অদম্য বাংলাদেশ

বিয়ে ঠেকাতে কি যুদ্ধটাই না করতে হয়েছিল সিরাত জাহানকে! ভাগ্যিস, সেদিন রংপুরের ফুটবল কোচ হারুন অর রশিদ বুঝিয়েছিলেন সিরাতের মাকে। প্রতিবেশীদের নেতিবাচক সমালোচনা সইতে না–পারা মা শেষ পর্যন্ত সিরাতকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাননি। প্রিয় হারুন স্যারের সহযোগিতায় সিরাতও যেন নতুন জীবন পেয়ে ফুটবল মাঠে ফিরে যান। নেপালে সদ্য শেষ হওয়া মেয়েদের সাফে যখন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলেন সিরাত, মা তো খুশিতে আত্মহারা। রংপুরের পালিচড়া গ্রামের এই ফুটবল–কন্যা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন আগেই। গত ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রথমবার জিতেছে সাফের শিরোপা। সিরাত সেই দলেরই গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার।

কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে বসেই কল্পনা করে নেওয়া যাচ্ছিল দৃশ্যটা। সাফে চ্যাম্পিয়ন হলে মেয়েরা কীভাবে উদ্‌যাপন করবে, সেটা এক দিন আগেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে দিয়ে জানিয়েছিলেন সানজিদা আক্তার। ছাদখোলা বাসে সাবিনা খাতুনের হাতে ধরা চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, গলায় থাকবে ফুলের মালা। রাস্তার দুই পাশের গিজগিজে ভিড়ে দাঁড়ানো অযুত মানুষের ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল ভবনে আসবে মেয়েরা—সব স্বপ্নই যেন সত্যি হয়েছে সিরাত জাহান, সাবিনা খাতুনদের।

সাদাচোখে দেখলে মনে হবে, শুধুই পাঁচটা ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই ট্রফির পেছনে যে কত পরিশ্রম, কত সংগ্রাম আর লড়াইয়ের গল্প লেখা, তা শুধু মেয়েরাই জানেন। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর সাধারণ ঘরের সব মেয়ে লিখেছেন অসাধারণ এক মহাকাব্য।

ম্যাচের আগে বাংলাদেশ দল

স্ট্রাইকার শামছুন্নাহার জুনিয়রের কথায় ধরা যাক। ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে যখন ১৩ মিনিটেই চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাইকার সিরাত, কোচ তখনই মাঠে নামান শামছুন্নাহারকে। আর নেমেই সুপার সাব শামছুন্নাহার ক্লিনিক্যাল ফিনিশিংয়ে গোল করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেন। যে গোলটাই হয়ে রইল পুরো ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।

এই শামছুন্নাহার শুধু আনন্দ পেতেই একসময় ফুটবল খেলতেন। রক্ষণশীল বাবা যখন ফুটবল খেলার জন্য বকতেন, লুকিয়ে মা তাঁকে অনুশীলনে পাঠাতেন। শামছুন্নাহারের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। সেখান থেকে ধোবাউড়া গিয়ে ফুটবলে অনুশীলন করতেন শামছুন্নাহার। অনেক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে যেত। শামছুন্নাহারদের এলাকায় বিদ্যুৎ আসেনি তখনো। অন্ধকারে রাস্তায় কুপি জ্বালিয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতেন শামছুন্নাহারের মা। তখন সবে বঙ্গমাতা ফুটবলে আলো কাড়তে শুরু করেছেন শামছুন্নাহার। ২০১৪ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে জেতেন গোল্ডেন বুট। পরের বছর জেতেন সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি। প্রথম বছর গোল্ডেন বুট জিতে পুরস্কার হিসেবে শামছুন্নাহার পেয়েছিলেন ৫ হাজার টাকা। শামছুন্নাহারের মা ওই সময় সবাইকে বলতেন, আমার মেয়ে ফুটবল খেলে প্রথমবার টাকা পেয়েছে। অথচ ওই বছরই অর্থের অভাবে জ্বরের চিকিৎসা করাতে পারেননি শামছুন্নাহার। জ্বরে ভুগে মারা যান তাঁর মা। শামছুন্নাহারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন টাকা আছে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলে মানুষের মন জয় করেছেন এরই মধ্যে। কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও মাকে ভুলতে পারেন না।

