ডিঙিনৌকাটা নদীর মতো বড় খাল থেকে বাঁয়ে বাঁক নিল। ঢুকল সরু একটা খালে। খালের এক পাশে শাকসবজির খেত, কোথাও কলাবাগান। অন্য পাশটায় বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যে বসতবাড়ি। বাড়ির চারপাশে গাছ আর গাছ। খালের পাশ দিয়ে হাঁটাপথও এগিয়ে গেছে পাড় অনুসরণ করে। কোনো কোনো বাড়ির ছোট উঠান থেকে গাছের ডাল, হেলে পড়া বাঁশ খালের ওপর এসে পড়েছে। নৌকায় চলতে চলতে মনে হলো, হেলে পড়া গাছগুলো যেন প্রাকৃতিক শামিয়ানা!
কোলাহলমুখর কোনো ভিডিও ‘মিউট’ করলে আচমকা যেমন নৈঃশব্দ্য ভর করে, সরু খালে ঢুকতেই আচ্ছন্ন করল তেমনই এক প্রশান্তিময় আবহ। ট্রলার, ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভটভট আওয়াজ, উচ্ছ্বসিত পর্যটকদের উল্লাসধ্বনি আর সাউন্ড সিস্টেমের বাজনা এখন দূরের শব্দ। নানা জাতের পাখির কিচিরমিচির, কানের কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়া মৌমাছির ছোট্ট ডানার শব্দ, বইঠা থেকে নিংড়ে পড়া পানির টুপটাপ শব্দ আমাদের মন শীতল করে তুলল। প্রাণ জুড়িয়ে দিল রোদে পোড়া হেলেঞ্চা, কলমি আর খালপাড়ের লতাগুল্ম থেকে ভেসে আসা অচেনা গন্ধ।
আন্দাকুল গ্রামের ঘাট থেকে আমরা নৌকায় উঠেছি। গ্রামটা পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নে পড়েছে। গন্তব্য ঝালকাঠির ভীমরুলি বাজার। ভাসমান বাজারটার কথা অনেকের জানা। কৃষকেরা আনাজ-তরকারিসহ নানা পণ্য নৌকায় এনে এই বাজারে বিক্রি করেন। তবে ভীমরুলির মতো আরও অনেক বাজার আছে জলমগ্ন এই এলাকায়। এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পেয়ারা চাষ হয়। তাই বর্ষার সময় বাজারে বেশি দেখা যায় পেয়ারা। ক্রেতারা আসেন নৌকায়, বিক্রেতারাও। নৌকাই এখানকার মানুষের প্রধান বাহন। প্রতিটি বাড়িতেই এক বা একাধিক নৌকা আছে।
ভীমরুলি বাজার আমাদের গন্তব্য হলেও যাচ্ছি ঘোরা পথে। বেশির ভাগ পর্যটক বড় যে খাল ধরে জায়গাটায় যান, আমরা সে পথে যাইনি। অবশ্য এ জন্য কৃতিত্ব সত্তরোর্ধ্ব নারায়ণ হালদারের। তিনি আমাদের নৌকার মাঝি। বইঠা হাতে নিয়ে অনেকটা এভাবে তিনি বলেছেন, ‘ঘুরতে এসে যদি নিজেরা কথাই না বলতে পারলেন, পাখপাখালির গুঞ্জনই শুনতে না পারলেন, তাহলে লাভ কী!’
সত্যিই তো, ভ্রমণ মানে তো শুধু ‘সাইট সিইং’ আর ছবি তোলা নয়; ভ্রমণ মানে তো জায়গাটা সম্পর্কে জানা, মানুষ সম্পর্কে জানা, প্রাণভরে অনুভব করা। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, নিজেকে চেনা!
