মোনালিসার যে চিত্রকর্ম দেখছি, মনে হতে পারে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির সেই আসল চিত্রকর্ম। কিন্তু, আসলে ওপেনএআই দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে।
আমরা এখন এমন একটি সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাম্প্রতিকতম অবদান, জেনারেটিভ এআই সৃষ্টিশীলতার সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছে। মেশিন লার্নিং ও ডিপ লার্নিংয়ের অগ্রগতির ফলে, এআই এখন এমন কিছু সামগ্রী তৈরি করতে সক্ষম যা পূর্বে শুধু মানুষের সৃজনশীলতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি টেক্সট, ছবি, সঙ্গীত এমনকি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র তৈরি করতে সক্ষম।
এই জেনারেটিভ এআই আসলে কীভাবে কাজ করে? এসব মডেল বিশাল পরিমাণ ডেটা থেকে শেখে এবং সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু তৈরি করে। যেমন জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্কস (GANs) নামে একটি পদ্ধতি দুটি নিউরাল নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করে—একটি নতুন কিছু সৃষ্টি করে, আরেকটি তার সত্যতা যাচাই করে। ফলে প্রতিবার নতুন এবং আরও বাস্তবসম্মত কিছু তৈরি হয়।
এখন চিন্তা করো, এর প্রয়োগ কী কী হতে পারে? তোমরা হয়তো কোনো টেক্সটের বর্ণনা থেকে একটি ছবি তৈরি করতে চাইছ, কিংবা তোমরা একটি মুভি দেখছ, যেখানে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি চরিত্রের মুখ অন্য কারও সঙ্গে বদলে দেওয়া হয়েছে; এমন কিছু যা শুধু মানুষের কল্পনার মধ্যে ছিল। আর তা সম্ভব হয়েছে ওপেনএআইয়ের DALL·E মডেলের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ ওপরের মোনালিসার ছবিটি তো দেখলেই।
দ্বিতীয় উদাহরণটি আরও চমৎকার, আমি এআইকে বাংলায় ছোট্ট একটা টেক্সট লিখেছি, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণ–উত্থানে জেনারেশন জেডের অবদান ও প্রভাব নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা প্রণয়ন করুন।’ আর তাতেই এআই আমাকে নিচের এই বাস্তবসম্মত ছবি তৈরি করে দিল।
জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তির বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে ভাষা মডেল যেমন GPT (জিপিটি) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এসব মডেল মানুষের মতো প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা লিখতে ও প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে সক্ষম। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় অনুবাদের মাধ্যমে আরও সঠিক ও প্রাসঙ্গিক অনুবাদ সম্ভব হয়। বিনোদন ও সঙ্গীত জগতে, মিউজিক জেনারেশন মডেল যেমন অ্যাম্পার মিউজিক ও জুকডেক প্ল্যাটফর্মগুলো সংগীতশিল্পীদের বিভিন্ন ধারার গান তৈরিতে সাহায্য করে। গেম ডেভেলপমেন্ট ও ভার্চ্যুয়াল বাস্তবতায় জেনারেটিভ এআই গেমের মানচিত্র, স্তর ও চরিত্রগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে পারে, যা ডেভেলপারদের সময় অনেক বাঁচায়।
তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। যদি এআই বিদ্যমান কাজ থেকে শিখে নতুন কিছু সৃষ্টি করে, তবে সেই সৃষ্টির মেধাস্বত্ব কার হবে, এটি একটি জটিল প্রশ্ন। নীতিনির্ধারক মহলের এখনই উচিত এ ধরনের বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালা তৈরি করা। এদিকে, অনেক শিল্পী এমন অভিযোগ তুলছেন যে তাঁদের সৃজনশীল কাজগুলো এআই মডেল প্রশিক্ষণে তাঁদের অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে, যা আমাদের সমাজের নৈতিক ও আইনি কাঠামোগুলোর পুনর্বিন্যাসের দাবি করছে।
সে যাহোক, এতে তো কোনো সন্দেহ নেই যে জেনারেটিভ এআই সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনের নতুন যুগের সূচনা করেছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলছে। তবে এর সঙ্গে নৈতিক, সামাজিক ও আইনি চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবেলা করা গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক নীতিমালা ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা এই প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি।
তোমাদের কী মনে হয়, জেনারেটিভ এআই কীভাবে আমাদের জীবন আর সমাজকে প্রভাবিত করে?
ড. এম এম মনজুরুল ইসলাম: পোস্টডক্টরাল গবেষক, আলস্টার ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য এবং সহকারী অধ্যাপক, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