নাসার প্রধান নভোচারীর সঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নময় কিছুক্ষণ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উপচে পড়া ভীড়। নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা বাংলাদেশে এসেছেন। আজ তিনি এখানে বক্তৃতা দেবেন। এত পড়া ভীড় সে জন্যই। সবাই তাঁর কথা শুনতে চান, তাঁকে দেখতে চান।
ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছোঁয়ার আগেই অবশ্য প্রতীক্ষার অবসান হলো। নাসার প্রধান নভোচারী ঢুকে পড়লেন। নভোচারীদের পোশাক পরেই এসেছেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের স্কুল অব ডাটা অ্যান্ড সায়েন্সেসের ডিন অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার এবং একই বিভাগের অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমানসহ আরও অনেকে।
জোসেফ এম আকাবা একজন হাইড্রোজিওলজিস্ট। এককালে শিক্ষকতা করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে। প্রথম পুয়ের্তোরিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হিসেবে ২০০৪ সালের মে মাসে নাসার নভোচারী প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। ২০২৩ সালে তাঁকে নাসার নভোচারী কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সেই মানুষটি এখন সামনে দাঁড়িয়ে। দর্শকসারি থেকে উল্লাস শোনা গেল। আকাবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তার জবাব দিলেন। সবার প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিজ্জা খেতে পছন্দ করে কারা?’
অনেকেই হাত তুলল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘আমরা এখানে মজা করব। কিন্তু স্যাররা যেহেতু আছেন, তাঁদের দেখাতে হবে তো যে পড়াশোনা করছি!’ এই বলেই একটা ভিডিও ছেড়ে দিলেন। অডিটোরিয়ামের বিশাল স্ক্রিনে দেখা গেল, নভোচারীরা নানারকম পিজ্জা বানাচ্ছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভাসছে পিজ্জা!
সবাই হাসছে। এর মধ্যেই মাইক্রোগ্র্যাভিটি এবং ওজনহীনতার কথা বললেন তিনি। ছয় মিনিটের একটি ভিডিওতে দেখালেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাঁর সর্বশেষ মিশনের কিছু মুহূর্ত। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয় মিশনটি। শেষ হয় ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ৬ মাসের এ মিশনের মজার অভিজ্ঞতা দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। এরকম তিনটি মহাকাশ মিশনে অংশ নিয়েছেন তিনি। মহাকাশে কাটিয়েছেন ৩০৬ দিন।
যে চারটি ভুল আমি করেছি। জানা গেল, তাঁর এককালে মেটাল শপ ছিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মেরিন কর্পসে। তারপর চলে গেলেন শান্তি মিশনে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। এরপর ফিরে এসে নিলেন শিক্ষকের চাকরি। কেন এগুলো ভুল ছিল, বললেন সে কথাও—স্বেচ্ছাসেবী কাজে একদমই পয়সা নেই, আর শিক্ষকের চাকরিতেও অর্থ তুলনামূলক কম।
ভিডিওর পরে প্রশ্নোত্তরের সুযোগ দেওয়া হলো। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করছেন। প্রচণ্ড কৌতূহল তাঁদের। কার্বন ক্যাপচার নিয়ে কঠিন একটি প্রশ্ন করলেন একজন। আকাবা হাত তুলে বললেন, ‘আরে আরে, এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর তো আমি পারি না!’