জয়ের পর একটা সেলফি না তুললে হয়?
ছবি: সানজিদার ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের মাঝমাঠের আস্থার প্রতীক মারিয়া মান্দা। ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত গ্রাম মন্দিরগোনা থেকে উঠে আসা মারিয়া দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ এই মারিয়ার বুট কেনার টাকাই ছিল না। দুর্দিনের জন্য জমিয়ে রাখা চাল বিক্রি করে বুট কিনে দেন মা এনতা মান্দা।

২০১১ সালের বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আবিষ্কার মারিয়া। ছোটবেলা থেকেই মাঠে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করেছেন মারিয়া। মাঠের বাইরেও লড়েছেন জীবনের সঙ্গে। মারিয়া যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন তখন তাঁর বাবা মারা যান। এরপর মা এনতা মান্দা চার ভাইবোনকে নিয়ে লড়াই শুরু করেন। মারিয়ার মা ধানের মৌসুমে ধান লাগাতেন। মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করতেন। এ জন্য দিনে পেতেন ২০০ টাকার পারিশ্রমিক। কিন্তু ফুটবল দিয়েই এখন মারিয়ার জীবনটা পুরোপুরি বদলে গেছে।

বাংলাদেশ দলের নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার আঁখি খাতুনের বাবা সিরাজগঞ্জের পারকোলা গ্রামে একসময় তাঁতশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। নিজেদের মেশিন ছিল না। অন্যের মেশিনে তাঁত বুনে সংসার চলত আঁখিদের। অসুস্থ মাকে ঘরে রেখে ফুটবলের অনুশীলনে যেতেন আঁখি। প্রতিবেশীদের বললেও কখনো কেউ সাহায্য করেনি। বরং অনুশীলন শেষে ঘরে ফিরে দেখেছেন অসুস্থ মা মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সাফে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আনন্দেই যেন অর্ধেক অসুখ ভালো হয়ে গেছে আঁখির মায়ের।

সবচেয়ে লম্বা খেলোয়াড় আঁখির উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। উচ্চতার কারণেই পুরো দলের মধ্যে আলাদা করে নজর পড়ে আঁখির ওপর।

সিরাজগঞ্জের ফুটবলার আঁখি খেলেন ডিফেন্ডার হিসেবে। গোল ঠেকানোই তাঁর আসল কাজ। কিন্তু নিজের দায়িত্বের পাশাপাশি ওভারল্যাপ করে যেভাবে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে আতঙ্ক ছড়ান সেটা অবিশ্বাস্য। কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে হেডে গোল করায় জুড়ি নেই তাঁর। রক্ষণ থেকে আঁখির নেওয়া লং বলগুলোও বেশ কার্যকর হয়ে থাকে।

আনন্দে কোচকে শূণ্যে ছুড়ে উঠসবে মেতে উঠেছিল বাংলাদেশ দলের সদস্যরা

বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের আবিষ্কার আঁখি। ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ইব্রাহিম পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে খেলেন বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে। নজরকাড়া পারফরম্যান্স দিয়ে পরের বছরই জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পান। ওই বছরই সুযোগ পেয়ে যান বিকেএসপিতে। বর্তমানে বিকেএসপির উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী আঁখি ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলে খেলেন প্রথমবার। ২০১৭ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন আঁখি।

