যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ অব দ্য আর্টসে স্নাতকোত্তরের ভর্তির আবেদন চলছে। পড়াশোনার বিষয়ের নাম ‘কমিকস’। নানান জায়গা থেকে অনেক আবেদন আসছে। তার মধ্যে একটি আবেদনের সঙ্গে যুক্ত পোর্টফোলিও দেখে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও একটু অবাক হলেন। তাই আবেদনকারীর ডাক পড়ল একটি অনলাইন ইন্টারভিউতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখে আবেদনকারী ‘ওভার কোয়ালিফায়েড’। অর্থাৎ এ বিষয়ে পড়াশোনা করে যা যা করা যায়, ইতিমধ্যেই তার চেয়ে বেশি কাজ করে ফেলেছেন তিনি। তাই দেখে প্রতিষ্ঠানটিরও জানার আগ্রহ হলো, কেন আবেদনকারী এ বিষয়ে পড়তে চাইছেন।
এই আবেদনকারী আর কেউ নন, তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট মেহেদী হক। ২২ বছরের বেশি সময় ধরে যিনি পেশাগতভাবে কার্টুন আঁকেন, পরিচালনা করেন ‘ঢাকা কমিকস’ নামের একটি কমিকস প্রকাশনাও। যুক্তরাষ্ট্রের শতবর্ষী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মজাদার ইন্টারভিউ শেষে তিনি সেখানে কেবল পড়ার সুযোগই পাননি, সঙ্গে পেয়েছেন মেরিট স্কলারশিপও।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ থেকে স্নাতক করার পর গতানুগতিক চাকরি করার চেয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কার্টুন আঁকাকেই। এখন আবার দীর্ঘদিন পর পড়াশোনায় ফেরার কারণ কেবলই পড়ার বিষয় কমিকস বলে। তিনি জানান, ‘কার্টুন বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়, তা-ই জানা ছিল না। অ্যানিমেশন নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট আছে, তা জানতাম। তবে যখন জানতে পারলাম কার্টুন, বিশেষ করে কমিকস নিয়েই পড়া যায়, তা-ও আবার ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে, তখন থেকেই টানা খোঁজ করেছি, কোথায়, কীভাবে পড়া যায়!’
বিশ্বের বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়েই কমিকস রয়েছে চারুকলা অনুষদের বিষয় হিসেবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটিই সম্পন্ন করার সুযোগ রয়েছে এসব জায়গায়। স্নাতক হলে তিন থেকে চার বছর আর স্নাতকোত্তরের ক্ষেত্রে দুই বছর মেয়াদি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। আঁকা, গল্প ফাঁদা, সহজভাবে উপস্থাপনের খুঁটিনাটি, অর্থাৎ কমিকস থিওরি নিয়ে বেশ উন্নত শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে চারুকলার অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে এটি একটু বেশিই খরচসাপেক্ষ। তাই কমিকস বিষয়টি পড়তে চাইলে একটি স্কলারশিপ পেয়ে গেলে এই যাত্রা হবে সহজ। আর সেই স্কলারশিপ পেতে প্রয়োজন একটা বেশ ভালো মানের পোর্টফোলিও, ভাষাগত দক্ষতা ও দুর্দান্ত যোগাযোগ দক্ষতা।
বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল স্টোরিটেলিংয়ের ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে প্রচুর। আধুনিক বিশ্বে কমিকস নিয়ে শুরু হয়েছে বেশ কিছু ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ কাজ। বাংলাদেশেও মৌলিক গল্পনির্ভর চমৎকার সব কমিকস তৈরি করতে শুরু করেছে ঢাকা কমিকস। বাংলাদেশের গল্প, বাংলাদেশের চরিত্র শুধুই বিনোদনের খোরাক হিসেবে কাজ করছে না, কমিকসশিল্প আবার খুব সহজেই এমন একটি জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যেতে পারছে, যাদের কাছে ইন্টারনেট নেই, যেখানে নেই সাক্ষরতা। পড়তে না-জানা একজন মানুষের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সহজে বোঝানোর উপায় তা দৃশ্যমান করা। বাংলাদেশের কমিকসশিল্পীরা এ রকম কাজও করছেন অনেক। আর এ ধরনের কাজের ফলে বহির্বিশ্বে আমাদের দেশীয় কমিকস নিয়ে আগ্রহ জাগতে শুরু করেছে।
তাই কমিকস নিয়ে মেহেদী হকের ভাবনাটাও বেশ যুগোপযোগী। বাংলাদেশের কার্টুনিস্ট বা কমিকসশিল্পীরা বেশির ভাগই নিজে নিজে শিখে কার্টুন আঁকছেন। এ বিষয়ের অ্যাকাডেমিক শিক্ষার কোনো ধাপ এখনো এ দেশে নেই। এখন অবশ্য অনেক কার্টুনিস্টরাই চারুকলার বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু একদম নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে কার্টুন-কমিকস কোথাও শেখানো হয় না। নিজের ছাত্রজীবনে হয়তো কখনো আফসোসটি করেছেন মেহেদী হক। তাই কার্টুন-কমিকস পড়ানো নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বোপরি সহায়তা করতে চান তিনি। যাঁরা, এখন যেসব কিশোর-তরুণেরা খাতার কোনায় কার্টুন আঁকছেন, পেশাদার কার্টুনিস্ট কিংবা কমিকসশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সুযোগ যেন থাকে, সেই পথেই হাঁটবেন এই কার্টুনিস্ট।
তার আগে নিজেরও বিষয়টির আদ্যোপান্ত জেনে নিতে হবে। তাই হাতে-কলমে কমিকসের খুঁটিনাটি শিখতে এ বছর জুনের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
বাংলাভাষী কমিকস চরিত্র বাটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদাদের মতো আরও দারুণ সব চরিত্র যেমন মৌলিক গল্পে প্রকাশ পাবে, বাংলাদেশি কমিকসকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপনের পথও কিছুটা সহজ হবে এই পড়াশোনার মাধ্যমে।