ওই একটা কথাতেই নারায়ণ হালদারকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর ব্যবহারে, কথায়। মনে হয়েছে প্রশিক্ষিত কোনো ট্যুরিস্ট গাইডের সঙ্গে আমরা ভ্রমণ করছি। প্রাণবন্ত বলেই ৭০ বছরের মানুষটাকে দেখে মনে হয় ৫০ বছরের বলবান পুরুষ। পেটানো শরীর। মুখে হাসি লেগেই থাকে। নৌকা বাইতে বাইতে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তাঁর গল্পে আবহ সংগীতের কাজ করছে। আমরা চারজন মাঝির গল্পের নীরব শ্রোতা।
নারায়ণ হালদার হঠাৎ বললেন, ‘এই তো পেয়ারাবাগান শুরু।’
নৌকায় আধশোয়া হয়ে ছিলাম। দৃষ্টি ছিল আকাশের দিকে। তাঁর কথায় ডানে ঘাড় ঘোরাই। পেয়ারাগাছের ডাল খালের মাঝবরাবর এসেছে। কাঁচা–পাকা পেয়ারার ভারে ডাল বাঁকা হয়ে আছে। টুক করে মাথায় লাগার মতো যখন অবস্থা, নারায়ণ হালদার তখনই গাছের ডাল শক্ত করে ধরে নৌকা থামালেন। দুলে উঠল নৌকা। আমরা অবশ্য ততক্ষণে নৌকানৃত্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। নারায়ণ হালদার গলুইয়ে বসেই কয়েকটা পেয়ারা পাড়লেন। টেনিস বলের মতো ছুড়ে মারলেন আমাদের দিকে। প্রত্যেকেই দক্ষতার সঙ্গে ক্যাচ ধরলাম।
পেয়ারা খেতে খেতে মুগ্ধ চোখে দেখি প্রকৃতির বিস্ময়। বিঘার পর বিঘা পেয়ারাবাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে ছোট নৌকা চলার মতো পথ। কোনো খেতে নৌকায় দাঁড়িয়েই কৃষকেরা পেয়ারা পাড়ছেন। কেউ করছেন বাগানের পরিচর্যা। নারীরাও এসেছেন কাজে। যাঁরা সকালে এসে পেয়ারা পেড়েছেন, তাঁরা ছুটছেন বাজারে। নৌকার পাটাতনে কাঁচা আর পাকা পেয়ারা।
নারায়ণ হালদার বললেন, এ গ্রামের নাম কাপড়কাঠি। আমরা অবশ্য এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। একই খাল, খালপাড়ে পেয়ারা আর আমড়াবাগান, আছে নানা জাতের গাছ—একই দৃশ্য। তাই বাস্তকাঠি, নবগ্রামসহ বেশ কয়েকটা গ্রাম যে পেছনে ফেলে এসেছি, কোনো ফারাক করতে পারি না।
তবে আলাদা করা গেল প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর। নৌকা ঢুকল বড় খালটায়। এখানে নদী, বড় খাল, সরু খাল, নালার মতো খালগুলোকে গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সন্ধ্যা নদী যদি হয় মূল গাছ, তাহলে বড় খালগুলো মোটা ডাল, সরু খালগুলো ছোট ডাল। নদী আর খালে খালে জড়িয়ে আছে পুরো এলাকা।
বড় খালে আসার পর আবার সেই কোলাহল ফিরে এসেছে। পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। ট্রলারের সংখ্যাও বেড়েছে। পাশ দিয়ে ট্রলার গেলে দুলতে থাকে আমাদের নৌকা। নারায়ণ হালদার দক্ষতার সঙ্গে বইঠা ধরে রাখেন। ভীমরুলি বাজারের কাছে আসতেই দেখি সারি সারি ডিঙিনৌকা। কৃষকেরা পেয়ারা নিয়ে চলছেন বাজারে। কারও কারও নৌকায় অন্য ফসলও আছে। নারায়ণ মাঝি সবার কুশল জিজ্ঞাসা করেন।
ভীমরুলি বাজার জমে উঠেছে। বড় বড় ট্রলার নিয়ে এসেছেন পাইকারেরা। ডিঙিনৌকা থেকে পেয়ারা তোলা হচ্ছে ট্রলারে। একদিকে দেখলাম ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কেসে ভরে ট্রাকেও তোলা হচ্ছে।
নৌকা থেকে নেমে পড়ি ‘বৌদির ভাসমান হোটেল’-এর সিঁড়িতে। কাঠের সিঁড়িটা খালের সঙ্গে মিশেছে। হোটেলের নাম ভাসমান হলেও কাঠামোটা কিন্তু ভেসে নেই। খালের ওপর খুঁটি পুঁতে হোটেলটা বানানো। কাঠের পাটাতনে চেয়ার-টেবিল পাতা। হোটেলে সকালের নাশতার পর্ব শেষ হয়েছে। দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি চলছে। আমরা তা-ই চায়ে চুমুক দিই। হোটেলের গা ঘেঁষে দূর গাঁয়ের নৌকা এসে ভেড়ে। পাইকার আর বিক্রেতার দর-কষাকষি চলে। একসময় পেয়ারা হাতবদল হয়। টাকা কোমরে গুঁজে বইঠা হাতে তুলে নেন কৃষক।
নারায়ণ মাঝিও বইঠা হাতে গলুইয়ে বসেছেন। হেলেদুলে তাঁর নৌকা আসে মাঝখালে। কায়দা করে ঘুরিয়ে নেন আসার পথে। তবে এবার আমরা আন্দাকুল ফিরব অন্য খালে ভেসে ভেসে।