স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী সরকারের বাবা বাসুদেব সরকার একসময় দরজির কাজ করতেন। তবে মেয়ের ফুটবল খেলার সুবাদে সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়ের ফুটবল থেকে উপার্জিত টাকায় চলে কৃষ্ণাদের সংসার। বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের অন্যতম ভরসা কৃষ্ণা উঠে এসেছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রাম থেকে। সদ্য শেষ হওয়া মেয়েদের সাফে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করায় বড় অবদান কৃষ্ণার। ৫ ম্যাচে করেছেন টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ গোল। ফুটবলে কৃষ্ণার হাতেখড়ি ২০১১ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে। সেবার খেলেছিলেন সুতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের হয়ে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে স্নাতকে পড়ুয়া কৃষ্ণা একসময় সারাক্ষণ কাকাতো ভাইদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। একবার তো মা রাগ করে বল কেটে কুচি কুচি করেছিলেন। কিন্তু তারপরও ফুটবলের প্রতি এতটুকু ভালোবাসা কমেনি কৃষ্ণার। অসাধারণ পারফরম্যান্সের সুবাদে ২০১৬ সালে রূপচাঁদা–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হন কৃষ্ণা। ফুটবল দিয়ে বদলে গেছে কৃষ্ণাদের পরিবারের চেহারা। মাটির ঘর ভেঙে উঠেছে পাকা বাড়ি। নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলকেও বদলে দিতে চান কৃষ্ণা।

চ্যাম্পিয়ন দলের আরেক ফুটবলার মাসুরা পারভীনের বাবা একসময় সাতক্ষীরা শহরে ভ্যানে ফেরি করে সবজি বিক্রি করতেন। এখনো ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। মেয়েকে খেলাধুলায় পাঠাতে কোনো আপত্তি ছিল না মাসুরার বাবার। তাই খেলাপাগল মাসুরা হ্যান্ডবল, কাবাডি, অ্যাথলেটিকস ও ভলিবলে ছিলেন একসময়ের পরিচিত মুখ। ২০১৬ এসএ গেমসে রুপাজয়ী কাবাডি দলের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। কিন্তু বাফুফের নির্দেশনা মেনে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছেড়ে বেছে নেন ফুটবলকে। ময়মনসিংহ ভাষাশহীদ শামসুল হক কলেজের উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া মাসুরা এবারের সাফে বাংলাদেশের রক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিলেন চীনের দেয়ালের মতোই।

সাতক্ষীরার প্রয়াত ফুটবল কোচ আকবর আলীর হাত ধরে ফুটবলে আসা মাসুরার। ২০১০ সালে সাতক্ষীরার কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন কারিমা। ওই বছর কেএফসি নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে নজর কাড়েন প্রথম। এরপর ২০১৩ সালে খেলেন প্ল্যান অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় নারী চ্যাম্পিয়নশিপে। বাফুফের তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিভা অন্বেষণের এই টুর্নামেন্টে কোচ গোলাম রব্বানী তাঁকে বাছাই করেন। তবে ২০১৪ সালে প্রথম খেলেন জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে।

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের মেয়ে সানজিদা আক্তার ফুটবল খেলুক, তা চাইতেন না তাঁর দাদা। ফুটবল খেললে নাতনিকে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে, তাই তো আপত্তি ছিল দাদার। শেষ পর্যন্ত কলসিন্দুর স্কুলের ওই সময়ের শিক্ষক মফিজ উদ্দিন বুঝিয়ে–সুঝিয়ে খেলার মাঠে এনেছিলেন সানজিদাকে। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ক্যারিয়ার শুরু সানজিদার। এরপর ২০১৪ সালে বয়সভিত্তিক জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৪ দলে সুযোগ পান। এরপর একে একে খেলেছেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬, অলিম্পিক বাছাই, এশিয়ান কাপ, এসএ গেমস, বয়সভিত্তিক সাফ ও জাতীয় দলে।

বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পেয়ে বল রিসিভ, মুভ, পাসিং, ড্রিবলিং দিয়ে মুগ্ধ করেন কোচকে। শুরু থেকেই মাঠে নিখুঁত পাসের জন্য কোচের প্রিয় ফুটবলার হয়ে ওনে সানজিদা।

সানজিদাকে বলা হয় মেয়েদের ফুটবলের পোস্টার গার্ল। এবারে সাফের ফাইনালের আগে হৃদয়ছোঁয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেন।

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের মেয়ে তহুরা খাতুনকে ফুটবল খেলতে দিতে চাইতেন না তাঁর দাদা ও দুলাভাই। শেষ পর্যন্ত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তহুরার বাড়িতে যান স্কুলের কোচ মফিজ উদ্দিন। পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে–সুঝিয়ে রাজি করান। বয়সভিত্তিক ফুটবলে একসময় মাঠে নামলেই নিয়মিত হ্যাটট্রিক পেতেন তহুরা। জাতীয় দলে অবশ্য কৃষ্ণা, সাবিনাদের কারণে একাদশে সুযোগ মেলে না। তবে বদলি নেমেও এবার সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে করেছেন ১ গোল।

