ভূমিকম্পের সময় ঘরে থাকব, না বেরিয়ে আসব?
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২ ডিসেম্বর, শনিবার সকালে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। ভূমিকম্প–আতঙ্কে আবাসিক হলের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে মাস্টারদা সূর্য সেন হলের ২৩৩ নম্বর কক্ষের জানালা দিয়ে লাফ দেন তিনি।
অন্যদিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে তাড়াহুড়া করে কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। কুমিল্লার ছুপুয়া এলাকায় আমির শার্ট নামের একটি পোশাক কারখানায় এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আহত রোগী, প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্পের সময় ওই পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা আতঙ্কিত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে ও ওপর থেকে লাফ দিয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ সময় কারখানার গেট বন্ধ থাকার কারণে কেউ বেরিয়ে আসতে পারেননি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
যেকোনো ভূমিকম্পের পর এমন খবর পাওয়া যায়। আতঙ্কিত হয়ে বিভিন্ন ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে হুড়োহুড়িতে বহু লোক আহত হন। শত শত মানুষ বাসাবাড়ি ও কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। অনেককেই বহুতল ভবনের ছাদে উঠতে দেখা যায়।
ভূমিকম্পের সময় এই কাজগুলো করা পুরোপুরি ভুল। এতে প্রাণহানির আশঙ্কা বাড়ে। আহত হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে। ভূমিকম্প হলে ঠিক কী করতে হবে, জানা নেই অনেকেরই।
ভূমিকম্প চলার সময় আতঙ্কিত হয়ে কোনোভাবেই রাস্তায় নামা যাবে না। যে যেখানে আছে, সেখানেই শক্ত কোনো কিছুর নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের কলাম কিংবা বিমের সংযোগস্থলে টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ওপরতলা থেকে লাফ দেওয়া, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামার চেষ্টা করা, লিফটে নামার চেষ্টা করা, ছাদে চলে যাওয়া—কোনোটিই করা যাবে না। এর কোনোটি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এমনকি সবার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপডেট দেওয়ার প্রতিযোগিতা করাও বোকামি। এর বদলে প্রথমে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। ভূমিকম্প ও এর রেশ কেটে গেলে বন্ধু ও আত্মীয়দের খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বন্ধুরা ঝাঁকুনি টের পেয়েছেন কি পাননি, তার চেয়ে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
বড় ভূমিকম্প হলে অবকাঠামো টিকবে না। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভবনের কাঠামো টিকে যাবে। শক্ত বিমের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে মাথা কিংবা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হয়তো রক্ষা পাবে। পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকর্মীরা এসে উদ্ধারকাজ চালাতে পারবেন।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো এশিয়ান ও ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কার কারণে ঘটছে। এতে ভূ-অভ্যন্তরে চাপ জমা হচ্ছে। চাপ জমতে জমতে একসময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির ওয়েবসাইটে ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে একটি তালিকা দেওয়া আছে। অন্যরাও এই তালিকা অনুযায়ী পরামর্শ দিয়ে থাকে। এই নির্দেশনা ক্যালিফোর্নিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
ভূমিকম্পের সময়ে যা করতে হবে
ভূমিকম্পের সময় বাসা বা অন্য কোনো ভবনের ভেতরে থাকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে না
ড্রপ-কভার-হোল্ড ‘ড্রপ-কভার-হোল্ড অন’ পদ্ধতি হলো ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়া (ড্রপ)। টেবিল, বিছানা বা আসবাবপত্রের মতো মজবুত কোনো কিছুর নিচে আশ্রয় নেওয়া (কভার)। আসবাবটির কোনো অংশ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করা (হোল্ড অন)।অন পদ্ধতিতে মজবুত কোনো কিছুর নিচে সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় নাও। যদি মজবুত কোনো কিছু পাশে না থাকে, তবে মাথা ও মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে ঘরের ভেতরের দিকে কোনো দেয়ালের কোণে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ো। জানালা অথবা ভবনের বাইরের দেয়ালের কাছে থাকবে না। উঁচু ও ভারী আসবাব যেমন আলমারি, বইয়ের তাক ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে।
বিছানায় শোয়া অবস্থায় থাকলে মুহূর্তের মধ্যে ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন অবস্থানে যাওয়া সম্ভব না হলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকতে হবে। বিছানার ওপরে সিলিং ফ্যান থাকলে বিছানা থেকে অবশ্যই নেমে পড়তে হবে।
ভূকম্পন পুরোপুরি থেমে না যাওয়া পর্যন্ত ঘরের ভেতর নিরাপদ জায়গায় বসে থাকতে হবে। ঘরের ভেতরে হাঁটাচলা করা যাবে না।
ভূমিকম্পের সময় নিজ অবস্থান থেকে ১০ ফুট দূরত্বে সরে গেলেও হতাহত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই নিজ অবস্থান থেকে যথাসম্ভব কম দূরত্বের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় নেওয়া উচিত।
ভূমিকম্পের সময় ঘরের বাইরে থাকলে ঘরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে না।
ভূমিকম্পের সময় ভবনের বাইরের দেয়াল খুব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। যথাসম্ভব খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। রাস্তার বৈদ্যুতিক তার বা ল্যাম্পপোস্ট থেকে দূরে থাকতে হবে।
ভূমিকম্প শেষ হলে নিজ অবস্থানে অপেক্ষা করতে হবে। আফটার শক শেষ হয়েছে নিশ্চিত হলে ধীরেসুস্থে ভবন থেকে বের হয়ে আসতে পারো। তবে এ সময়ও লিফট ব্যবহার করবে না।
‘ড্রপ-কভার-হোল্ড অন’ পদ্ধতি হলো ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়া (ড্রপ)। টেবিল, বিছানা বা আসবাবপত্রের মতো মজবুত কোনো কিছুর নিচে আশ্রয় নেওয়া (কভার)। আসবাবটির কোনো অংশ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করা (হোল্ড অন)।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে বড় ভূমিকম্পে ভবনধসে আটকা পড়লেও বেঁচে যাওয়ার আশা রয়েছে। ভবনধসে আটকা পড়লে এবং তখন আগুন জ্বালানোর মতো সুযোগ থাকলেও তা করা যাবে না। বাড়িতে গ্যাসের লাইন লিক হয়ে থাকলে এতে বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ধুলাবালির মধ্যে পড়লে কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নিতে হবে। নড়াচড়া না করে অপেক্ষা করতে হবে। আশা হারানো যাবে না। অপেক্ষা করলে উদ্ধারকারী কেউ না কেউ আসবেই।