পরের প্রশ্নটিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গলতরী প্রকল্পের এক শিক্ষার্থী জানতে চাইলেন, ‘নভোচারীদের স্পেসস্যুটের কব্জিতে আয়না লাগানো থাকে কেন?’ আকাবা হেসে, মজা করে বললেন, ‘এই প্রশ্নটার উত্তর আমি জানি!’ ব্যাখ্যা করে বললেন, নভোচারীরা এক হাত দিয়ে স্যুটের কন্ট্রোল প্যানেল ঠিকঠাক করেন। তখন অন্য হাতের কব্জির আয়নায় তাকিয়ে সহজেই বুঝতে পারেন, এই হাতে কী করছেন। এ জন্য কন্ট্রোল প্যানেলের লেখাগুলো উল্টো করে লেখা হয়, আয়নায় সেটা সোজা দেখা যায়।
এমন নানা প্রশ্নে, হাসি-মজায় সময় কেটে গেল। প্রশ্ন তবু শেষ হয় না। এক শিক্ষার্থী হাত তুলেছিলেন, আকাবা জানালেন, এটাই সেই প্রশ্ন। সেই শিক্ষার্থীকে বললেন, ‘এখন তোমার ওপর অনেক চাপ! প্রশ্ন ঠিকঠাক করে করো!’ প্রশ্নটা যথার্থই ছিল। ‘কীভাবে নভোচারী হলেন আপনি?’
জবাবে রীতিমতো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন খুলে ধরলেন নাসার প্রধান নভোচারী। বড় করে তাতে লেখা:
যে চারটি ভুল আমি করেছি। জানা গেল, তাঁর এককালে মেটাল শপ ছিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মেরিন কর্পসে। তারপর চলে গেলেন শান্তি মিশনে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। এরপর ফিরে এসে নিলেন শিক্ষকের চাকরি। কেন এগুলো ভুল ছিল, বললেন সে কথাও—স্বেচ্ছাসেবী কাজে একদমই পয়সা নেই, আর শিক্ষকের চাকরিতেও অর্থ তুলনামূলক কম। প্রেজেন্টেশনের পরের পৃষ্ঠাতেই দেখা গেল, এই কাজগুলোই তাঁর নভোচারী হওয়ার পথ গড়ে দিয়েছে। শান্তি মিশন শিখিয়েছে, বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কীভাবে যৌথভাবে কাজ করতে হয়। শিক্ষকতা শিখিয়েছে অদ্ভুত সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। আর মেটাল শপ? আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নানা কাজকর্ম। অনেক তত্ত্বকথার চেয়ে সেখানে গিয়ে হাতে-কলমে কাজ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর সবার উদ্দেশে শেষের আগে বললেন, ‘ভুল সবাই করে। কেউ যদি বলেন কোনো ভুল করেননি, তবে তা মিথ্যে কথা। ভুল থেকে শিখতে হবে। এই ভুলই তখন গড়ে দেবে ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার পথ।’
আকাবা কথা শেষ করলেন। এরপর আবার ভিডিও। পৃথিবীকে কেমন দেখায় মহাকাশ থেকে? একজন নভোচারী কী দেখেন? আমাদের সুন্দর গ্রহটার নানা রূপ স্তব্ধ করে দিল সবাইকে। ভিডিও শেষে বাতি জ্বলে উঠল। আকাবা বললেন, ‘ইয়েস, আওয়ার প্ল্যানেট ইজ সুপার কুল!’
সবাইকে নিয়ে ছবি তুলেই একছুটে বেরিয়ে গেলেন নাসার প্রধান নভোচারী। পেছনে তাকালে তিনি দেখতেন, একদল স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এই স্বপ্নবাজ মানুষগুলোই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
নাসার প্রধান নভোচারী এবারই প্রথম ঢাকায় এলেন। দেশের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করাই তাঁর এ সফরের উদ্দেশ্য। এই সফরের অংশ হিসেবেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এ বক্তৃতা আয়োজিত হয়। পাশাপাশি তিনি আর্টেমিস অ্যাকর্ডসে বাংলাদেশের যোগদানের ব্যাপারে আলোচনা করছেন। মহাকাশে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর প্রণীত এ নীতিমালায় বর্তমানে মোট ৫০টি রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছে। এটিই আর্টেমিস অ্যাকর্ডস। এ নীতিমালা নাসা ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরও জোরদারে সাহায্য করতে পারে। বলা বাহুল্য, এ অ্যাকর্ডসের অংশ হিসেবেই আর্টেমিস প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রায় ৫০ বছর পর আবার চাঁদে ফেরার উদ্যোগ নিয়েছে মানুষ।