কলসিন্দুর সরকারি কলেজের ছাত্রী তহুরা ছেলেদের মতো চুলের ছাঁট দেন। এখনো বাফুফের ক্যাম্প থেকে এলাকায় গেলে ছেলেদের সঙ্গে মারবেল খেলেন। এমনকি সাইকেল চালানো, মাছ ধরা, পাখি শিকার, বাবার সঙ্গে মাঠে ধান লাগানোতেও জুড়ি মেলা ভার তহুরার। মাঠের বাইরের এমন প্রাণোচ্ছল তহুরা বল পেলেই যেন ভয়ংকর হয়ে ওঠেন ডি-বক্সে। প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে মেতে ওঠেন উল্লাসে।

মিডফিল্ডার মণিকা চাকমার বাবা বিন্দু কুমার কখনোই চাইতেন না মেয়ে ফুটবল খেলুক। কিন্তু বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন মণিকা। বড় বোন অনিকা চাকমাও সঙ্গী হতেন মণিকার। কিন্তু দিন বদলেছে মণিকার। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে স্নাতকে পড়ুয়া সেই মণিকার নামেই যেন জেগে ওঠে রাঙামাটি।

মণিকার বাড়ি খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম সুমন্তপাড়া গ্রামে। কিন্তু মণিকার বেড়ে ওঠা রাঙামাটির কাউখালি উপজেলার ঘাগড়াতে। ২০১০ সালে প্রথম লক্ষ্মীছড়ির মরাচেঙ্গী সরকারি স্কুলের হয়ে খেলেন বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে। এরপর ২০১২ সালে চট্টগ্রামে বিভাগীয় পর্যায়ে খেলতে আসেন মণিকা। রাঙামাটি মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীর সেন চাকমার নজরে পড়েন তিনি। মণিকাকে ভর্তি করে নেন মগাছড়ি স্কুলে। ২০১৩ সালে মগাছড়ি স্কুল বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়। ২০১৪ সালে রাঙামাটিতে অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলে বাছাই হয়েছিল বাফুফের। ওই বাছাইয়ে টিকে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পান। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

রাঙামাটির মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমার বাবা ব্রজবাসী চাকমা চাইতেন মেয়ে বড় ফুটবলার হবেন। অভাবের সংসারেও মেয়ের অনুশীলনের জন্য যাতায়াতের খরচ দিতেন। কিন্তু ২০১৫ সালে ক্যানসারে ভুগে মারা যান বাবা। বিকেএসপির উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী ঋতুপর্ণার একমাত্র ভাই পার্বণ চাকমাও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন গত জুন মাসে। এখন ফুটবল দিয়েই যেন সব দুঃখ ভুলতে চান ঋতুপর্ণা।

গত বছর ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করেছিলেন অসাধারণ জোড়া গোল। এবারের সাফেও বদলি হিসেবে নেমে পাকিস্তান ও ভুটানের বিপক্ষে করেছেন ১টি করে গোল।

কলসিন্দুর স্কুলের আর আট–দশটা মেয়ের মতো ফুটবল খেলার শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন শামছুন্নাহার। বাবা-মা তো চাইতেনই না, প্রতিবেশীরাও চাইত না যে মেয়েরা ফুটবল খেলুক। বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে স্কুলে যেতেন শামছুন্নাহার। স্কুলের ড্রেসগুলো পরে জার্সি আর বুট জোড়া লুকিয়ে রাখতেন ব্যাগে। গ্রামের মানুষের সামনে ভয়ে যেতেন না। এড়িয়ে এড়িয়ে চলতেন। সেই শামছুন্নাহারই এখন রানীপুর গ্রামের ফুটবলের রানী।

