার বাইরে নানা রকম সৃজনশীল বুদ্ধি–পরামর্শ ও আইডিয়া দিয়ে লেখক জুলকে একপ্রকার নির্মাণই করে নিতেন হেজেল। অনেক কাহিনির অভিমুখ বদলে দিতেন। হেজেলের পরামর্শে অনেক কাহিনি লিখেও প্রকাশ না করে ফেলে রেখেছেন জুল ভার্ন। এ রকমই একটি উপন্যাস জুল ভার্নের মৃত্যুর প্রায় ৯০ বছর পর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। সেটার নাম প্যারিস ইন টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি। জুল ভার্ন যখন দু হাতে লিখছেন, তখন ইউরোপে চার্লস ডিকেন্স, ভিক্টর হুগোর মতো অনেক বড় বড় লেখকের যুগ। তাদের ভিড়ে তাকে আলাদা করা যেত গল্প বলার একটা নতুন ভঙ্গির জন্ম দেওয়ার কারণে। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। বলতে গেলে, ওই সময় ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তবে এটা তার একমাত্র গুণ ছিল না। তার সবচেয়ে বড় গুণ তিনি এমনসব কাহিনি ফেঁদেছেন, যা চিরকালের।