নিঃসঙ্গতার তিন শ আটাত্তর দিন

‘অবশেষে’, রস ব্রকওয়েল হাসলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়েছে তাঁর। আপন মনে বললেন, ‘অপেক্ষার অবসান হলো শেষমেশ।’

এতটুকু পড়ার পর তোমাদের মনে কি কোনো প্রশ্ন জাগল? আমাকে একটু অনুমান করতে দাও। উত্তর হলো হ্যাঁ, হ্যাঁ। দুটো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছ তোমরা। তাই দুবার হ্যাঁ। এক, বিজ্ঞপ্তিতে কী লেখা? দুই, ব্রকওয়েল কি তৈরি হয়েই ছিলেন?

‘স্পেস স্টেশন, রকেটের মতো জিনিসপত্র ডিজাইন করার স্বপ্ন ছিল আমার। আবার মনে হচ্ছিল লোকালয় নির্মাণের ব্যাপারটা একদিন স্পেস প্রোগ্রামের অংশ হবে। তাই তরুণ বয়সে নগর-পরিকল্পনা ও অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম ক্যালটেকে।’ ব্রকওয়েলের জবানবন্দি জানান দেয়, কতটা দূরদর্শী ছিলেন তিনি। কারণ, এত বছর পর নাসাও ভাবছে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের কথা। কেমন হতে পারে সে এলাকা? সীমিত সম্পদ নিয়ে সেখানে থাকতে গেলে বাসিন্দাদের ঠিক কী ধরনের বিপদ হওয়ার আশঙ্কা আছে? পৃথিবী থেকে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকায় বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্যেই বা কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কবীর সুমনের গান—‘প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা’। সমাধান পেয়ে যায় নাসাও—মঙ্গলের এলাকার ট্রায়াল হয়ে যাক পৃথিবীতেই।

তাই শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়। থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মাণ করা হলো ১ হাজার ৭০০ বর্গফুটের ঘর। নাম দেওয়া হলো ‘মার্স ডুন আলফা’। বসবাসের জন্য স্বেচ্ছাসেবী ক্রু নির্বাচনের পালা এরপর। পরীক্ষা নেওয়া হবে সে জন্য। আগ্রহী ব্যক্তিদের আহ্বান জানিয়ে নাসার তরফ থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো।

সেই বিজ্ঞপ্তি দেখে আনন্দিত হলেন ব্রকওয়েল। পরীক্ষায় অংশ নিতে তিনি যখন রওনা হচ্ছেন, তখন বেরিয়ে পড়েছেন আরও অগণিত উৎসাহী। তাঁদের মধ্যে দুজনের কথা বলি। প্রথম জন শারীরতত্ত্ববিদ নাথান জোনস। অন্যজন কেলি হ্যাটসন। পেশায় তিনি জীববিজ্ঞানী। সবার গন্তব্য জনসন স্পেস সেন্টার। ‘মার্স ডুন আলফা’ সেখানেই রাখা। তাঁরা যতক্ষণ না পৌঁছাচ্ছেন, ততক্ষণে চলো এর অন্দরমহল থেকে ঘুরে আসা যাক।

নানান ধাপ পেরিয়ে নির্বাচিত হলেন চারজন—রস ব্রকওয়েল, নাথান জোনস, কেলি হ্যাটসন ও অ্যালিসা শ্যানন

স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য ব্যক্তিগত কোয়ার্টার, দুটি বাথরুম, ওয়ার্কস্টেশন, মেডিকেল স্টেশন, কমন লাউঞ্জ আছে সেখানে। সিমুলেটেড স্পেসওয়াক, বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি চালানো হবে খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমও। তাই বাড়তি একটা স্টেশনও রয়েছে মার্স ডুন আলফায়। এত কিছু থাকলেও থাকার ব্যাপারটা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে না। কারণ, বসবাসের সময় দেখা দিতে পারে কারিগরি ত্রুটি। আর তা তৈরি করা হবে বাইরে থেকে, ইচ্ছাকৃতভাবে। এই যেমন পানির স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মঙ্গল গ্রহে তো আর নিরবচ্ছিন্নভাবে সবকিছুর জোগান পাওয়া সম্ভব নয়। তাই স্বেচ্ছাসেবীদের পৃথিবীতেই সে রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হবে। সেসব তাঁরা কীভাবে সামলাচ্ছেন, মনোজগতে কেমন ছাপ পড়ছে, তা পর্যবেক্ষণ করবে নাসা।

সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে থাকতে হবে টানা ৩৭৮ দিন। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে স্বেচ্ছাসেবীরা এর আগে বের হতে পারবেন না। তা ছাড়া ধরো, মার্স ডুন আলফা থেকে বাইরে কোনো বার্তা পাঠানো হলো; সেটি কিন্তু নাসার লোকজন সঙ্গে সঙ্গে পাবে না। বিশ মিনিট লাগবে। আবার, নাসার প্রত্যুত্তর স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে পৌঁছাবে আরও বিশ মিনিট পর। কারণ, দুই গ্রহের অবস্থান। মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সময় ব্যবধান চল্লিশ মিনিটের। সেটির চর্চা করা হবে এখানেও। পরিবারে ঘটা কোনো সমস্যার কথা তাই তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারবেন না। সব মিলিয়ে আত্মত্যাগের বিরাট আয়োজন।

এসব মাথায় রেখেই আগ্রহী ব্যক্তিরা পরীক্ষায় অংশ নিলেন। নানান ধাপ পেরিয়ে নির্বাচিত হলেন চারজন—রস ব্রকওয়েল, নাথান জোনস, কেলি হ্যাটসন ও অ্যালিসা শ্যানন। বিকল্প হিসেবে রাখা হলো আনকা সেলারিউ ও ট্রেভর ক্লার্ককে। গত ২৫ জুন শুরু হয়েছে তাঁদের নিঃসঙ্গতার ৩৭৮ দিন। অ্যালিসা যেতে না পারায় তাঁর জায়গায় যোগ দিয়েছেন সেলারিউ। প্রতিকূলতার আশঙ্কাকে পাত্তা না দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি, ‘প্রত্যেক দিন ঘুম ভাঙার পর আমার একটাই ইচ্ছা কাজ করত, যদি কোনোভাবে মানবজাতির জন্য, পৃথিবীর জন্য এবং এই মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রাণের কল্যাণের জন্য কিছু করতে পারতাম! সুযোগটা পেলাম অবশেষে।’

নাসার এই প্রচেষ্টা সবে শুরু হলো। চলবে ২০২৫, ২০২৬ সালেও। পুরো প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে Crew Health and Performance Exploration Analog (CHAPEA)। বলা বাহুল্য, এই আয়োজন সফল হলে খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।