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের আট–দশটা মেয়ের মতোই বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে সবার নজর কাড়েন শিউলি আজিম। মেয়ে ফুটবল খেলবে, এ নিয়ে মায়ের আপত্তি ছিল অনেক। আপত্তি ছিল প্রতিবেশীদেরও। কিন্তু বাবার উৎসাহে শেষ পর্যন্ত ফুটবলার হয়েছেন শিউলি। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকপড়ুয়া শিউলি ২০১৫ সালে নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে প্রথমবার জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

রাইটব্যাকে খেলা শিউলি বর্তমান জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানীর পছন্দের তালিকায়ও থাকেন সবার আগে। তাই নেপালে অনুষ্ঠিত মেয়েদের সাফে প্রতিটি ম্যাচেই একাদশে ছিলেন শিউলি। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ পাঁচ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে দিয়েছে ২৩ গোল। বিপরীতে বাংলাদেশের জালে জড়িয়েছে মাত্র ১টি গোল। বাংলাদেশের এমন জমাট রক্ষণের অন্যতম সৈনিক শিউলি।

বাংলাদেশের জালে গোল না খাওয়ার পেছনে আরেক কারিগর গোলরক্ষক রুপনা চাকমা। এবারের সাফের পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেছেন রাঙামাটির এই ফুটবলার। কখনো ফিস্ট করে, কখনো জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফিয়ে বল লুফে নিয়েছেন। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো রুপনা জিতে নিয়েছেন সাফে সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার। ২০১৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশের গোলপোস্টের নিয়মিত মুখ রুপনার বাবা নেই। মা কালাসোনা চাকমা তাঁকে ফুটবল খেলতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। শুরুতে স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও স্থানীয় কোচ শান্তিমনি চাকমার পরামর্শে গোলকিপার হয়েছেন। পারফরম্যান্স দিয়েই এখন জাতীয় দলের এক নম্বর গোলরক্ষক রুপনা।

চ্যাম্পিয়নদের স্বাগত জানাতে ছুটে গিয়েছিল উৎফুল্ল মানুষ।
ছবি: শামসুল হক

এবারের সাফ যেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুনকে রাঙিয়ে দেওয়ার এক টুর্নামেন্ট। পাকিস্তান ও ভুটানের বিপক্ষে করেছেন হ্যাটট্রিক। টুর্নামেন্টে পাঁচ ম্যাচে তিনটিতে হয়েছেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়। ৮ গোল করে জিতেছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার। সাফের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও উঠেছে সাবিনার হাতে। জাতীয় দলের জার্সিতেও সাবিনার ধারেকাছে কেউ নেই। শুধু সাফেই করেছেন ২২ গোল। সব মিলিয়ে ৪৮ ম্যাচে সাবিনার গোল ৩২টি।

এই সাবিনার উত্থান রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। পাঁচ বোনের তিনি চতুর্থ। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু মেয়েকে পড়ানোর খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না প্রয়াত বাবা সৈয়দ গাজীর। ডানপিটে সাবিনা স্কুলে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। সাতক্ষীরার আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে নবারুণ উচ্চবিদ্যালয়কে একাই টেনে নিয়ে যেতেন। সেখানেই নজর পড়ে জেলা ফুটবল দলের কোচ আকবর আলীর। সাবিনার মুভমেন্ট, পাসিং, ড্রিবলিং মুগ্ধ করেছিল প্রয়াত এই কোচের। তিনি প্রথমে ২০০৯ সালে সাবিনাকে ঢাকায় আনেন। সেবার সাবিনা খেলেন সিটিসেল জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে। প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার তো পেলেনই বোনাস হিসেবে পরের বছর এসএ গেমসেও ডাক পেলেন সাবিনা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১০ সালের পর থেকে টানা খেলছেন জাতীয় দলে। আট বছর ধরে অধিনায়ক সাবিনা।

মেয়েদের ফুটবলে অনেক প্রথমের সঙ্গেই জড়িয়ে সাবিনার নাম। শুধু বাকি ছিল সাফের শিরোপা জেতা। স্বপ্নের ট্রফি শেষ পর্যন্ত মাথার ওপর তুলে ধরে সাবিনা দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

ছবি কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন